ধরুন, আপনি একটি মধ্যবিত্ত পরিবারে বসবাস করেন। প্রতিমাসে আপনার গড় খরচ ৩০,০০০ টাকা—যার মধ্যে রয়েছে বাসাভাড়া, বাজার খরচ, স্কুল ফি, ইউটিলিটি বিল, ঔষধপত্র এবং নিত্য প্রয়োজনীয় অন্যান্য খরচ। এখন আপনি এই খরচ দিয়ে মোটামুটি চলতে পারছেন। কিন্তু যদি এই খরচ প্রতি বছর গড়ে ৯ শতাংশ হারে বাড়তে থাকে, তাহলে ১০ বছর পর আপনাকে কত টাকা খরচ করতে হবে?
আমরা যখন ‘মুদ্রাস্ফীতি’ শব্দটি শুনি, তখন অনেকেই ভাবি এটি শুধু বড় ব্যবসায়ী বা অর্থনীতিবিদদের বিষয়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে মুদ্রাস্ফীতি আমাদের জীবনের প্রতিটি কোণায় স্পর্শ করে—আমরা টের পাই প্রতিদিনের বাজারে, বাসাভাড়ায়, চিকিৎসায়, এমনকি এক কাপ চায়ের দামে।
মুদ্রাস্ফীতি মূলত হলো পণ্যের দাম বাড়া, অর্থাৎ একই পণ্য কিনতে আপনাকে আগের তুলনায় বেশি টাকা দিতে হচ্ছে। বাংলাদেশে বিগত কয়েক বছর ধরে গড়ে ৭-৯ শতাংশ হারে মুদ্রাস্ফীতি দেখা গেছে, বিশেষ করে খাদ্যদ্রব্য এবং আবাসনের ক্ষেত্রে এটি আরও বেশি।
এখন যদি আমরা ৯ শতাংশ বার্ষিক মুদ্রাস্ফীতির হার ধরি, তাহলে একটি সহজ গণনায় দেখা যাচ্ছে—বর্তমানে যে ৩০,০০০ টাকায় আপনি মাস চালাচ্ছেন, ১০ বছর পর সেই একই জীবনযাত্রা বজায় রাখতে আপনার প্রয়োজন হবে প্রায় ৭১,০০০ টাকা। অর্থাৎ দ্বিগুণেরও বেশি খরচ।
চিত্রটি সহজভাবে বোঝাতে একটি তুলনামূলক বিশ্লেষণ দেওয়া যায়:
এখন আপনি এক বস্তা চাল ৬০ টাকা কেজি ধরে ৩০০০ টাকায় কিনছেন, ১০ বছর পর সেই চালের দাম হতে পারে ১২০ টাকা বা তারও বেশি।
এখন যে বাসায় আপনি ১০,০০০ টাকা ভাড়ায় থাকছেন, সে বাসার ভাড়া হতে পারে ২০,০০০-২৫,০০০ টাকা।
একজোড়া জুতা এখন ১,৫০০ টাকায় কিনলেও, ১০ বছর পর সেটি কিনতে আপনাকে হয়তো দিতে হবে ৩,৫০০ টাকা।
এই খরচ বৃদ্ধির হার শুধু জীবিকা নির্বাহের ওপর প্রভাব ফেলে না, বরং দীর্ঘমেয়াদি আর্থিক পরিকল্পনাকেও জটিল করে তোলে। যেমন—আপনি যদি এখন থেকেই সঞ্চয়ের পরিকল্পনা না করেন, তাহলে ১০ বছর পর আপনি হয়তো মাসিক খরচই সামাল দিতে পারবেন না, ভবিষ্যতের শিক্ষা, চিকিৎসা বা অবসরের খরচ তো দূরের কথা।
মুদ্রাস্ফীতির এই চক্র থেকে রক্ষা পাওয়ার একমাত্র উপায় হলো—আজ থেকেই সচেতন হওয়া এবং প্রস্তুতি নেওয়া। যারা নিজেদের আয়ের সঙ্গে খরচের ভারসাম্য রক্ষা করেন, এবং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আয় বৃদ্ধির চেষ্টা করেন, তারাই এই ক্রমবর্ধমান খরচ সামলাতে সক্ষম হবেন।
আরেকটি বিষয় হলো বিনিয়োগ। আপনি যদি আজ ১০,০০০ টাকা জমিয়ে রাখেন, সেটি ১০ বছর পর ঠিক ততটা মূল্যবান থাকবে না, যতটা এখন। কারণ, সেই ১০,০০০ টাকা দিয়ে আপনি তখন হয়তো এখনকার অর্ধেক জিনিসও কিনতে পারবেন না। তাই টাকা জমিয়ে রাখা নয় বরং পরিকল্পিতভাবে বিনিয়োগ করা প্রয়োজন—যেখানে আপনার বিনিয়োগের রিটার্ন মুদ্রাস্ফীতির হারের চেয়ে বেশি হবে।
বাংলাদেশে বর্তমানে বিভিন্ন সঞ্চয়পত্র, মিউচুয়াল ফান্ড, স্টক মার্কেট এবং স্বল্পমেয়াদি বিনিয়োগের সুযোগ রয়েছে। এমনকি যদি আপনি প্রতি মাসে মাত্র ২,০০০-৩,০০০ টাকা করে সঞ্চয় করেন, সঠিক পদ্ধতিতে তা ভবিষ্যতের জন্য একটি বড় ভরসা হতে পারে।
এই ভবিষ্যৎ চিন্তা শুধু ব্যক্তি পর্যায়ে সীমাবদ্ধ নয়। অভিভাবকদের জন্য এটি আরও গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ১০ বছর পর একটি মাধ্যমিক স্কুলের ফি এখনকার তুলনায় দ্বিগুণ হতে পারে, বিশ্ববিদ্যালয়ের খরচ তো আরও অনেক বেশি। সন্তানের ভবিষ্যৎ শিক্ষা ব্যয় কেমন হতে পারে, তা এখন থেকেই ভাবতে না পারলে পরে হঠাৎ করে ধাক্কা খাওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়।
সবশেষে, এক কথায় বলা যায়—আজকের আয় দিয়ে যদি আপনি নিজের আগামী দশক কল্পনা করেন, তাহলে হতাশ হয়ে পড়তে পারেন। কিন্তু যদি আপনি পরিকল্পনার মাধ্যমে ধাপে ধাপে প্রস্তুতি নেন, তাহলে মুদ্রাস্ফীতির এই বাড়তি চাপও আপনি সামাল দিতে পারবেন আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে।
তাই এখন থেকেই আপনার মাসিক খরচের হিসাব রাখুন, বাজেট করুন, সঞ্চয় করুন এবং সঠিক জায়গায় বিনিয়োগ করুন। মনে রাখবেন—১০ বছর পর খরচ বাড়বে, এটা ঠেকানো যাবে না; কিন্তু আপনি প্রস্তুত থাকলে তা আপনার জীবনযাত্রাকে নষ্ট করতে পারবে না।
- লেখক : কলামিস্ট, ইউটিউবার এবং ফাইনান্স ও বিজনেস স্ট্রাটেজিস্ট অ্যান্ড সিইও, ফিনপাওয়ার লিডারশিপ ইন্টারন্যাশনাল।