Close Menu
Citizens VoiceCitizens Voice
    Facebook X (Twitter) Instagram YouTube LinkedIn WhatsApp Telegram
    Citizens VoiceCitizens Voice Fri, Dec 19, 2025
    • প্রথমপাতা
    • অর্থনীতি
    • বাণিজ্য
    • ব্যাংক
    • পুঁজিবাজার
    • বিমা
    • কর্পোরেট
    • বাংলাদেশ
    • আন্তর্জাতিক
    • আইন
    • অপরাধ
    • মতামত
    • অন্যান্য
      • খেলা
      • শিক্ষা
      • স্বাস্থ্য
      • প্রযুক্তি
      • ধর্ম
      • বিনোদন
      • সাহিত্য
      • ভিডিও
    Citizens VoiceCitizens Voice
    Home » একজন মায়াবতী (৬ষ্ঠ খন্ড)- জার্মান কালচারাল সেন্টারে ছবির এক্সিবিশন: হুমায়ূন আহমেদ
    সাহিত্য

    একজন মায়াবতী (৬ষ্ঠ খন্ড)- জার্মান কালচারাল সেন্টারে ছবির এক্সিবিশন: হুমায়ূন আহমেদ

    এফ. আর. ইমরানJanuary 25, 2025
    Facebook Twitter Email Telegram WhatsApp Copy Link
    Share
    Facebook Twitter LinkedIn Telegram WhatsApp Email Copy Link

    ‘জার্মান কালচারাল সেন্টারে ছবির এক্সিবিশন’ সুভেনিয়ারে লেখা ‘Sunrise 71’। পঞ্চাশটি নানা মাপের ছবি। মীরা সুভেনিয়ার হাতে ক্লান্ত ভঙ্গিতে হাঁটছে। মীরার দূর সম্পর্কের খালাতো ভাই–মইন তার সঙ্গে আছে। লোকজন ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাচ্ছে, মইনের দিকে। তাকে পুরোপুরি বিদেশী বলে মনে হচ্ছে। মইন প্রায় ছ ফুটের মতো লম্বা। মাথার বেশিরভাগ চুল সাদা হওয়ায়- চুলে লালচে কালো রং দিয়েছে। লাল চুলের ধবধবে ফর্স একজন মানুষ। গায়ে পায়জামা-পাঞ্জাবি, পাঞ্জাবির উপর কাজ করা গাঢ় লাল রঙের চাদর। এমন চাদর পরতে যথেষ্ট সাহস লাগে। মইনের সাহসের কোনো অভাব নেই। তার বয়স পঁয়তাল্লিশ পার হয়ে গেছে। চোখের কোল ঈষৎ ফোলা, এ ছাড়া চেহারায় বয়সের কোনো ছাপ নেই। মীরার সঙ্গে মইনের দেখা এগার বছর পর। এগার বছর আগে এক মেঘলা দুপুরে মীরার মনে হয়েছিল, এই মানুষটিকে ছাড়া বেঁচে থাকার কোনাে মনে হয় না। এই মানুষটি আছে বলেই পৃথিবী আছে, চন্দ্ৰ-সূৰ্য আছে। এই মানুষটি পৃথিবীতে আছে বলেই পৃথিবী এত সুন্দর।

    মইন বেশ উঁচু গলায় বলল, ইন্টারেস্টিং!

    তার আশপাশে যারা ছিল সবাই তাকাল। মইন মীরার চোখে চোখ রেখে বলল, স্বাধীনতা যুদ্ধ নিয়ে ছবি অথচ সব ছবির ক্যাপশন ইংরেজিতে। মজার ব্যাপার না মীরা?

    মীরা কিছু বলল না।

    মইন আগের মতোই উঁচু গলায় বলল, আমি এই এক মাসে তিনটা ছবির এক্সিবিশন দেখলাম। তিনটাতেই দেখি ছবির ক্যাপশন ইংরেজিতে। সম্ভবত আর্টিস্টরা তাদের ছবির জন্যে বাংলা ভাষাকে যোগ্য মনে করে না।

    মীরা বলল, চুপ করুন তো। আপনাকে নিয়ে কোথাও যাওয়াই মুশকিল। আর্টিস্টদের নিশ্চয়ই কোনো যুক্তি আছে।

    সেই যুক্তিটা শুনতে চাচ্ছি। তুমি কি জান?

    না, আমি জানি না। চলুন যাই বেরিয়ে পড়ি। আর ভাল্লাগছে না।

    আমার তা ভালোই লাগছে। একটা ছবি কিনব বলে ভাবছি। ছবি কেনার কায়দাকানুন তুমি জানো? কার সঙ্গে কথা বলব?

    আমি জানি না। কার সঙ্গে কথা বলবেন। ঐ যে ডেস্কের কাছে একজন ভদ্রলোক বসে আছেন- উনাকে জিজ্ঞেস করুন। উনিই আটিষ্ট।

    বুঝলে কী করে?

    সুভেনিয়ারে উনার ছবি আছে।

    মইন লম্বা লম্বা পা ফেলে এগিয়ে গেল। ইংরেজিতে নিখুঁত ব্রিটিশ উচ্চারণে যা বলল তার বঙ্গানুবাদ হলো, স্বাধীনতা বিষয়ক আপনার ছবিগুলো দেখে আমার খুবই ভালো লেগেছে। এ দেশের শিল্পীরা যে স্বাধীনতা বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করেছে। তা বোঝা যায়। আপনার আঁকা ছবিগুলোর মধ্যে একটি আমার খুবই পছন্দ হয়েছেছবির নাম দ্যা বায়োনেট। আমি ছবিটি কিনতে চাই। ইউএস ডলারে আমাকে কত দিতে হবে?

    আর্টিস্ট ভদ্রলোক খানিকটা হকচকিয়ে গেলেন। কী বলবেন তা ইংরেজিতে ঠিক গুছিয়ে উঠতে পারলেন না। শুধু বললেন–জাস্ট এ মিনিট। তিনি ব্যাকুল হয়ে চারদিকে তাকাতে লাগলেন। সম্ভবত ইংরেজি জানা পরিচিত কাউকে খুঁজছেন যিনি বাঙালি পোশাক-পরা এই বিদেশীর সঙ্গে ছবির দরদাম নিয়ে কথা চালাতে পারবেন।

    মইন আবার আগের মতোই ব্রিটিশ উচ্চারণে বলল, ls there any problem sir?

    আর্টিস্ট অপ্রস্তুতের হাসি হেসে বললেন, Just a minite. My English very bad.

