বিন্দুর ছেলে প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯১৩ সালে, শরৎচন্দ্রের লেখকজীবনের শুরুর দিকেই। উপন্যাসটি তাঁর সমাজ-সংবেদী দৃষ্টিভঙ্গির শক্তিশালী প্রতিফলন এবং সে সময়কার নারীর অবস্থান, সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি ও মাতৃত্বের মর্যাদা নিয়ে এক গভীর বিশ্লেষণ।
গল্প সংক্ষেপ:
“বিন্দুর ছেলে” শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের একটি মর্মস্পর্শী উপন্যাস, যেখানে তিনি এক নিঃস্ব, অবহেলিত, অথচ অসাধারণ আত্মমর্যাদাপূর্ণ নারীর চরিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন। এই উপন্যাসের কেন্দ্রে রয়েছে বিন্দু, এক দুঃখিনী নারী, যার জীবন বারবার বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়, কিন্তু ভালোবাসা, মাতৃত্ব ও আত্মত্যাগের শক্তিতে সে হয়ে ওঠে অসাধারণ।
উপন্যাসের প্রেক্ষাপট ও শুরু:
বিন্দু একজন অনাথ মেয়ে, যিনি মামার বাড়িতে বড় হন। ছোটবেলা থেকেই অপমান, অবজ্ঞা, অবহেলার মধ্যে বেড়ে ওঠা বিন্দুর জীবন ছিল কঠিন এবং দুঃখে ভরা। আত্মীয়-স্বজনেরা তাকে সবসময় সন্দেহের চোখে দেখত, যেন সে সমাজের বোঝা।
বয়ঃসন্ধিকালে এসে তার জীবনে আসে শচীন্দ্রনাথ নামের এক যুবক। প্রেম, দয়া ও সহানুভূতির সম্পর্ক থেকে তারা বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়। কিন্তু বিয়ের পরপরই নানা ভুল বোঝাবুঝি ও পারিবারিক জটিলতায় তাদের সম্পর্কের অবনতি ঘটে। একসময় শচীন্দ্র বিন্দুকে ছেড়ে চলে যায়, এবং সমাজের চোখে বিন্দু হয়ে পড়ে এক পরিত্যক্তা নারী।
সন্তান ও সমাজের প্রতিক্রিয়া:
বিন্দু একা হয়ে পড়ে- কোনো সামাজিক সম্মান নেই, আশ্রয় নেই, পাশে কেউ নেই। তখনই তার জীবনে আসে এক নতুন মোড়- সে একজন পুত্রসন্তানের জন্ম দেয়। এই সন্তান সমাজের চোখে অবৈধ। সমাজ বিন্দুকে বিচার করে, আঙুল তোলে, অপমান করে। কিন্তু বিন্দু দমে না। সে তার সন্তানকে আঁকড়ে ধরে নতুন করে বাঁচার শক্তি খুঁজে পায়।
তার চোখে এই ছেলেই তার জীবনের পূর্ণতা, তার শেষ অবলম্বন। সে সমস্ত কষ্ট, দুঃখ, অপমান সয়ে যায় শুধু তার সন্তানের মুখের হাসি দেখার আশায়। সমাজ যখন তার দিকে তিরস্কারের চোখে তাকায়, তখন সে নিজের মমতায় সন্তানকে মানুষ করার ব্রত নেয়।
নারীর আত্মত্যাগ ও মাতৃত্বের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত:
“বিন্দুর ছেলে” কেবল একজন মায়ের ভালোবাসার গল্প নয়, এটি একজন নারীর আত্মসম্মান, সংগ্রাম ও আত্মত্যাগের কাহিনি। বিন্দু তার জীবনের সকল সুখ বিসর্জন দিয়ে কেবল একটিই চাওয়া রাখে- তার ছেলেটি যেন মানুষ হয়, মর্যাদার সঙ্গে বাঁচে, মাথা উঁচু করে সমাজে চলতে পারে।
শরৎচন্দ্র এই উপন্যাসে সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির বিরুদ্ধে বিন্দুর অবস্থানকে তুলে ধরেছেন। তিনি দেখিয়েছেন, যাকে সমাজ অপমান করে, অবহেলা করে, সেই নারীই একদিন এক মহান মায়ের রূপ নেয়- যার ভালোবাসা, আত্মত্যাগ ও ত্যাগের মহিমায় সমাজের কলুষতাও হার মানে।
উপসংহার:
“বিন্দুর ছেলে” এমন একটি উপন্যাস যা পাঠকের হৃদয়ে নাড়া দেয়। এটি কেবল এক মায়ের গল্প নয়, এটি এক নারীর জীবনের কষ্ট, সংগ্রাম এবং সেই কষ্টের মাঝেও ভালোবাসা বাঁচিয়ে রাখার গল্প। বিন্দুর চরিত্র শরৎচন্দ্রের অন্যান্য নারীকেন্দ্রিক চরিত্রগুলোর মতোই বাস্তব, মানবিক এবং অনন্য।
মূল বার্তাঃ সমাজ যতই কঠোর হোক, একজন মা তার সন্তানের জন্য হয়ে ওঠেন আশ্রয়, ছায়া, ভরসা। “বিন্দুর ছেলে” সেই চিরন্তন মাতৃত্বের শক্তিকে তুলে ধরে, যা কোনো সামাজিক নিয়ম বা অপবাদ দ্বারা পরাজিত হয় না।
- সংক্ষিপ্তকার: এফ. আর. ইমরান