‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’ বাংলাদেশের স্বনামধন্য ঔপন্যাসিক শওকত আলী রচিত একটি বাংলা ভাষার ঐতিহাসিক উপন্যাস। উপন্যাসটি ১৯৮৪ সালে প্রথম প্রকাশিত হয় দি ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড থেকে। ১৯৮৩ সালে সাপ্তাহিক বিচিত্রার ঈদ সংখ্যায় প্রদোষে প্রাকৃতজন প্রকাশিত হয়েছিল এবং ১৯৮৪ সালে প্রকাশিত হয়েছিল দুষ্কালের দিবানিশি। ১৯৮৪ সালেই প্রকাশনা সংস্থা ইউপিএল দুখন্ড একত্রিত করে প্রদোষে প্রাকৃতজন নামে প্রকাশ করে। তুর্কিদের আক্রমণ ও সেন রাজাদের সময়য়ে বঙ্গদেশের প্রাকৃতজনদের কাহিনী বর্ণিত হয়েছে এ উপন্যাসে।
গল্প সংক্ষেপ-
সেন রাজাদের রাজত্বকালে দেশের সাধারণ জনগণ সামন্ত মহাসামন্তদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ। তাদের অত্যাচারের প্রতিবাদ করে কখনো অন্ত্যজ হিন্দুরা, কখনো বৌদ্ধ ভিক্ষুরা। সে সময়কালে কয়েকজন প্রাকৃতজনের জীবন-সংগ্রামের গল্প প্রদোষে প্রাকৃতজন। আত্রেয়ী নদী তীরের মৃৎশিল্পী শ্যামাঙ্গ জানে না কেন তার গুরু বসুদেব তার প্রতি রাগান্বিত। মায়াবতী চায় তার স্বামীকে তার বাহুডোরে আগলে রাখতে কিন্তু কোন টানে সে ছুটে যায় মিত্রানন্দের কাছে। স্বামী পরিত্যক্তা লীলাবতী কি ফিরে পাবে স্বামী অভিমন্যু দাসকে। কিংবা অন্ত্যজ হিন্দুরা বা বৌদ্ধ ভিক্ষুরা কি পারবে সামন্ত মহাসামন্তদের অত্যাচার থেকে দেশকে বাঁচাতে।
ফ্ল্যাপে লিখা কিছু কথা-
ফ্ল্যাপে লিখা কথা সেনরাজার শাসন থেকে স্খলিত হয়ে যাচ্ছে দেশে, তুর্কী আক্রমণ অত্যাসন্ন। তবু সামন্ত মহাসামন্তদের অত্যাচারের শেষ নেই। সেই অত্যাচা রুখে দাঁড়ায় কখনো অন্ত্যজরা, কখনো বৌদ্ধেরা। শাসকদের বিশেষ রোষ তাই তাদর উপরেই। তাদেরই একজন প্রশ্ন করেন ‘দেখো, এই কি মানুষের জীবন? সুখ নাই, স্বতি নেই, গৃহ নেই, কেবলি প্রাণ নিয়ে পলায়ন করতে হচ্ছে-এর শেষ কোথায়? এ জীবন কি যাপন করা যায়? বলো, কতো দিন এভাবে চলবে?’ ইতিহাসের সেই প্রদোষকালের জটিল আবর্তে ঘূর্ণ্যমান কয়েকজন প্রাকৃত নরনারীরির কাহিণী বিবৃত হয়েছে এই উপন্যাসে। ইতিহাসে তাদের নাম নেই। হয়তো অন্য নামে তারা বাস করেছে সেই কালে, হয়তো অন্য কালেও।
মৃৎশিল্পী শ্যামাঙ্গের যত্নকৃত শিল্প রজচনায় কেন ছেদ পড়ে, কিসের অন্বেষণে তাকে নিরুদ্দেশযাত্রা করতে হয়? স্বামী পরিত্যক্তা লীলাবতী কী চায়, কেন পায় না? মায়াবতীর কোমল বাহুবন্ধন ছিন্ন করে বসন্তদাস কেন মিত্রানন্দের সঙ্গী হয়? মানুষকে স্বপরিচয়ে উঠে দাঁড়াতে বলে মিত্রানন্দ, নতজানু দাসত্ব থেকে মুক্ত হতে বলে। এর বেশি সে জানে না, জানবার আবশ্যকতাও বোধ করে না। বসন্তদাসও চায় প্রচলিত ব্যবস্থা বিধ্বস্ত করতে, কিন্তু সে আরও জানতে চায় যে, তার পরিবর্তে কী পাবে সকলে? এসব প্রশ্নের মীমাংসা হবার আগেই ইতিহাসের ঝঝা এসে তাদর সমূলে উৎপাটিত করে। কিন্তু এইসব জিজ্ঞাসা আর ভালোবাসা স্বপ্ন আর প্রয়াসের সারাৎসার তারা সঁপে দিয়ে যায় উত্তরসূরীদের হাতে। বড়ো যত্নের সঙ্গে শওকত আলী লিখেছেন তাদের কথা, সেই সময়ের কথা। গবেষণার সঙ্গে এই বইতে যুক্ত হয়েছে দরদ, তথ্যের সঙ্গে মিলেছে অন্তর্দৃষ্টি, মনোহর ভঙ্গির সঙ্গে মিশেছে অনুপম ভাষা। ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’ আমাদের উপন্যাসের ধারায় একটি স্মরণীয় সংযোজন। (আনিসুজ্জামান)