    মইন আবার বাংলায় বলল, আপনার ইংরেজির জ্ঞান অল্প তাহলে ছবির ক্যাপশন ইংরেজিতে দিয়েছেন কেন? আপনি রাগ করবেন না। কৌতুহল থেকে প্রশ্ন করছি। অনেকদিন দেশের বাইরে ছিলাম, দেশের নিয়ম-কানুন জানার চেষ্টা করছি।

    মইন ভেবেছিল আটিস্ট রেগে যাবে। রেগে গেলেই লজিকবিহীন উল্টাপাল্টা কথা শুরু করবে। তখন মোটামুটি একটা ইন্টারেস্টিং সিচুয়েশান হতে পারে। আশ্চর্যের ব্যাপার, আর্টিস্ট একেবারেই রাগ করল না, বরং হেসে ফেলল। হামতে হাসতেই বলল, আপনাকে দেখে আমেরিকান ভেবেছিলাম। আজকাল আমেরিকানরা খুব পায়জামাপাঞ্জাবি পরে। শাল গায়ে দিয়ে ভাবে–এ দেশের সংস্কৃতি শিখে ফেলছে। আমি ভাই আপনার ইংরেজি শুনে ভড়কে গিয়েছিলোম। আমি সরাসরি ইংরেজি বলতে পারি না। প্রথমে বাংলায় চিন্তা করি তারপর মনে মনে ট্রানস্লেশন করি। মেট্রিকে ইংরেজিতে কত পেয়েছিলাম জানেন? চৌত্রিশ। একেবারে জানের পাশ দিয়ে গুলি গেছে।

    আপনি কিন্তু এখনো আমার প্রশ্নের জবাব দেন নি।

    দিচ্ছিরে ভাই দিচ্ছি। আমার সাথে বারান্দায় আসেন। বারান্দায় চা খেতে খেতে আপনাকে বুঝিয়ে দেই।

    মইন বারান্দায় চলে এল। আর্টিস্ট হাসিমুখে বললেন, আর্ট কলেজ থেকে বের হয়েছি চার বছর আগে। কোনো চাকরি-বাকরি নেই। ছবির এক্সিবিশন করি, কিছু ছবি বিক্রি হয়, তা দিয়ে দিন চলে। ঐসব ছবি কারা কিনে-বিদেশীরা। আমাদের মানুষরা ভাত খেতে পারে না-ছবি কিনবে কী? ঐ বিদেশীদের জন্যেই ক্যাপশনগুলো ইংরেজিতে লেখা।

    আপনার যুক্তি গ্ৰহণ করা যায়।

    তাহলে আরেকটা কথা শুনে যান-সুভেনিয়ারে ইংরেজির পাশাপাশি বাংলায়ও ছবির নাম দেয়া আছে। আমাকে আক্রমণ করার সুযোগ পেয়ে আপনি এতই উল্লসিত ছিলেন যে ব্যাপারটা লক্ষ করেন নি।

    সরি। আপনাদের মতো লোকজন যারা সারাজীবন বাইরে থাকে-মাঝে মাঝে কিছুদিনের জন্যে দেশে আসে এবং দেশের প্রতি বাংলা ভাষার প্রতি, মমতায় অসম্ভব কাতর হয়ে পড়ে-তাদেরকে আমি কী মনে করি জানতে চান?

    জানতে চাই না। এই জানাটা আমার জন্যে খুব আনন্দজনক হবে না তা বুঝতে পারছি।

    জানতে না চাইলে বলব না। ছবি কি সত্যি সত্যি কিনবেন না চাল দেখালেন?

    কিনব। সত্যি সত্যি কিনব।

    ছবির দাম দশ হাজার টাকা। ইউ.এস. ডলারে আপনি দুশ ডলার দিলেই হবে। বন্ধু হিসেবে এটা হলো আমার কমিশন।

    মইন দুটি একশ ডলারের নোট বের করল।

    আর্টিস্ট নির্লিপ্ত গলায় বলল, এক্সিবিশন আরো তিনদিন চলবে। থার্ড ডে-তে বিকেলে যদি আসেন ছবি নিয়ে যেতে পারবেন। কিংবা আপনার ঠিকানা দিয়ে গেলে ছবি পাঠিয়ে দেবার ব্যবস্থা করব।

    আমি নিজেই আসব। চা খাবার কথা বলে বারান্দায় এনেছিলেন। চা কোথায়?

    চা আসছে। একটু অপেক্ষা করুন।

    কাউকে চায়ের কথা বলেছেন-এমন শুনি নি কিন্তু।

    কাউকে বলি নি তবে ব্যবস্থা করা আছে। রাস্তার ওপাশে ঐ যে চায়ের দোকান দেখছেন ওদের বলা আছে যখনই আমাকে বারান্দায় দেখবে-চা নিয়ে আসবে।

    মইন লক্ষ করল, একটা বাচ্চা ছেলে দুকাপ চা নিয়ে সত্যি সত্যি আসছে।

    মইন জার্মান কালচারাল সেন্টারে গাড়ি নিয়ে এসেছিল।

    মীরাকে বলল, গাড়ি ছেড়ে দিয়ে রিকশা নিলে কেমন হয়? রিকশা নিয়ে খানিকক্ষণ ঘুরি, কেমন? ক্ষিধেটা ভালোমতো জমুক, তারপর কোনো একটা ভালো রেস্টুরেন্টে খাওয়া যাবে। এখন বাজে মাত্র বারটা দশ। একটা-দেড়টার দিকে খাওয়া-দাওয়া করব, কেমন?

    আজ বাদ দিলে কেমন হয়। কেন জানি ভালো লাগছে না, খুব ক্লান্ত লাগছে-।

    ভালো না লাগলে অবশ্যি প্রোগ্রাম বাতিল করে দিতে হবে। তবে দ্বিতীয়বার আর এই প্রোগ্রাম করা সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। নয় তারিখ আমি চলে যাচ্ছি।

    টিকিট পেয়ে গেছেন?

    ইয়েস মাই ফেয়ার লেডি।

    বেশ, তাহলে চলুন রিকশা করে খানিকক্ষণ ঘুরি।

    রিকশায় উঠতে উঠতে মইন বলল, তুমি খানিকটা অনিচ্ছা নিয়ে যাচ্ছ-কোনো অসুবিধা নেই। অনিচ্ছা দূর হয়ে যাবে। আমি একজন ভালাে কােম্পেনিয়ন, আশা করি তা স্বীকার কর।

    জ্বি স্বীকার করি।

    এক সময় আমার জন্যে খুব আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করতে-এটাও বোধহয় ভুল না।

    না ভুল না। অপেক্ষা করতাম। যখন ক্লাস টেনে পড়তাম তখন আপনাকে দেবতার মতো মনে হত।

    এখন মনে হয় না?

    না।

    এখন কী মনে হয়?

    এখন সাধারণ একজন মানুষ বলে মনে হয়।

    সাধারণ?

