তিব্বত এক অতি প্রাচীন এবং সাংস্কৃতিকভাবে সমৃদ্ধ অঞ্চল, যা বর্তমানে চীনের প্রশাসনিক শাসনের অধীনে। যদিও এটি একসময় একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে পরিচিত ছিল। আজকের দিনে এটি চীনের একটি স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল (অটোনমাস রিজিয়ন) হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। তিব্বতের ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং ধর্মীয় অবস্থান পৃথিবীজুড়ে একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার বহন করে কিন্তু বর্তমানে এটি বিশ্বের অন্যতম নিষিদ্ধ এবং পরাধীন ভূখণ্ড।
তিব্বতের ইতিহাস ও সংস্কৃতি-
তিব্বত ইতিহাসে এক বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে। বৌদ্ধ ধর্মের সূচনা এবং তিব্বতী বৌদ্ধধর্মের বিকাশের পীঠস্থান হিসেবে তিব্বতের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিব্বতের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য শতাব্দী ধরে নানা সংগ্রাম এবং শান্তির মিশ্রণ ছিল। কিন্তু ১৯৫০ সালে চীনের সেনাবাহিনী তিব্বতে প্রবেশ করে এবং ১৯৫১ সালে ‘৭৭০১ চুক্তি’ (১৭৭০-১ চুক্তি) নামে এক চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে তিব্বতকে চীনের অন্তর্গত করে নেয়। এর পর থেকে তিব্বতের স্বাধীনতা এবং সংস্কৃতি, বিশেষত তিব্বতী ভাষা এবং বৌদ্ধ ধর্মের চর্চা, চীনের সরকারের রক্তাক্ত দমন-পীড়নের শিকার হয়েছে।
তিব্বতের ধর্মীয় পরিপ্রেক্ষিত-
তিব্বতী বৌদ্ধ ধর্ম বা তিব্বতী বৌদ্ধধর্ম বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন এবং অমূল্য সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। তিব্বতী বৌদ্ধ ধর্মের মূল কেন্দ্রগুলো হলো লাসা শহরের প্যাল্কোর মঠ এবং তিব্বতের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা, দালাই লামা, যিনি মর্ত্যে তিব্বতী জনগণের সম্বল এবং সহিষ্ণুতার প্রতীক। তবে, চীন সরকার ১৯৫৯ সালে দালাই লামাকে তিব্বত থেকে নির্বাসিত করে এবং সেখানকার ধর্মীয় কর্মকাণ্ডের উপর কঠোর নজরদারি আরোপ করে।
তিব্বতী বৌদ্ধ মঠগুলোতে এখন আর পুরনো ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি আয়োজন করা যায় না এবং তিব্বতী ধর্মীয় সন্ন্যাসীরা ধর্মচর্চা করতে পারছেন না, যা তাদের জন্য এক বড় আঘাত। চীন সরকারের পক্ষ থেকে প্রায়ই ধর্মীয় চর্চা নিষিদ্ধ করা হয় এবং তিব্বতী ভাষা, ধর্ম এবং সংস্কৃতি ধ্বংসের চেষ্টা চলছে।
রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও মানবাধিকার-
