রূপা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে।
মিসির আলি বললেন, ‘এমন করে তাকাচ্ছ কেন? চিনতে পারছ না?’
‘পারছি।’
‘তোমার খাতা ফেরত দিতে এসেছি। সবটা পড়ি নি। অর্ধেকের মতো পড়েছি।’
‘সবটা পড়েন নি কেন?
‘সবটা পড়ার প্রয়োজন বোধ করি নি। আমার যা জানার তা জেনেছি। তুমি শান্ত হয়ে আমার সামনে বস। আমার যা বলার বলব। আমি যখন কথা বলব তখন আমাকে থামাবে না। চুপ করে শুনে যাবে।’
রূপা কিছু বলল না। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। মিসির আলি বললেন, ‘তোমার খাতা পড়ে প্রথম যে-ব্যাপারটায় আমার খটকা লেগেছে তা হচ্ছে- তোমার ছেলের কবর গোরস্তানে কেন হল না? কেন তোমার বাড়িতে হল? তোমার মা এই কাজটি কেন করলেন? যে-মহিলা স্বামীর স্মৃতিচিহ্ন রাখেন না, সেই মহিলা তাঁর নাতির স্মৃতিচিহ্ন ধরে রাখার চেষ্টা কেন করবেন? রহস্যটা কী?
দ্বিতীয় খটকা- তোমার মা ধর্মপ্রাণ মহিলা। তিনি তোমার ছেলের কবরের কাছে দাঁড়িয়ে কখনো দোয়া-দরুদ পড়েন না। এর মানে কী? এটা কি তাহলে কবর না? মেয়ে ভোলানোর চেষ্টা?
‘গোরস্তানে কবর দিতে হলে ডেথ সার্টিফিকেট লাগে। তাঁর কাছে ডেথ সার্টিফিকেট ছিল না। কারণ বাচ্চাটি মরে নি। তুমি নিজেও তোমার মৃত শিশু দেখ নি।
‘ব্যাপারটা কি এ-রকম হতে পারে না যে তোমার মা দেখলেন- তোমাদের বিয়ে টিকিয়ে রাখতে হলে বাচ্চাটিকে মৃত ঘোষণা করাই সবচেয়ে ভালো বুদ্ধি? বাচ্চাটি দূরে সরিয়ে দিতে তাঁর খারাপ লাগল না, কারণ তিনিও খুব সম্ভব তোমার স্বামীর মতোই বিশ্বাস করেছেন- এই শিশুর বাবা তোমার স্বামী নন। তোমার মা মানসিকভাবে অসুস্থ একজন মহিলা। তাঁর পক্ষে এ-রকম মনে করাই স্বাভাবিক।
‘এখন আসছি তুমি যে শিশুর কথা শুনতে পাচ্ছ সে-ব্যাপারটিতে। শিশুর সঙ্গে মায়ের টেলিপ্যাথিক যোগাযোগ মোটামুটিভাবে স্বীকৃত। তুমি তারিখ দিয়ে-দিয়ে সব লিখেছ বলে আমার খুব সুবিধা হয়েছে। আমি লক্ষ করলাম শুরুতে তুমি শুধু কান্না শুনতে।’
‘প্রথম যখন মা-মা ডাক শুনলে, হিসেব করে দেখলাম শিশুটির বয়স তখন এক বছর। এক বছর বয়সী শিশুরা মা ডাকতে শেখে।
‘তোমার লেখা থেকে তারিখ দেখে হিসেব করে বের করলাম, তোমার ছেলে পুরো বাক্য যখন বলছে তখন তার বয়স তিন। এই বয়সে বাচ্চারা ছোট-ছোট বাক্য তৈরি করে।
‘আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি যে তোমার সঙ্গে তোমার ছেলের একধরনের যোগাযোগ হয়েছে। পুরো ব্যাপারটা প্যারানরম্যাল সাইকোলজির বিষয়। এবং রহস্যময় জগতের অসাধারণ একটি উদাহরণ।
‘আমার ধারণা, একটু চেষ্টা করলেই তুমি তোমার ছেলেকে খুঁজে পাবে। এত বড় একটা কাজ তোমার মা একা করতে পারেন না। তাঁকে কারো-না-কারোর সাহায্য নিতে হয়েছে। তোমাদের বাড়ির দারোয়ান, কাজের মেয়ে- এদের কাছ থেকে সাহায্য পেতে পার। পুলিশকে খবর দিতে পার। বাংলাদেশের পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ ইচ্ছা করলে অসাধ্য সাধন করতে পারে। তার পরেও যদি কাজ না হয় তুমি তোমার টেলিপ্যাথিক ক্ষমতা ব্যবহার কর। ছেলের কাছ থেকেই জেনে নাও সে কোথায় আছে।’
রূপা একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
মিসির আলি বললেন, ‘কিছু বলবে?’