    হ্যাঁ সাধারণ এবং একটু বোকা।

    মইন বিস্মিত হয়ে বলল, বোকা! এই প্রথম কেউ আমাকে বোকা বলল!

    মীরা সহজভাবে বলল, আমিই বুঝি প্রথম বললাম? আমার ধারণা ছিল আমার আগেও আরো কেউ বলেছে।

    না বলে নি। তুমি কী কারণে আমাকে বোকা বলেছ একটু ব্যাখ্যা কর তো।

    আপনার মধ্যে একটা লোক-দেখানো ব্যাপার আছে। প্রবলভাবেই আছে। আপনার মেধার একটি বড় অংশ আপনি ব্যয় করেন কীভাবে লোকদের ইমপ্রেস করবেন তার কায়দা-কানুন বের করার জন্যে। এই যে আর্ট গ্যালারিতে নাটকটা করার চেষ্টা করলেন তার পেছনে একই জিনিস কাজ করেছে। এই যে গাড়ি ছেড়ে দিয়ে রিকশা নিলেন তার পেছনেও আমাকে ইমপ্রেস করার ব্যাপার আছে। আছে না? আপনি নিশ্চয় ভাবছেনএই কাণ্ডটা করার ফলে আমি ভাবব-মানুষটা সাধারণ আর দশটা মানুষের মতো না।

    মইন বলল, আমি কি সিগারেট ধরাতে পারি?

    পারেন।

    আশা করি ধোঁয়ায় তোমার অসুবিধা হবে না।

    না, হবে না।

    মইন সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলল, তুমি অসম্ভব স্মার্ট হয়েছ। ভেরি ভেরি স্মার্ট।

    আপনি কি ভেবেছিলেন। এখানো আমি ক্লাস টেনের ছাত্রী?

    তা ভাবি নি। তবে….

    তবে কী?

    এ রকম স্মার্টনেসও আশা করিনি। স্মার্টনেসের সঙ্গে সঙ্গে খানিকটা কাঠিন্যও চরিত্রে চলে এসেছে–আই লাইক ইট। হাসছ কেন মীরা?

    ‘আই লাইক ইট’ শুনে হাসলাম। মনে আছে আপনি প্রায়ই আই লাইক ইট। বলতেন?

    বলতাম নাকি? আমার মনে নেই। রিকশায় ঘুরতে ভালো লাগছে না, চল কোথাও গিয়ে বসি। রিকশায় কথা বলে আরাম পাওয়া যায় না। মুখ দেখা যায় না। তাকিয়ে থাকতে হয় রিকশাওয়ালার পিঠের দিকে।

    মীরা বলল, আমার কিন্তু রিকশায় ঘুরতে ভালোই লাগছে। মাথা ধরেছিল। মাথা ধরাটা এখন গেছে।

    তাহলে চল খানিকক্ষণ ঘুরি। এক কাজ করি- রিকশা করেই গুলশানে যাই। গুলশানে সি ফুডের ভালো রেস্টুরেন্ট আছে। লবস্টার খাওয়া যাবে।

    মীরা কিছু বলল না।

    মইন খুব সহজ ও স্বাভাবিক ভঙ্গিতে মীরার হাঁটুতে হাত রেখেছে। তার মনে কোনো দ্বিধা, কোনো সংকোচ নেই। মীরাও কোনোরকম অস্বস্তি বোধ করছে না।

    মীরা।

    জ্বী।

    আমার রিকশা নেবার পেছনে যে যুক্তি তুমি দিয়েছ তা পুরোপুরি ঠিক না। রিকশার সবচে’ বড় সুবিধা হচ্ছে-ঘনিষ্ঠ হয়ে বসার সুযোগ পাওয়া যায়। এই যে আমি আমার বাঁ হাত তোমার হাঁটুতে রাখলাম- এটাও খুব অস্বাভাবিক লাগছে না তোমার কাছে। কারণ, আমার এইহাত রাখার জায়গা নেই- হা-হা-হা।

    মীরা বলল, আমার সঙ্গে ঘনিষ্ট হয়ে বসার কােনাে বাসনা কি কখনাে আপনার মধ্যে ছিল?

    মইন বলল, ছিল না। যখন তোমার সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল তখন তুমি ছিলো নিতান্তই বালিকা। অদ্ভুত অদ্ভুত সব চিন্তা-ভাবনায় তোমার মাথাটা ছিল ঠাসা। তাছাড়া আমার প্রতি তোমার আগ্রহ ছিল এতই প্ৰবল, এতই তীব্ৰ যে আমার আগ্রহ অপ্রয়োজনীয় ছিল।

    এতদিন পর আপনারই বা হঠাৎ ঘনিষ্ঠ হয়ে বসার ইচ্ছা হলো কেন?

    নি না। বয়স হয়েছে বলেই হয়তো। অবশ্যি তুমি অনেক সুন্দর হয়েছ। বালিকা বয়সে তােমার চেহারায় দিশহারা দিশহারা ব্যাপার ছিল- তাতে তােমাকে খানিকটা হলেও পাগলের মতো দেখাত।

    এখন দেখাচ্ছে না?

    না।

    মীরা হালকা গলায় বলল, বালিকা বয়সে আমি দিশাহারা ছিলাম না। আমাকে তীব্ৰভাবে আকর্ষণ করার জন্যে আপনি ছিলেন। এখন আমি দিশাহারা।

    দিশাহারা হলেও চেহারায় কিন্তু তার ছাপ নেই। এখন তোমার কথা বল। আমি সিগারেট ধরিয়ে সিগারেট টানব। তুমি কথা বলতে থাকবে, আমি শুনব। এক সময় আমি কথা বলতাম। তুমি হাঁ করে শুনতে; এখন তুমি বলবে-আমি শুনব।

    রিকশাওয়ালাও শুনবে।

    শুনুক, ক্ষতি কী? তার সঙ্গে দ্বিতীয়বার দেখা হবার সম্ভাবনা খুবই কম। হলেও কিছু যায় আসে না। অবশ্যি তুমি ইংরেজিতেও বলতে পার।

    আমার বলার মতো কিছু নেই।

    বিয়ে করছি সেই খবর পেয়েছিলাম।

    পাওয়ারই তো কথা। আমি আপনাকে চিঠি দিয়ে জানিয়েছিলাম।

    তোমার একটা বাচ্চা মারা গেছে এই খবর কিন্তু জানাও নি। দেশে এসে শুনলাম। মাই ডিপেস্ট সিমপ্যাথি।

    মীরা কিছু বলল না। মুখের উপর সরাসরি রোদ এসে পড়েছে। কপাল বিড়বিড় করছে।

    মীরা।

    জ্বি।

    তোমার ম্যারেজ ব্রেকডাউন করল কেন বল তো? আমি বেশ কয়েকজনকে জিজ্ঞেস করেছি। কেউ স্পেসিফিক্যালি কিছু বলতে পারে না। তোমার বড় ভাই জালাল সাহেবকেও জিজ্ঞেস করেছিলাম। উনিও কিছু বলতে পারেননি। শুধু বলেছেন-লোকটা গাধা টাইপের। তাকে মানুষ বলা যায় না। সে হচ্ছে ফার্নিচারের মতো। সত্যি?

