অতিকথন, দম্ভ, অহমিকা একটি জাতিকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দিতে পারে তা বাংলাদেশের জনগণ স্বচক্ষে দেখতে পেয়েছে। মৃত্যুর স্বাদ কত সহজে উপভোগ করতে পারে তা এদেশের তরুণসমাজ দেখিয়ে দিয়েছে। ২০২৪ সালের জুলাই মাস ৩১ তারিখের পরিবর্তে ৩২, ৩৩, ৩৪, ৩৫, ৩৬ ও হতে পারে মুক্তিকামী ছাত্র-জনতা দেখিয়ে দিয়েছে।
স্বাধীন বাংলাদেশে রাজনৈতিক দলগুলো কেন গণতন্ত্রের আদলে স্বৈরতন্ত্রের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হবে? বহুদলীয় গণতন্ত্রের পরিবর্তে একদলীয় শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন করতে হবে? দেশমাতৃকা গঠনে ভূমিকা পালনকারী হিসেবে একজনকে সর্বোচ্চ শিখরে উঠাতে গিয়ে অন্যদের ভূমিকাকে নস্যি করে তুলতে হবে, যার ফলাফল ৫ আগস্ট ২০২৪।
১৯৯১ এর পূর্বে দেখেছি বাকশালীয় কায়দায় একদলীয় শাসনব্যবস্থা, রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার, নয় বছরের জেনারেল এরশাদের স্বৈরশাসন, আবার দেখতে পেয়েছি মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দেশ পরিচালনা করতে।

স্বৈরাচার এরশাদের পতনের পর দেখেছি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে তিন তিনটি জাতীয় নির্বাচন, যার মাধ্যমে সংসদীয় সরকারের আবির্ভাব। নির্বাচন মানেই সারাদেশে একটি উৎসব উৎসব অনুভূতি কাজ করতো।
সব দলের অংশগ্রহণের মাধ্যমে সব নির্বাচনকেই আনন্দমুখর করে তোলা হতো। নির্বাচন কমিশনগুলোর ওপর ছিল অগাধ আস্থা। সব কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ছাত্রসংসদ নির্বাচন যেন নিয়মিত ঘটনা। যার মাধ্যমে দেশে নেতৃত্ব তৈরির সুযোগ হতো। কিন্তু বিধিবাম ১৯৯১-এর পর থেকে রাজনীতি হয়ে গেল ব্যবসায়ীদের আঁতুড়ঘর।
ব্যবসায়ীরা এক সময় আর্থিক সহায়তা প্রদান করতো রাজনীতিবিদদের কিংবা রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে। তাদের লক্ষ্য ছিল সরকার গঠন করলে যেন কিছু ব্যবসায়িক সুযোগ-সুবিধা পাওয়া যায়। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় রাজনীতিতে সরাসরি ব্যবসায়ীদের অংশগ্রহণ বাড়তে থাকলো। সাথে কালো টাকার যথেচ্ছ ব্যবহার বাড়তে লাগলো।
ব্যবসায়ীরা হয়ে উঠলো সংসদ সদস্য, মন্ত্রী, মেয়র, চেয়ারম্যান, কাউন্সিলর আরও নানাবিধ পদপদবীধারী। রাজনীতি বাণিজ্যিকীকরণের মধ্য দিয়ে এগিয়ে চললো।
একটি গণতান্ত্রিক দেশে নির্বাচন হয়েছে জনগণের অংশগ্রহণ ছাড়া। দিনের ভোট রাতে নেওয়ার মতো নানা কূটকৌশল অবলম্বন করে। আমি আর ডামি’র মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন! এ ধরনের নির্বাচনে সহায়তা করেছে প্রশাসনের নানা পর্যায়ের চেয়ারগুলো। ব্যবসায়ীরা নিজেদের স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে অবৈধ কার্যকলাপকে সমর্থন দিয়েছে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য। আর সবকিছুর বলি হয়েছে দেশের আপামর জনগণ।