রূপা না-সূচক মাথা নাড়ল।
মিসির আলি বললেন, ‘আজ উঠি। ধাক্কা সামলাতে তোমার সময় লাগবে। সাহস হারিও না। মন শক্ত রাখ। যাই।’
রূপা কোনো উত্তর দিল না, মূর্তির মতো বসে রইল।
এক মাস পরের কথা। মিসির আলির শরীর খুব খারাপ করেছে। তিনি তাঁর ঘরেই দিনরাত শুয়ে থাকেন। হোটেলের একটি ছেলে তাঁকে হোটেল থেকে খাবার দিয়ে যায়, বেশির ভাগ দিন সেইসব খাবার মুখে দিতে পারেন না। প্রায় সময়ই অসহ্য মাথার যন্ত্রণায় ছটফট করেন। এ-রকম সময়ে তিনি একটি চিঠি পেলেন। হাতের লেখা দেখেই চিনলেন- রূপার চিঠি। রূপা লিখেছে-
শ্রদ্ধাস্পদেষু,
আমি আমার ছেলেকে খুঁজে পেয়েছি। সে এখন আমার সঙ্গেই আছে। আপনার সামনে আসার সাহস আমার নেই। আমি জানি আপনাকে দেখে চিৎকার করে কেঁদেকেটে একটা কাণ্ড করব। আপনাকে বিব্রত করব। আমি কোনোদিনই আপনার সামনে যাব না। শুধু একদিন আমার ছেলেটাকে পাঠাব। আপনি তার একটি নাম দিয়ে দেবেন এবং তার মাথায় হাত দিয়ে একটু আদর করবেন। আপনার পুণ্যস্পর্শে তার জীবন হবে মঙ্গলময়।
আমি শুনেছি আপনার শরীর ভালো না। কঠিন অসুখ বাঁধিয়েছেন। আপনি চিন্তা করবেন না। একজন দুঃখী মা’র হৃদয় আপনি আনন্দে পূর্ণ করেছেন। তার প্রতিদান আল্লাকে দিতেই হবে। আমি আল্লাহ্র কাছে আপনার আয়ু কামনা করেছি। তিনি আমার প্রার্থনা শুনেছেন।’
মাথার তীব্র যন্ত্রণা নিয়েও তিনি হাসলেন। মনে মনে বললেন-বোকা মেয়ে, প্রকৃতি প্রার্থনার বশ নয়। প্রকৃতি প্রার্থনার বশ হলে পৃথিবীর চেহারাই পাল্টে যেত। পৃথিবীর জন্যে প্রার্থনা তো কম করা হয় নি।
মিসির আলি টিয়া পাখির বিষয়টি নিয়ে ভাবতে বসলেন। উড়ন্ত টিয়া পাখি কালো দেখায় কেন? কিছু একটা নিয়ে ব্যস্ত থাকা। মাথার তীব্র যন্ত্রণা ভুলে থাকার ছেলেমানুষি এক চেষ্টা।