    খানিকটা সত্যি।

    তোমার মতো বুদ্ধিমতী মেয়ে জেনেশুনে একটা ফার্নিচার বিয়ে করবে!

    আমি বুদ্ধিমতী না। বুদ্ধিমতী হলে-আপনার জন্যে এমন পাগল হতাম না।

    এক সময় আমার জন্যে পাগল হয়েছিলে তার জন্যে এখন কি তুমি রিপেনটেড?

    না, রিপেনটেড না। আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় ছিল ঐটা। আর আমার কথা বলতে ইচ্ছা করছে না। আমি এখন চুপ করে থাকব।

    মীরা সত্যি সত্যি চুপ করে গেল। রেন্টুরেন্টেও তেমন কিছু বলল না। মইন হড়বড় করে অনেক কথা বলে যেতে লাগল। মীরার কেন জানি মনে হয়েছিল। মইনের গল্প এখন আর তাকে আকর্ষণ করবে না। দেখা গেল-তা নয়। এগার বছর পরেও মইনের গল্প শুনতে তার ভালো লাগছে। শুধু ভালো না, অসম্ভব ভালো লাগছে। তার কারণ কী? বালিকা বয়সের তীব্র আবেগের স্মৃতির কারণে? এই আবেগের একটি অংশ কি এখনাে রয়ে গেছে?

    বুঝলে মীরা, যদিও তুমি আমাকে আধঘণ্টা আগে বোকা বলেছ-আমি বোকা নাই। কারণ আমি যুক্তি দিয়ে চারপাশের জগৎ বুঝতে চেষ্টা করি। একজন বোকা তা পারে না। আমি যদি আবেগ দিয়ে সবকিছু বিচার করতাম তাহলে হয়তো এগার বছর আগে তোমাকে বিয়ে করতাম। তার ফল খুব শুভ হত না। আমরা কমপেটেবল না। তেল এবং জলের মতো ঝাঁকিয়ে মেশানো যায়। কিছুক্ষণ রাখলেই আলাদা হয়ে যায়।

    আমি অনেক ভেবেচিন্তে এক আমেরিকান তরুণীকে বিয়ে করেছি। আমেরিকান তরুণীরা এশিয়ান পুরুষদের প্রতি এক ধরনের আকর্ষণ অনুভব করে। কারণ তারা জানে এশিয়ানরা বিবাহবিচ্ছেদ জিনিসটা খারাপ চোখে দেখে। সহজে বিবাহবিচ্ছেদে যেতে চায় না। আমেরিকান তরুণীরা সঙ্গত কারণেই স্থায়ী সম্পর্কে যেতে চায়।

    আমার স্ত্রী মিশেলের হোিমটাউন হচ্ছে-নিউ অরলিন্স। বাবা কোটিপতি। ফার্মিং করে মিলিওনিয়ার হয়েছে। তার বিপুল অর্থের একটা অংশ আমার স্ত্রী পাবে। বিয়ের সময় এটিও আমার হিসেবে ছিল।

    ধনী স্ত্রীর দোষ-ত্রুটি অনেকাংশে ক্ষমা করার জন্যে আমি প্ৰস্তৃত ছিলাম। অবাক হয়ে দেখলাম, দোষক্ৰটি তার কিছুই নেই। চমৎকার একটি মেয়ে, A lowing and caring wife. এখন আমার তিনটি বাচ্চা। মিশেল তার বাচ্চাগুলোকে পাগলের মতো ভালবাসে। আমাকে দেবতা মনে না করলেও দেবতার কাছাকাছি মনে করে এবং আমাকে খুশি করার জন্যে যা করে তাকেও পাগলামির পর্যায়ে ফেলা চলে। একটা উদাহরণ তোমাকে দেই। তোমার বোরিং লাগছে না তো মীরা?

    না, বোরিং লাগছে না। ঝগড়াঝাটির গল্প হলে বোরিং লাগত।

    একবার মিশেল বলল, তোমার আসছে জন্মদিনে তোমাকে আমি চমৎকার একটা উপহার দেব। এত চমৎকার যে তুমি মুগ্ধ হয়ে যাবে। আমি বললাম খুব এক্সপেনসিভ গিফট? সে বলল, মোটেই এক্সপেনসিভ নয়-তবে অসাধারণ। আমি আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছি। জন্মদিন এসে গেল। মিশেল বলল, তোমার জন্মদিনের উপহার হলো, আমি এখন বাংলায় কথা বলতে, পড়তে এবং লিখতে পারি। তোমাকে খুশি করার জন্যে আমি একটি বাঙালি পরিবারের কাছে গত আট মাস ধরে বাংলা শিখছি। তুমি এখন বাংলায় আমার সঙ্গে কথা বলতে পার। এই বলেই সে পরিষ্কার বাংলায় বলল-মইন, আমি ভালবাসি, তোমাকে। অল্প নয়। বেশি পরিমাণে ভালবাসি।

    মীরা হেসে ফেলল। হাসতে হাসতে বলল, আপনি ভাগ্যবান পুরুষ মইন ভাই। আপনার স্ত্রীর ছবি কি আপনার কাছে আছে? একটু দেখান না।

    মিশেলের ছবি আমার কাছে নেই। থাকলে দেখাতাম। She is quite pretty. তুমি তো কিছুই খাও নি মীরা!

    কেন জানি খেতে ভালো লাগছে না।

    তুমি খুব ডিসটার্বড?

    না।

    তোমার বড়ভাই বলছিলেন তুমি নাকি খুব ব্যস্ত হয়ে চাকরি খুঁজছ?

    হ্যাঁ খুঁজছি।

    আমি যদি তোমার জন্যে একটা চাকরি জোগাড় করে দেই তাহলে কেমন হয়?

    ভালেই হয়।

    সব মিলিয়ে সাত থেকে সাড়ে সাত হাজার পাবে।

    অনেক টাকা।

    বড় একটা কোম্পানির পিআরও-জনসংযোগ। এইসব কাজ মেয়েরা খুব ভালো পারে।

    আমিও ভালোই পারব। চলুন আজ তাহলে উঠি?

    আরেকটু বস। আইসক্রিম খাও। আইসক্রিম খাবে?