তিব্বতের জনগণ আজও মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার। ১৯৮৯ সালে তিব্বতের লাসা শহরে তিব্বতী জনগণের একটি বৃহত্তম আন্দোলন গড়ে ওঠে। যার উদ্দেশ্য ছিল তিব্বতের স্বাধীনতা বা অন্তত কিছু রাজনৈতিক স্বাধীনতা। তবে চীন সরকার সশস্ত্র বাহিনী পাঠিয়ে এই আন্দোলন কঠোরভাবে দমন করে। হাজার হাজার তিব্বতী নিহত হয় এবং অসংখ্য মানুষকে গৃহবন্দী করা হয়।
তিব্বতের সাংস্কৃতিক এবং ধর্মীয় ঐতিহ্য ধ্বংসের পাশাপাশি চীন সরকার তিব্বতী জনগণের উপর বিভিন্ন দমননীতি চালু করেছে। যার মধ্যে রয়েছে তিব্বতী ভাষার শিক্ষার উপর নিষেধাজ্ঞা, ধর্মীয় চর্চার উপর কড়াকড়ি এবং রাজনৈতিক অস্থিরতার অভিযোগে হাজার হাজার তিব্বতীকে আটক করা।
তিব্বতের বর্তমান পরিস্থিতি-
বর্তমানে তিব্বত এক অন্ধকার সময় পার করছে। তিব্বতী জনগণের স্বকীয়তা এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রক্ষার সংগ্রাম অব্যাহত থাকলেও, চীন সরকারের চাপ এবং দমন-পীড়ন অব্যাহত রয়েছে। তিব্বতের জনগণ আজও তাদের অধিকারের জন্য সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে। বিশ্ব সম্প্রদায়ের কাছে তিব্বতী জনগণের সংগ্রাম একটি মানবাধিকার ইস্যু হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে কিন্তু চীন সরকার আন্তর্জাতিক চাপ উপেক্ষা করে তাদের শাসন চলিয়ে যাচ্ছে।
তিব্বতী বৌদ্ধ ধর্মের নেতা দালাই লামা আজও বিশ্বব্যাপী শান্তি ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার পক্ষে আওয়াজ তুলছেন, তবে তার দেশ তিব্বত থেকে নির্বাসিত অবস্থায়। যদিও আন্তর্জাতিক মঞ্চে তিব্বতের স্বাধীনতা বা জনগণের অধিকার নিয়ে আলোচনা চলছে। চীন সরকারের নীতি তাতে মোটেও পরিবর্তন হয়নি।
তিব্বতের স্বাধীনতা হারানো-
১৯৫০ সালে চীনের সেনাবাহিনী তিব্বত দখল করে এবং ১৯৫১ সালে ‘১৭৭০-১ চুক্তি’ স্বাক্ষর করে তিব্বতকে চীনের অধীনে নিয়ে আসে। ১৯৫৯ সালে তিব্বতের জনগণ স্বাধীনতার দাবিতে আন্দোলন শুরু করলে, চীন সেনাবাহিনী কঠোর দমন-পীড়ন চালায় এবং দালাই লামাকে ভারতে নির্বাসিত করে।
দালাই লামার ভূমিকা-
তিব্বতের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা দালাই লামা, তিব্বতী জনগণের স্বকীয়তা এবং শান্তির প্রতীক।
১৯৫৯ সালে তিব্বত থেকে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেন এবং আজও আন্তর্জাতিক মঞ্চে তিব্বতের স্বাধীনতা এবং মানবাধিকার প্রশ্নে সক্রিয়ভাবে প্রচারণা চালাচ্ছেন।
ধর্মীয় দমন ও সংস্কৃতির নিধন –
তিব্বতী বৌদ্ধধর্ম চীনের দমননীতির শিকার হয়েছে, বিশেষ করে তিব্বতের মঠগুলোতে চীনের সেনাবাহিনী প্রবেশ করে ধর্মীয় কর্মকাণ্ড বন্ধ করে দিয়েছে।
তিব্বতী ভাষার ব্যবহারও নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে চীনা ভাষা ব্যবহারের উপর চাপ দেওয়া হচ্ছে।
বহু ঐতিহ্যবাহী মঠ এবং ধর্মীয় স্থাপনাগুলি ধ্বংস বা সংস্কার করা হয়েছে।
মানবাধিকার লঙ্ঘন-
তিব্বতী জনগণের ধর্মীয় স্বাধীনতা, সাংস্কৃতিক চর্চা এবং রাজনৈতিক অধিকার চীনের সরকারের নীতি দ্বারা ব্যাপকভাবে দমন করা হচ্ছে।