শুধু শুনেছি উন্নয়নের মহাসড়কে সারা বাংলা। কিন্তু দেশে মূল্যস্ফীতি বেড়েই চলেছে। ঋণের বোঝা বেড়েই চলেছে। দেশের অধিকাংশ বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো দেউলিয়া হওয়ার পথে। রিজার্ভ কমতে কমতে প্রায় ১৫ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি নিয়ে যাওয়া হয়েছে যা ১৮ কোটি মানুষের দেশে অচিন্তনীয়। যে দেশ অনেকটা আমদানি নির্ভর সেখানে রিজার্ভ ক্রমাগত নিম্নমুখী। আশঙ্কার জায়গায় দেশ গরিব থেকে আরও গরিব হচ্ছে।
রাজনৈতিক নেতা, আমলা, ব্যাংকার, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের বাসায় শতশত কোটি টাকার উপস্থিতি। হাজার হাজার কোটি টাকা অবৈধ পাচার হওয়ার গল্প শুনেছি। নিজের দেশকে অর্থনৈতিক অসচ্ছ্বলতার মধ্যে রেখে নিজেরা অর্থ বৈভবের মাঝে দিনানিপাত করেছে। সর্বজন শ্রুত কানাডার বেগমপাড়া। দেশ থেকে সাহেবদের অবৈধ পন্থায় অর্জিত অর্থবিত্ত পৌঁছে যেত অবৈধ পন্থায় বেগমদের কাছে। এই অবৈধ অর্থগুলো হাজার হাজার অবৈধ কাজের সূতিকাগার।
রাজনীতি থাকার কথা রাজনীতিবিদদের কাছে। রাজনীতির কলাকৌশলসহ দল পরিচালনা করতে বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা ভোগ করার কথা দলের নেতাকর্মীদের। দলের খারাপ সময়ে পাশে থাকে দলের একনিষ্ঠ কর্মীরা। কিন্তু বর্তমান বাংলাদেশে দলীয় যত সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছে দলের আদর্শকে বিক্রি করে একান্ত নিজের ব্যক্তি সুবিধা অর্জনে ব্যস্ত থাকে। উদাহরণ হিসেবে ব্যবসায়ী, আমলা, ব্যাংকার, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যগণ, সাংবাদিক, শিক্ষকসহ নানা পেশার মানুষজন।
দুঃখজনক হলেও সত্য বিগত সরকারের একজন শিক্ষক একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের আসনে অধিষ্ঠিত থাকা অবস্থায় তিনি সরকারি দলীয় যুব সংগঠনের সভাপতির দায়িত্ব নিতে চেয়েছিলেন যা অত্যন্ত লজ্জাজনক। বিগতদিনে জাতীয় প্রেসক্লাব, রিপোর্টার্স ইউনিটির মতো প্রতিষ্ঠানে নির্বাচনকালীন সময়ে সরকারি দলের রাজনৈতিক নগ্ন হস্তক্ষেপ সাংবাদিক সমাজকেও মর্মাহত করেছে।
শুধু ব্যক্তিস্বার্থের জন্য নয়, দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব নিয়ে ভাবনার সময় চলে এসেছে। দেশের আঠারো কোটি মানুষের স্বার্থকে গুরুত্ব দিয়ে সিদ্ধান্ত নেই। যার যার অবস্থান থেকে দায়িত্ব পালন করে চেয়ারকে সততার মাপকাঠিতে নিরূপণ করার চেষ্টা করি। নিজেকে অসৎ ভাবনার বৃত্ত থেকে বের করে সৎ চিন্তার বেড়াজালে আবদ্ধ করি। সৎ চিন্তা, সৎ বুদ্ধিবৃত্তির আবরনে নিজেকে সৎ নাগরিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সহায়তা করবে।
- মো. কামরুল ইসলাম: ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, ঢাকা পোস্ট।