    না।

    আমি তোমাকে ছোটখাটাে একটা সারপ্রাইজ দেবার ব্যবস্থা করেছি। অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটারটি আমি সঙ্গে করে নিয়ে এসেছি। তুমি টার্মস এন্ড কন্ডিশন্‌স্‌ দেখো।

    মীরা খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই চিঠিটা নিল। দ্রুত চােখ বুলিয়ে দেখল। রেখে দিল তার হ্যান্ডব্যাগে। হালকা গলায় বলল, থ্যাংক ইউ।। থ্যাংক ইউ ভেরি মাচ।

    মইন নিচু গলায় বলল, তোমার বিষয়ে আমার মনে বড় ধরনের অপরাধবোধ আছে। তোমার জন্যে সামান্য কিছু করতে চাচ্ছি। অপরাধবোধ খানিকটা হলেও কমানোর জন্যে।

    মীরা শীতল গলায় বলল, অপরাধবোধ কেন?

    মইন চুপ করে রইল।

    মীরা আবার বলল, অপরাধবোধ কী জন্যে পরিষ্কার করে বলুন।

    থাক বাদ দাও। চল ওঠা যাক।

    মীরা উঠল না। চেয়ারে বসেই রইল। তার চোখ ছোট হয়ে এসেছে। ভুরুর কাছে ঈষৎ ঘাম। হাতের পাতলা আঙুলগুলো অল্প অল্প কাঁপছে। এগার বছর আগের এক দুপুরে এই পৃথিবী হঠাৎ তার কাছে অসহ্য বােধ হয়েছিল। হঠাৎ তার মনে হয়েছিল সে মারা যাচ্ছে। এক ধরনের অদ্ভুত কষ্ট, অদ্ভুত আনন্দ। সে চুপি চুপি তাদের কলাবাগানে ফ্ল্যাটের তিনতলায় উঠে গেল। সেই ফ্ল্যাটের দরজা সব সময়ই খোলা থাকে। মীরা ঘরে ঢুকে দেখল, ঠাণ্ডা মেঝেতে আঁচল বিছিয়ে মইন ভাইয়ের মা শুয়ে আছেন। মীরাকে ঢুকতে দেখে বললেন, আয় মা আয়। কী গরম পড়েছে দেখেছিস। শরীরের সব চর্বি ঘাম হয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে।

    মীরা কোনোমতে বলল, মইন ভাই কোথায় খালা?

    তিনি ঘুমজড়ানো গলায় বললেন, আছে বোধহয় তার ঘরে। ঠাণ্ডা পানি চাচ্ছিল। মা, ফ্রিজ থেকে একটা পানির বোতল দিয়ে আয় তো।

    মীরা পানির বোতল ছাড়াই ঘরে ঢুকেছিল।

    সেই নির্জন ঘুমকাতর দুপুর। বারান্দায় রেলিঙে কা-কা করে একঘেয়ে স্বরে কাক ডাকছে। মাথার উপর কর্কশ শব্দে ঘুরছে ফ্যান। মইন ভাই উবু হয়ে কী যেন লিখছেন। আইন ভাই পায়ের শব্দে ঘুরে তাকিয়ে বললেন, হােয়াট এ সারগ্রাইজ! কী ব্যাপার মীরা!

    মীরা কোনাে মতে চাপা গলায় বলল, আপনাকে দেখতে এসেছি।

    এগার বছর আগে ঐ ঘরে যা ঘটেছিল তার জন্যে মীরার মনে কোনাে অপরাধবােধ নেই। সে অনেকবার ভেবেছে। নানাভাবে ভেবেছে। প্রতিবারই মনে হয়েছে–তাকে যদি আবার এই জীবন নতুন করে শুরু করার সুযোগ দেয়া হয় সে এই ভুল আবারো করবে। আগ্রহ ও আনন্দ নিয়েই করবে।

    মীরা বাসায় ফিরল সন্ধ্যায়।

    মীরার ভাবি বললেন, জাহানারা নামে একটা মেয়ে টেলিফোন করেছিল। বলল, মনজুর খুব অসুস্থ। হাসপাতালে আছে।

    মীরা বলল, ও আচ্ছা।

    দেখতে যেতে চাও?

    আজ আর যাব না। প্ৰচণ্ড মাথা ধরেছে।

    জাহানারা মেয়েটা কে? তিন বার টেলিফোন করেছে।

    ওর অফিসে কাজ করে–টাইপিষ্ট।

    বলেছে রাত আটটার পর আবার টেলিফোন করবে।

    আমাকে চাইলে বলবে। আমি বাসায় নেই।

    মীরা তার ঘরে ঢুকে সুইচে হাত দিয়ে শক খেল।

    সুইচ ঠিক করা হয় নি। গত দুদিন ধরে তার ঘরের সুইচ নষ্ট। বাতি জ্বলছে না। দিনের বেলা সমস্যা হয় না। রাতে অন্ধকার ঘরে ঢুকতে হয়। মশারি ফেলতে হয় অন্ধকারে। দরজা-জানালা বন্ধ করে বিছানায় ওঠার পর চারপাশের অন্ধকার ভয়াবহ লাগে। এক বিন্দু আলোর জন্যে প্ৰাণ ছটফট করতে থাকে। এই অবস্থা থেকে মুক্তির একমাত্র পথ হচ্ছে চোখ বন্ধ করে কল্পনায় আলো-ঝলমল দিন দেখা। ভাগ্যিস কল্পনা করার এমন অসাধারণ ক্ষমতা দিয়ে মানুষকে পাঠানো হয়েছিল।

    মীরা।

    মীরা চমকে পেছনে তাকাল। অন্ধকারে মানুষ খুব সহজেই চমকায়। তা ছাড়া কাপড়ের অদ্ভুত এক জোড়া স্যান্ডেল পরে জালালউদ্দিন আজকাল নিঃশব্দে হাঁটা শুরু কুবুন্টু, আচমকা উপস্থিত হন, চিকন গলায় মীরা বলে এমনভাবে ডাকেন যে কেঁপে উঠতে হয়।

    তোর ঘরের সুইচ আজো ঠিক করা হয় নি। দোষ আমার। আমি ইলেকট্রশিয়ানকে খবর দিতে ভুলে গেছি।

    মীরা বলল, নো প্রবলেম।

    একটা টেবিল ল্যাম্প লাগিয়ে দিয়ে গেছি। দেখ তো জুলে কিনা।

    টেবিল ল্যাম্প জ্বলে কিনা তা দেখার জন্যে এত রাতে ভাইয়া তার ঘরে আসবে এটা মীরা আশা করে না। নিশ্চয়ই কিছু বলার আছে। এমন কোনো বিষয় যা সহজভাবে বলা যায় না। যার জন্যে অজুহাত তৈরি করে ঘরে আসতে হয়।

    মীরা, ল্যাম্পটা কি জ্বলছে? এটার সুইচটাও খারাপ, খুব জোরে চাপ দে। জ্বলছে?