তিব্বতের জনগণকে নিয়মিতভাবে নির্যাতন, আটক, গুম এবং অমানবিক শাস্তির শিকার হতে হচ্ছে। ২০০৮ সালের লাসা বিদ্রোহ এবং অন্যান্য আন্দোলনে চীনের সেনাবাহিনী তিব্বতী জনগণের উপর ব্যাপক নৃশংসতা চালায়।
বিশ্বব্যাপী তিব্বতের পরিস্থিতি –
আন্তর্জাতিকভাবে তিব্বতের পরিস্থিতি নিয়ে নানা প্রতিবাদ এবং আলোচনা হলেও চীন সরকার বিষয়টি বন্ধুত্বপূর্ণভাবে সমাধান করতে রাজি হয়নি।
কিছু দেশ এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন তিব্বতের জনগণের অধিকার সমর্থন করে, তবে চীন তার অভ্যন্তরীণ বিষয় হিসেবে তিব্বতকে দেখে।
চীনের শাসন ব্যবস্থা-
চীনের সরকারের পক্ষ থেকে ‘তিব্বত অটোনমাস রিজিয়ন’ নামে এই অঞ্চলের প্রশাসন পরিচালিত হলেও, এখানে চীনের কঠোর শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত রয়েছে।
তিব্বতের স্থানীয় প্রশাসন এবং জনগণের কোনও স্বাধীন রাজনৈতিক অধিকার নেই, সবকিছুই চীনের কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণে।
নির্বাসিত তিব্বতী জনগণ দালাই লামার নেতৃত্বে ভারতে আশ্রয় নিয়েছে এবং তিব্বতী শরণার্থী ক্যাম্পগুলোতে তাদের জীবনযাপন করছে।
বিশ্বজুড়ে তিব্বতী শরণার্থীরা নিজেদের সংস্কৃতি এবং ধর্মীয় স্বাধীনতা রক্ষা করতে সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে।
বর্তমান পরিস্থিতি-
তিব্বতের জনগণ এখনো তাদের স্বাধীনতা এবং সাংস্কৃতিক অধিকার ফিরে পাওয়ার জন্য সংগ্রাম করছে।
চীনের সরকার তিব্বতের জনগণের প্রতি ক্রমাগত অত্যাচার চালিয়ে যাচ্ছে কিন্তু তিব্বতী জনগণ তাদের ইতিহাস এবং সংস্কৃতির প্রতি অবিচল রয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা-
তিব্বতের ইতিহাস, ভাষা এবং সংস্কৃতি সম্পর্কে গবেষণা বর্তমানে বেশ সীমিত এবং চীনের সরকারের নিষেধাজ্ঞার কারণে তিব্বত নিয়ে স্বাধীন গবেষণাও কঠিন হয়ে পড়েছে।
তবে অনেক বিদেশি গবেষক, সংগঠন এবং মানবাধিকার সংগঠন তিব্বতের সংস্কৃতি ও ইতিহাস রক্ষার জন্য কাজ করে যাচ্ছে।
তিব্বতে এবং বিদেশে তিব্বতী সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রতিবাদ এবং আন্দোলন অব্যাহত রয়েছে।
তিব্বতী জনগণের আত্মত্যাগ এবং প্রতিবাদ অনেকবার আন্তর্জাতিক মনোযোগ আকর্ষণ করেছে, তবে চীনের সরকার এখনও তাদের নীতি পরিবর্তন করেনি।
ভূগোলিক অবস্থান-
তিব্বত হিমালয়ের উত্তরাঞ্চলে অবস্থিত এবং এটি পৃথিবীর সর্বোচ্চ অঞ্চল হিসেবে পরিচিত। তিব্বতের গড় উচ্চতা প্রায় ৪৫০০ মিটার (১৪ হাজার ৭০০ ফুট)।
এটি চীনের একটি স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল (অটোনমাস রিজিয়ন) যার রাজধানী লাসা শহর।
চীনের শাসন-
