সাহিত্য (Literature) কে বলা হয় মানব ও সমাজ জীবনের দর্পণ বা প্রতিচ্ছবি। মানবজীবনের বিভিন্ন দিক নিয়ে সাহিত্যের বিকাশ ঘটে। সাহিত্যে মানব মনের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা এবং মানবজীবনের শাশ্বত ও চিরন্তন অনুভূতি প্রতিফলিত হয়।
ইংরেজি Literature শব্দটির প্রতিশব্দ হিসেবে আমরা ‘সাহিত্য’ শব্দটি ব্যবহার করে থাকি। তবে Literature বলতে ব্যাপক অর্থে যাবতীয় লিখিত ও মুদ্রিত গ্রন্থ বা রচনাকে বোঝানো হয়, যার মধ্যে রেলগাইড, রান্নার বই, পঞ্জিকা, আইনগ্রন্থ কিংবা ওষুধের নির্দেশিকাও অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। কিন্তু ‘সাহিত্য’ প্রকৃত অর্থে এসবের মতো নয়।
‘সাহিত্য’ বলতে আমরা সেইসব রচনাকেই স্বীকৃতি দেই, যা জীবন প্রবাহের বিচিত্র ও জটিল অভিজ্ঞতাসমূহকে মন্থন করে একটি ‘বিশেষ সৃজন’ রূপে প্রকাশ করে। সর্বব্যাপী Literature শব্দ থেকে সৃজনী-সাহিত্যকে আলাদা করতে T.S. Eliot- Autoletic শব্দটি ব্যবহার করেন, যা বোঝায় সাহিত্যের একটি নির্মাণ বৃত্তান্ত—যেখানে সাহিত্য ভাব, ভাষা ও রূপের সংমিশ্রণে নিজস্ব অস্তিত্ব লাভ করে।
মার্কিন কবি আর্চিবল্ড ম্যাকলিশ বলেছেন—A poem should not mean but be. প্রকৃত সাহিত্যের জন্ম তখনই, যখন ভাষার সৌন্দর্য ও আবেগের ক্রিয়াশীলতা শব্দের আশ্রয়ে রূপ লাভ করে। ‘সাহিত্য’ শব্দটি বাংলা ‘সহিত’ শব্দ থেকে উদ্ভূত, যার অর্থ সংযুক্তি, সমন্বয়, মিলন বা যোগ। আভিধানিকভাবে ‘সাহিত্য’ শব্দের অর্থ—জ্ঞানগর্ভ বা শিক্ষামূলক গ্রন্থ, আবার কাব্য-উপন্যাসাদি রসাত্মক রচনা, যেখানে এক হৃদয়ের সঙ্গে অন্য হৃদয়ের মিলন ঘটে। লেখক ভাষার মায়াজাল বিস্তারের মাধ্যমে পাঠকের সঙ্গে সাহিত্যিক চরিত্রের সুখ-দুঃখময় জীবনের সংযোগ ঘটান, যার ফলে সাহিত্যের এমন নামকরণ হয়েছে।
প্রাচ্যের সাহিত্য সমালোচক শ্রীশচন্দ্র দাস তাঁর ‘সাহিত্য সন্দর্শন’ গ্রন্থে বলেছেন—নিজের কথা- পরের কথা বা বাহ্য-জগতের কথা সাহিত্যিকের মনোবীণায় যে সুরে ঝংকৃত হয়, তাহার শিল্পসংগত প্রকাশই সাহিত্য।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সাহিত্যের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে বলেছেন— অন্তরের জিনিসকে বাহিরের, ভাবের জিনিসকে ভাষার, নিজের জিনিসকে বিশ্বমানবের এবং ক্ষণকালের জিনিসকে চিরকালের করিয়া তোলাই সাহিত্যের কাজ।
সাহিত্যের পরিধি ব্যাপক। মানুষের কল্যাণের জন্য উচ্চারিত প্রতিটি বাণীই সাহিত্য হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। তাই ডা. লুৎফর রহমান বলেছেন— জীবনের কল্যাণের জন্য, মানুষের সুখের জন্য এ জগতে যিনি যত কথা বলিয়া থাকেন, তাহাই সাহিত্য।
সাহিত্যের আদি শব্দশিল্প হলো কবিতা। মানব সমাজ ও সভ্যতার বিবর্তনের ধারায় কবিতার পর নাটক, উপন্যাস, ছোটগল্প, প্রবন্ধ, নিবন্ধ, ভ্রমণসাহিত্য ও রম্যরচনার মতো বিভিন্ন সাহিত্য-আঙ্গিক সৃষ্টি হয়েছে। সাহিত্য সৃষ্টির এ প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। তবে প্রকৃত ও জীবন-অভিজ্ঞতালব্ধ সুসাহিত্যের বিকাশ কাম্য, যাতে অপসাহিত্য বা বাণিজ্যিক সাহিত্য থেকে সাহিত্যকে রক্ষা করা যায় এবং সাহিত্যপ্রেমীদের চিত্তের পরিতৃপ্তি সম্ভব হয়।