    হুঁ। ভাইয়া এস ঘরে এস।

    জালালউদ্দিন বললেন, রাত সাড়ে দশটা বাজে–এখন তোর ঘরে ঢুকে কী করব। তুই ঘুমাতে যা। আমিও ঘুমােব।

    তোমার যদি কিছু বলার থাকে বল।

    জালালউদ্দিন বিস্মিত হয়ে বললেন, আমার আবার কী বলার থাকবে? তুই কি কিছু বলতে চাস?

    না।

    তাহলে ঘুমিয়ে পড়। ও আরেকটা কথা, চাকরির জন্যে তোর ছােটাছুটি করার কোনো দরকার নেই। মাসে মাসে তোকে যে হাতখরচ দেই সেটা সামনের মাস থেকে ডাবল করে দেব।

    কোনো দরকার নেই ভাইয়া। চাকরি একটা পেয়েছি।

    সে কী!

    তোমাকে বলেছিলাম না, একজন স্মার্ট এবং ইন্টেলিজেন্ট তরুণীর চাকরি পাওয়া খুবই সহজ।

    বেতন কত?

    বেতন কত–কী চাকরি, সবই বলব, আগে জয়েন করে নেই। তোমার পিঠের ব্যথার অবস্থা কী?

    ব্যথা এখন নেই। স্ট্রেঞ্জ ব্যাপার কি জানিস, ব্যথাটা দিনে থাকে–রাতে থাকে না। তুই তো সব কিছুতেই একটা যুক্তি দাঁড় করিয়ে ফেলিস, এই ব্যাপারে তোর যুক্তি কী?

    কোনো যুক্তি নেই। তুমি ঘুমাতে যাও। আমার খুব ঘুম পাচ্ছে। তবে তোমার যদি বিশেষ কিছু বলার থাকে তাহলে ভেতরে আসা। আমার ধারণা তুমি কিছু বলতে চাও। আমার ঘরের টেবিল ল্যাম্পটা জ্বলে কিনা সেই খোজে তুমি আসবে এটা বিশ্বাসযোগ্য নয়।

    জালালউদ্দিন বিরক্ত গলায় বললেন, তোর সবচে’ বড় সমস্যা কি জানিস? সবচে’ বড় সমস্যা হচ্ছে তোর ধারণা তুই সবকিছু বুঝে ফেলিস। যেখানে বোঝার কিছু নেই সেখানেও তুই A থেকে Z পর্যন্ত বুঝে ফেলেছিস।

    রাগ করছে কেন?

    রাগ করছি না। সত্যি সত্যি টেবিল ল্যাম্প জ্বলে কিনা দেখতে এসেছিলাম, তুই তাও একটা ব্যাখ্যা দাড় করিয়ে ফেললি!

    তুমি যে প্রচণ্ড রাগ করছ তা থেকেই প্রমাণিত হচ্ছে যে আমার ব্যাখ্যা ঠিক আছ। ব্যাখ্যা ভুল হলে মোটেই রাগ করতে না।

    তুই তোর ব্যাখ্যা নিয়ে থাক। আমি ঘুমাতে যাচ্ছি।

    যে কাপড়ের স্যান্ডেলে তিনি নিঃশব্দে হাঁটেন। সেই স্যান্ডেলেই তিনি শব্দ করে হেঁটে নিজের শোবার ঘরের দিকে রওনা হলেন। রাগে তাঁর গা জুলে যাচ্ছে, কারণ মীরার কথা সত্যি। তিনি আসলেই মীরার সঙ্গে জরুরি কিছু বিষয় নিয়ে আলাপ করতে এসেছিলেন।

    তিনি বলতে এসেছিলেন মীরা যেন মনজুরের সঙ্গে দেখা করার জন্যে হাসপাতালে না যায়। অসুখ অবস্থায় মানুষের মাথা ঠিক থাকে না। মনজুরেরও মাথার ঠিক নেই। সে আবোল-তাবোল অনেক কিছু বলে ফেলতে পারে। এইসব শুনে মীরার যদি মনে হয়—ডিভোর্স নেয়া ঠিক হয় নি। তাহলেই সর্বনাশ। সম্পর্ক ছেদের পরের এক মাস খুবই সর্বনেশে মাস। এই এক মাস কেটে যাওয়া সম্পর্কের জন্যে মন হা-হা করতে থাকে। তিনি নিজের চােখে বন্ধু ফজলুকে দেখেছেন। স্বামী-স্ত্রীতে দিনরাত ঝগড়া, কিছুতেই বনিবনা হয় না। ফজলু উত্তরে গেলে তার স্ত্রী যায় দক্ষিণে। ফজলু যদি কোনো ব্যাপারে ‘হ্যাঁ’ বলে তার স্ত্রী সঙ্গে সঙ্গে পরপর তিন বার বলবে ‘না’। এক সময় ফজলু বলল, তোমার সঙ্গে বাস করা সম্ভব হচ্ছে না। এই এক বারই দেখা গেল তার স্ত্রীরও একই অভিমত। ডিভোর্স হয়ে গেল। ফজলু হাসতে হাসতে জালালউদ্দিনকে বলল, ভাই বঁচেলাম। জীবন প্রায় যেতে বসেছিল। এখন নিজেকে মনে হচ্ছে মুক্ত বিহঙ্গের মতো।

    সেই মুক্ত বিহঙ্গকে দেখা গেল ডিভোর্সের দশদিন পর তার স্ত্রীর বাবার বাড়ির সামনের রাস্তায় সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত হাঁটাহাঁটি করে। মাথার চুল এলোমেলো, উদভ্ৰান্ত দৃষ্টি। হাতে সিগারেটের প্যাকেট। একটার পর একটা সিগারেট ধরাচ্ছে, কয়েকটা টান দিয়েই ফেলে দিচ্ছে।

    দ্বিতীয় দিনেও একই অবস্থা। তার স্ত্রী ঘর থেকে বের হয়ে এল এবং কঠিন গলায় বলল, কী চাও তুমি? ফজলু কাঁদো-কাঁদো গলায় বলল, বাসায় চল।

    বাসায় যাব মানে? কী বলছি তুমি?

    ফজলু আবারো বলল, বাসায় চল।

    তোমার মাথা আগেই খারাপ ছিল, এখন তো মনে হয় আরো খারাপ হয়েছে। বাসায় কী করে যাব? পাগলের মতো কথা বলছি কেন?

    ফজলু একটা রিকশা দাঁড় করাল এবং তৃতীয়বার বলল, বাসায় চল।

    তার স্ত্রী দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বলল, শাড়িটা বদলে আসি। এই শাড়ি পরে যাব নাকি?