১৯৫০ সালে চীনের সেনাবাহিনী তিব্বতে প্রবেশ করে এবং ১৯৫১ সালে সিনচিয়াং চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যা তিব্বতকে চীনের অন্তর্ভুক্ত করে। বর্তমানে তিব্বত “তিব্বত অটোনমাস রিজিয়ন” (TAR) হিসেবে পরিচিত, তবে চীনের কেন্দ্রীয় সরকার এই অঞ্চলের ওপর পূর্ণ কর্তৃত্ব বজায় রেখেছে।
মানবাধিকার পরিস্থিতি —
তিব্বতের মানবাধিকার পরিস্থিতি অত্যন্ত উদ্বেগজনক। প্রতিবাদী তিব্বতী জনগণের বিরুদ্ধে চীনা সরকার একাধিকবার সহিংস দমন-পীড়ন চালিয়েছে।
২০০৮ সালের লাসা বিদ্রোহ এবং অন্যান্য প্রতিবাদ আন্দোলনের সময় চীনা সেনাবাহিনী ব্যাপক নৃশংসতা চালায়, যার ফলে হাজার হাজার তিব্বতী নিহত হয়।
তিব্বতী জনগণের ধর্মীয় স্বাধীনতা, ভাষাগত অধিকার এবং সাংস্কৃতিক স্বকীয়তা মারাত্মকভাবে সীমাবদ্ধ।
অর্থনৈতিক উন্নয়ন-
চীন তিব্বতে ব্যাপক উন্নয়ন প্রকল্পের সূচনা করেছে, যা তিব্বতের অবকাঠামো এবং পরিবহন ব্যবস্থা উন্নত করতে সহায়তা করছে।
তবে, তিব্বতী জনগণের জন্য অর্থনৈতিক সুফল অনেক কম এবং অধিকাংশ উন্নয়ন চীনা অভিবাসীদের সুবিধার জন্য করা হয়েছে।
তিব্বতী জনগণ চীনা শাসনের অধীনে বেকারত্ব, দারিদ্র্য এবং সাংস্কৃতিক সংকটে ভুগছে।
তিব্বতের শিক্ষাব্যবস্থা চীনা ভাষায় পরিচালিত হয় এবং তিব্বতী ভাষার শিক্ষা ব্যাপকভাবে নিষিদ্ধ। অনেক তিব্বতী শিক্ষার্থী চীনা ভাষা শিখতে বাধ্য হচ্ছে, ফলে তাদের নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি আগ্রহ কমে যাচ্ছে।
তিব্বতের সাংস্কৃতিক শিক্ষা এবং ইতিহাস নিয়ে গবেষণাও অত্যন্ত সীমিত।কারণ চীনের সরকারের পক্ষ থেকে এসব বিষয়ে স্বাধীন গবেষণা বাধাগ্রস্ত। আন্তর্জাতিকভাবে তিব্বতের পরিস্থিতি নিয়ে প্রতিবাদ অব্যাহত, বিশেষ করে মানবাধিকার সংগঠনগুলি তিব্বতের ওপর চীনের দমননীতি নিয়ে সোচ্চার।
তিব্বতের বহু শরণার্থী বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নিয়েছে, বিশেষ করে ভারতে।
দালাই লামার নেতৃত্বে তিব্বতী গোষ্ঠী আন্তর্জাতিক মঞ্চে তাদের অধিকারের দাবিতে প্রচার চালাচ্ছে, তবে চীন সরকারের নীতি তাতে কোনো পরিবর্তন আনেনি।
আজকের তিব্বতের চিত্র-
তিব্বতে চীনা সেনাবাহিনীর উপস্থিতি ব্যাপক এবং সেখানে নিরাপত্তার কারণে বিদেশি সাংবাদিকদের প্রবেশ কঠিন।
তিব্বতী জনগণ এখনো ধর্মীয় স্বাধীনতা এবং সাংস্কৃতিক অধিকার ফিরিয়ে পাওয়ার জন্য সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে।
আধুনিক তিব্বত এখন একদিকে চীনা শাসনের তলায় উন্নতি ও আধুনিকতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, অন্যদিকে তার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হারানোর শঙ্কায় রয়েছে।
এভাবে তিব্বত আজও এক সংকটময় পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছে। যেখানে রাজনৈতিক স্বাধীনতা, সাংস্কৃতিক চর্চা এবং মানবাধিকার সুরক্ষিত হওয়ার জন্য সংগ্রাম অব্যাহত আছে।