একটি সময় ছিল, যখন চট্টগ্রামের নাট্যজগৎ ছিল প্রাণবন্ত, রঙিন এবং স্বতন্ত্র। শহরটির অলিতে-গলিতে ছিল সংস্কৃতির শ্বাস, মঞ্চনাটকের আলোর ঝলকানি, আর অভিনয়ের প্রতি এক ধরনের নিঃশব্দ উৎসর্গ। কিন্তু সেই সময় এখন ক্রমেই অতীত হয়ে যাচ্ছে। আজকের বাস্তবতায়, যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও চট্টগ্রামের অধিকাংশ অভিনয়শিল্পী, নির্মাতা, এমনকি চিত্রনাট্যকারদেরও ঢাকার দিকে ছুটে যেতে হচ্ছে, কেবল মাত্র কর্মক্ষেত্রের বিস্তারের জন্য নয় বরং বেঁচে থাকার জন্য। একে কি বলবো-পালিয়ে যাওয়া, নাকি বেছে নেওয়া?
এই প্রশ্নের উত্তর আমরা পেতে পারি নির্মাতা মোরশেদ হিমাদ্রী হিমু-র গল্পে। তিনি একজন চট্টগ্রাম প্রিয় মানুষ। তাঁর শর্টফিল্ম ‘একটি খুনের বিবরণ’ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে জায়গা করে নিয়েছে কিন্তু এই ছবির যে নির্মাণযাত্রা- তা শুধু চলচ্চিত্র নির্মাণ নয়- একটি শহর, তার শিল্প ও সম্ভাবনার আত্মপরিচয় খোঁজার এক চ্যালেঞ্জিং অভিযান।
চট্টগ্রামে নির্মিত এই ছবিটির কাস্টিং, সাউন্ড ডিজাইন, ডাবিং থেকে শুরু করে পুরো প্রিপ্রোডাকশন ও পোস্টপ্রোডাকশন-সবই হয়েছে স্থানীয় উদ্যোগে। এটি নিছক স্থানীয় চলচ্চিত্র নয়, এটি চট্টগ্রামের শিল্প-দাবির এক নীরব উচ্চারণ। কিন্তু এরপরও প্রশ্ন থেকে যায়- চট্টগ্রামে কেন একটি স্থায়ী মিডিয়া ইন্ডাস্ট্রি গড়ে উঠলো না?
একদিকে আমরা দেখছি, এখানে দক্ষ অভিনয়শিল্পীর অভাব নেই। মঞ্চে দীর্ঘ ৫০ বছরের গ্রুপ থিয়েটার চর্চা, এসএম সোলায়মান থেকে শুরু করে আজকের নাট্যমঞ্চে চট্টগ্রামের দাপুটে উপস্থিতি- সবই প্রমাণ করে এ শহরের প্রতিভার। অথচ তাদের জন্য নেই কোনো দীর্ঘস্থায়ী কাজের ব্যবস্থা, নেই পর্যাপ্ত বাজেট, নেই শক্তিশালী প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান।
এভাবেই হিমুদের মতো নির্মাতারা যখন একটি আঞ্চলিক শহরের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও শিল্পকে বড় পরিসরে তুলে ধরতে চান, তখন তারা বাধার সম্মুখীন হন। বাজেট কম, টেকনিশিয়ান দুর্লভ, টিভি চ্যানেলগুলো ঢাকাকেন্দ্রিক। ওটিটি প্ল্যাটফর্মের দিকে নতুন আশার আলো জ্বললেও, এখানেও বাজেট এবং লবিংয়ের অদৃশ্য যুদ্ধ রয়েছে।

তবু হিমু হার মানেননি। তাঁর মতে, “নাটক বা চলচ্চিত্র শুধু বিনোদন নয়- এটি আত্মপরিচয়ের এক শক্তিশালী মাধ্যম। আমরা যদি শুধু আঞ্চলিক ভাষাকে হালকা রসিকতার মধ্যে উপস্থাপন করি, তাহলে নিজেদের ইতিহাস, ঐতিহ্য আর সংগ্রামের গল্পগুলো হারিয়ে যাবে।”
এই কথার ভেতরেই নিহিত রয়েছে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক বিকেন্দ্রীকরণের জন্য একটি বড় দাবি- ঢাকার বাইরে একটি শক্তিশালী শিল্প-ভিত্তির প্রয়োজনীয়তা।
ভারতের কেতন মেহতার ‘মাঝি- দ্য মাউন্টেন ম্যান’ যেমন একজন দরিদ্র শ্রমিকের পাহাড় ভেঙে রাস্তা বানানোর গল্পকে আঞ্চলিকতা পেরিয়ে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক মঞ্চে নিয়ে যায়, তেমনি আমাদের চট্টগ্রামেরও আছে হাজার বছরের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংগ্রাম আর গর্বের গল্প। এই গল্পগুলোকে আমরা যদি না বলি, তবে কে বলবে?
চট্টগ্রামে টেলিভিশন, চলচ্চিত্র বা ওটিটির মত পেশাগত ক্ষেত্র তৈরি না হলে, এখানকার শিল্পীরা দক্ষতা থাকা সত্ত্বেও ঢাকামুখী হবেন- এটাই স্বাভাবিক। কারণ প্রতিভা যত বড়ই হোক, প্ল্যাটফর্ম ছাড়া তার কণ্ঠ থাকে নিঃশব্দ।
একজন নির্মাতা, একজন অভিনেতা কিংবা একজন নাট্যকর্মীর সফলতা তখনই পূর্ণতা পায়, যখন সে নিজের শহরের মাটি থেকে উঠে এসে সেই মাটির গল্পগুলোকে বিশ্বমঞ্চে তুলে ধরতে পারে। হিমু তেমনই একজন- যিনি শুধু চলচ্চিত্র বানান না, তিনি একটি শহরের শিল্পচেতনা বাঁচিয়ে রাখার লড়াই করছেন।
চট্টগ্রামের ভবিষ্যৎ নাটক নির্মাণের কেন্দ্র হতে পারে, যদি সরকার, বেসরকারি উদ্যোগ, মিডিয়া হাউজ এবং নতুন প্রজন্ম একসাথে একটি শক্তিশালী সাংস্কৃতিক অবকাঠামো নির্মাণে এগিয়ে আসে।
শেষ কথা, শর্টকাট দিয়ে এই শিল্পে কেউ এগোতে পারে না। এখানকার শিল্পীদের উচিত নিজের জায়গা থেকে শিল্পচর্চা জারি রাখা, লোভ-মোহের বাইরেও নিজের কাজের প্রতি একাগ্র থাকা। যদি কেউ জিজ্ঞেস করে- “তাহলে কি চট্টগ্রাম থেকে সফল হওয়া যায়?” আমি বলবো- হ্যাঁ যায়, যদি সেই পথে হাঁটার মতো সাহস থাকে। যেমনটা আমরা দেখেছি হিমুদের মধ্যে।
—লেখিকা: পায়েল বিশ্বাস