    এখনো তারা এক সঙ্গেই আছে। দুটি বাচ্চা হয়েছে। মনের মিলের ছিটেফোটাও নেই। ঝগড়াঝাটি দশগুণ বেড়েছে। তা নিয়ে ফজলুর মাথাব্যথা নেই। জালালউদিনের ধারণা, মীরার ব্যাপারেও তাই হবে। যদিও মীরা আর দশটা মেয়ের মতো না। বেশ খানিকটা অন্য রকম, তবু শেষ পর্যন্ত তাই হবে। বিছানায় শুয়ে কাতরাতে কাতরাতে মনজুর কিছু একটা বলতেই মীরার চোখে পানি এসে যাবে। সে আর হাসপাতাল থেকে নড়বে না। সেটা একটা ভয়াবহ ব্যাপার হবে।

    তিনি একেবারে গোড়া থেকেই এই ছেলেটাকে বিয়ে না করার জন্যে মীরাকে বলেছিলেন। মীরা তার কথা শোনে নি। কোনোরকম যুক্তিতে কান দেয় নি। আজ তার ফল মীরা কি হাতে হাতে দেখছে না? বেশি বুঝলে তার ফল। এই হয়। জালালউদিনের মতিঝিলের অফিসে একদিন মীরা এসে উপস্থিত। তিনি বললেন, ব্যাপার কী রে?

    মীরা বলল, তুমি কি খুব ব্যস্ত?

    ব্যস্ত তো বটেই। তুই চাস কী?

    পনের মিনিট তোমার সঙ্গে কথা বলব।

    জরুরি কিছু?

    অবশ্যই জরুরি। বিয়ে করব বলে ঠিক করেছি।

    জালালউদ্দিন অসম্ভব খুশি হলেন। হাসতে হাসতে বললেন, প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ হলো? চিরকুমারী থাকব, নিজের মতো থাকব ঐ পোকাগুলো মাথা থেকে নেমেছে?

    হ্যাঁ নেমেছে।

    ছেলেটা কে? আমি চিনি?

    না তুমি চেন না–আমি নিজেও চিনি না।

    আমি নিজেও চিনি না মানে? তোর সঙ্গে পরিচয় নেই?

    পরিচয় আছে। পরিচয় থাকলেও তো সবাইকে চেনা যায় না। ও এই রকম।

    ছেলেটা সম্পর্কে বল তো শুনি।

    নাম হচ্ছে মনজুর।

    নাম যাই হােক-ছেলেটা কী। কী করে? পড়াশোনা কী?

    মোটামুটি ধরনের একটা চাকরি করে-প্রাইভেট ফার্মে। পড়াশুনো কী জিজ্ঞেস করি নি। বি.এ. পাস নিশ্চয়ই।

    পরিচয় কত দিনের?

    খুব বেশি হলে দুমাস।

    ফ্যামিলির অবস্থা কী?

    ফ্যামিলিই নেই–আর ফ্যামিলির অবস্থা।

    ফ্যামিলি নেই মানে?

    বাবা-মা ভাই-বোন কিছুই নেই। মা মারা গেছেন দুবছর বয়সে, বাবা ষোল বছর বয়সে।

    সে-কী!

    মীরা খুব শান্ত গলায় বলল, এই ব্যাপারটাই আমাকে খুব আকর্ষণ করেছে। ভালবাসাহীন পৃথিবীতে সে মানুষ হয়েছে। অতি প্রিয়জন সে কাউকে কখনাে পায় নি। এই প্রথম পাবে। প্রবল আবেগ ও ভালোবাসায় সে বাকি জীবনটা আচ্ছন্ন থাকবে।

    জালালউদ্দিন ভুরু কুঁচকে বললেন, উল্টোটাও তো হতে পারে- ভালোবাসা কী এই ছেলে জানেই না। ভালোবাসবে কী?

    না জানলে তো ভাইয়া আরো ভালো। আমি তাকে ভালোবাসা শেখাব ৷

    জালালউদ্দিন চিন্তিত মুখে বললেন, তোর ব্যাপার কোনোটাই আমার কখনো পছন্দ হয় নি; এটিও হচ্ছে না। আরো ভালোমতো আলোচনা করব। তুই চা খাবি?

    খাব। চা খেতে খেতে তুমি কি ছেলেটির সঙ্গে কথা বলবে? ওকে নিয়ে এসেছি।

    নিয়ে এসেছিস!

    হুঁ। বারান্দায় দাঁড় করিয়ে রেখেছি। ঠিক করে রেখেছি চা খাবার সময় তাকে ডাকব। চা খাওয়া শেষ হওয়ামাত্র বিদায় করে দেব। তোমার সঙ্গে আরো খানিকক্ষণ কথা বলব। তুমি ছেলেটিকে দেখার পর কী মনে করছ তা শুনব।

    দেখার আগেই বলছি আমার পছন্দ না।

    মীরা মানিব্যাগ থেকে মুখ-বন্ধ একটা খাম বের করে ভাইয়ের হাতে দিয়ে হালকা গলায় বলল, ছেলেটিকে দেখার পর তার সঙ্গে কথা বলার পর তুমি যা বলবে তা আমি লিখে এনেছি। তুমি দেখবে কেমন অক্ষরে অক্ষরে মিলে যায়। খামটা এখন খুলবে না ভাইয়া।

    জালালউদ্দিন খাম হাতে বসে রইলেন। মীরা বারান্দা থেকে মনজুরকে নিয়ে এল। তিনি ছেলেটির মধ্যে এমন কিছুই পেলেন না। যা দেখে খুব উৎসাহিত বোধ করা যায়। গায়ে চকলেট রঙের হাফ হাওয়াই শার্ট, ধবধবে সাদা প্যান্টের উপর ভালোই দেখাচ্ছে। চুল আঁচড়ানো, চেহারা মোটামুটি। চােখ-মুখে এক ধরনের অনাগ্রহ যা এই বয়সী। ছেলেদের মধ্যে তেমন দেখা যায় না।

    জালালউদ্দিন লক্ষ করলেন, ছেলেটি তাকে ঠিক পাত্তা দিচ্ছে না। ইচ্ছাকৃতভাবে সে যে তা করছে তা হয়তো না। তার স্বভাবই হয়তো এরকম। তিনি বসতে বলার আগেই সে চেয়ার টেনে বসল।

    তিনি যখন বললেন, চা, না কফি?

    সে বলল, কিছু খেতে ইচ্ছা করছে না।

    জালালউদ্দিন সিগারেট বের করে বললেন, চলবে?

    সে কোনো কথা না বলে সিগারেট নিল। যে মেয়েটিকে সে বিয়ে করতে যাচ্ছে তার ভাইয়ের কাছ থেকে এরকম সহজভাবে সিগারেট নেয়া যায় না। সামাজিক কিছু ব্যাপার আছে।

    মীরা বলল, ভাইয়া এর নাম মনজুর।

    তিনি শুকনো গলায় বললেন, শুধু মনজুর? আগে-পেছনে কিছু নেই? আহম্মদ বা মোহাম্মদ?

    মনজুর বলল, জ্বি না।

    সে-কী!

    মনজুর বলল, বাবা ডাকনাম রাখার সুযোগ পেয়েছিলেন, ভালো নাম রাখার সুযোগ পান নি। আমার ডাকনাম মঞ্জু। স্কুলের খাতাতে আমার নাম ছিল মঞ্জু। এসএসসি পরীক্ষার রেজিস্ট্রেশনের সময় হেড স্যার বললেন, মঞ্জু নাম তো দেয়া যায় না; এটাকে মনজুর করে দেই। মনজুর হােসেন। হােসেন আমার খুবই অপছন্দ। কিন্তু তা বলতে পারলাম না। কারণ হেড স্যারকে খুব ভয় পেতাম।

    তাহলে তো আপনার নাম মনজুর হােসেন। মনজুর বলছেন কেন?

    এডমিট কার্ড যখন আসল তখন দেখা গেল হেড স্যার আমার নামের শেষে হােসেন দিতে ভুলে গেছেন। আমার আগে যে ছিল, জহির আহাম্মদ, তার নামের শেষে হােসেন লাগিয়ে দিয়েছেন। সেই বেচারার নাম এখন জহির আহাম্মদ হােসেন।

    জালালউদ্দিন ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে রইলেন। গল্পটা তাঁর খুব বিশ্বাসযোগ্য মনে হলো না।

    একদল মানুষ আছে যাদের ভাণ্ডারে এরকম গোটা পাঁচেক গল্প থাকে। গল্পগুলো বলে তারা প্রথম আলাপে লোকজনদের মুগ্ধ করে। সবাই ভাবে বাহু বেশ, এই লোকটা রসিক তো। কিন্তু রস যে এই পাঁচটিতেই সীমাবদ্ধ তা তারা জানতে পারে না।

    তাঁর মনে হলো–ছেলেটা কথাও বেশি বলে। নাম জিজ্ঞেস করলে যে লম্বা গল্প ফেঁদে বসে, সে তো সারাক্ষণই বকবক করবে। শেষ পর্যন্ত মীরা এমন একজনকে পছন্দ করল! আশ্চর্য! জালালউদিনের ইচ্ছা ছিল আরো দুএকটা কথা জিজ্ঞেস করার–যেমন, বাড়ি কোথায়, পড়াশোনা কী পরিমাণ করেছেন; কিন্তু এখন আর আগ্রহ বোধ করছেন না।

    মীরা বলল, আচ্ছা তুমি এখন যাও। ভাইয়ার সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে। আগামীকাল এগারটার দিকে তোমার অফিসে যাব।

    মনজুর চলে গেল। যাবার আগে সাধারণ ভদ্রতার ‘স্নামালিকুম’ বলার কথাও তার মনে হলো না। জালালউদিনের মনটাই কালো হয়ে গেল। তিনি দুঃখিত হয়ে ভাবলেনএই ছেলে? শেষ পর্যন্ত এই ছেলে?

    মীরা বলল, ভাইয়া এখন তোমার মতামত বল। তোমার মতামত আমার কাগজের লেখার সঙ্গে মিলিয়ে দেখব।

    জালালউদ্দিন বললেন, তোর পছন্দ হয়েছে তুই বিয়ে কর, অসুবিধা কী। এটা তোর ব্যাপার। আমার তো কিছু না।

    মীরা হাসতে হাসতে বলল, তুমি এটা বলছো যাতে কাগজের লেখার সাথে তোমার কথা না মেলে। তুমি ইচ্ছা করেই উল্টো কথা বলছি। তাই না?

    জালালউদ্দিন বিরক্ত হলেও স্বীকার করতে বাধ্য হলেন–মীরার কথা সত্যি। মীরা বলল, উঠি ভাইয়া। পরে তোমার সঙ্গে কথা হবে। মীরা ঘর থেকে বের হয়ে যাবার পর জালালউদ্দিন খাম খুললেন। মীরা গোটা গোটা করে লিখেছে–

    “ভাইয়া, তুমি মত দেবে। তুমি বলবে-হ্যাঁ।
    তুমি তোমার ইচ্ছার বিরুদ্ধেই বলবে। দেখলে
    আমার কেমন বুদ্ধি? এরকম একজন বুদ্ধিমতী
    মেয়ে কখনো ভুল করবে না। আমি যা করছি
    ঠিকই করছি। তুমি ভয় পেয়ে না। ছেলেটা ভালো।”

    বুদ্ধিমতী মেয়ে ভুল করে না তার নমুনা এখন দেখা যাচ্ছে। তিন বছরের মাথায় তাকে স্বামীর কাছ থেকে আলাদা হতে হয়েছে।

    Share. Facebook Twitter LinkedIn Email Telegram WhatsApp Copy Link

    সম্পর্কিত সংবাদ

    সাহিত্য

    শুভ জন্মদিন নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ

    November 13, 2025
    সাহিত্য

    ডাকটিকিটে ফুটে উঠেছে হারানো যুগের গল্প

    October 10, 2025
    ফিচার

    পবিত্র রমজানের সম্ভাব্য তারিখ জানাল জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা

    October 4, 2025
    Leave A Reply Cancel Reply

    সর্বাধিক পঠিত

    সাউথইস্ট ব্যাংকে ২৫ কোটি টাকা আত্মসাত

    আইন আদালত October 7, 2025

    ক্রেতারা ভারত-চীন ছাড়ছে, বাংলাদেশ পাচ্ছে অর্ডার

    অর্থনীতি August 15, 2025

    সব ব্যবসায়ী ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপী নয়

    মতামত January 13, 2025

    বরিশালের উন্নয়ন বঞ্চনা: শিল্প, যোগাযোগ, স্বাস্থ্য ও পর্যটন খাতে নেই অগ্রগতি

    মতামত April 22, 2025
    সংযুক্ত থাকুন
    • Facebook
    • Twitter
    • Instagram
    • YouTube
    • Telegram

    EMAIL US

    contact@citizensvoicebd.com

    FOLLOW US

    Facebook YouTube X (Twitter) LinkedIn
    • About Us
    • Contact Us
    • Terms & Conditions
    • Comment Policy
    • Advertisement
    • About Us
    • Contact Us
    • Terms & Conditions
    • Comment Policy
    • Advertisement

    WhatsAppp

    01339-517418

    Copyright © 2025 Citizens Voice All rights reserved

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.