চাঁদপুরের সৌদি আরব ফেরত অভিবাসী মোহাম্মাদ জহিরুল ইসলাম ২০০৮ সালে উন্নত জীবনের আশায় ৩ লাখ ২০ হাজার টাকা খরচ করে সৌদি আরব যান। প্রথমে ক্লিনার হিসেবে কাজ শুরু করলেও ভিসায় ড্রাইভিং লাইসেন্স থাকায় দ্রুত ড্রাইভার পদে কাজ করার সুযোগ পান এবং আর্থিকভাবে স্বচ্ছল হয়ে ওঠেন। দীর্ঘ এক দশকের প্রবাস জীবনে তিনি নিয়মিত দেশে রেমিট্যান্স পাঠানোর পাশাপাশি দুই ভাইকে প্রশিক্ষণ দিয়ে সৌদিতে নিয়ে কাজের সুযোগ করে দেন ও দেশে কৃষিজমি কেনেন।
২০১৯ সালে দেশে ফিরে জহিরুল মাছ চাষ, পশুপালনসহ বিভিন্ন ব্যবসা শুরু করেন। বর্তমানে তিনি শুধু নিজের পরিবারকেই স্বাবলম্বী করেননি, বরং এলাকার আরও অনেকের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করেছেন।
দক্ষ অভিবাসন শুধু অর্থনৈতিক কৌশল নয়, এটি সামাজিক রূপান্তরেরও একটি হাতিয়ার। সঠিক পরিকল্পনা, প্রশিক্ষণ ও নীতিগত সহায়তার মাধ্যমে বাংলাদেশ বৈশ্বিক শ্রমবাজারে শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করতে পারে। যদিও আন্তর্জাতিক স্বল্পমেয়াদি শ্রম অভিবাসন ইতোমধ্যে বহু বাংলাদেশির জীবিকা উন্নয়নে সহায়ক, অধিকাংশ শ্রমিক এখনও নিম্নদক্ষ হিসেবে বিদেশে যায়। দক্ষ অভিবাসনের হার কম হলেও কারিগরি ও ভাষা প্রশিক্ষণ বৃদ্ধির মাধ্যমে এটি বাড়ানো সম্ভব।
রেফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক ড. তাসনিম সিদ্দিকী বলেন, ‘বাংলাদেশ এখনো মূলত অদক্ষ ও অর্ধদক্ষ শ্রমিক প্রেরণের বাজারে আটকে আছে। বর্তমানে বিএমইটির অধীনে ১১০টি টেকনিক্যাল ট্রেনিং সেন্টার (টিটিসি) রয়েছে, যেখানে ৫৫টি পেশায় প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় এবং ৪৬টি কেন্দ্রে ভাষা প্রশিক্ষণও রয়েছে। কিন্তু এ প্রশিক্ষণ গ্রহণকারীদের বিদেশে চাকরির ক্ষেত্রে সফলতার প্রমাণ অতি সীমিত।’
চ্যালেঞ্জও রয়েছে—প্রশিক্ষণের অভাব, ভাষাগত প্রতিবন্ধকতা, অভিবাসন নীতির জটিলতা ও তথ্যের ঘাটতি। রেমিট্যান্স প্রেরণায় অনানুষ্ঠানিক চ্যানেলের ব্যবহারও বৈধ অর্থপ্রবাহে বাধা সৃষ্টি করছে। তবে সম্ভাবনাও আছে। কারিগরি ও ডিজিটাল দক্ষতা বৃদ্ধির উদ্যোগ, সরকারি সহায়তা এবং ডিজিটাল রেমিট্যান্স প্রসারের মাধ্যমে বাংলাদেশ দক্ষ অভিবাসনের মাধ্যমে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে উপকৃত হতে পারে।
জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি) বাংলাদেশি অভিবাসী শ্রমিকদের চারটি দক্ষতার স্তরে ভাগ করেছে—প্রফেশনাল, দক্ষ, অর্ধদক্ষ ও অদক্ষ। বাংলাদেশের অধিকাংশ শ্রমিক অর্ধদক্ষ ও অদক্ষ শ্রেণিতে কাজ করেন। ২০২৩ সালের হিসাব অনুযায়ী, মোট প্রবাসী শ্রমিকের মধ্যে মাত্র ৪ শতাংশ প্রফেশনাল, ২৫ শতাংশ দক্ষ, ২১ শতাংশ অর্ধদক্ষ এবং ৫০ শতাংশ অদক্ষ শ্রমিক হিসেবে বিদেশে গিয়েছেন।
একই বছরে (২০২৩) বাংলাদেশ ছিল বিশ্বের ৮ম সর্বাধিক রেমিট্যান্স গ্রহণকারী দেশ। বিশ্বব্যাংকের তথ্যমতে, সে বছর বাংলাদেশ প্রায় ২১.৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স পায়। এর মধ্যে সৌদি আরব (১৫ শতাংশ), সংযুক্ত আরব আমিরাত (১৭ শতাংশ), যুক্তরাষ্ট্র (১২ শতাংশ), যুক্তরাজ্য (১২ শতাংশ) ও কুয়েত (৭ শতাংশ) ছিল প্রধান উৎস দেশ। তবে ২০২১ সালের পর থেকে রেমিট্যান্স প্রবাহে ধীরগতি বা নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি লক্ষ্য করা গেলেও ২০২৪ সালের আন্দোলনকে কেন্দ্র করে বেড়েছে। তবে উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, রেমিট্যান্স সংক্রান্ত তথ্য এখনো লিঙ্গভিত্তিকভাবে সংরক্ষণ করা হয় না।
রামরুর ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক ড. তাসনিম সিদ্দিকী আরও বলেন, দক্ষ শ্রমবাজারে প্রবেশের চ্যালেঞ্জ অনেক। কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র (টিটিসি) থেকে প্রশিক্ষণ নেওয়া অনেক শ্রমিক বিদেশে কাজের উপযুক্ত সুযোগ পান না। ফলে সম্ভাব্য অভিবাসীরাও দক্ষতা অর্জনে আগ্রহ হারান। এর পাশাপাশি রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোও দক্ষ অভিবাসন প্রচারে আগ্রহী নয়। কারণ অদক্ষ শ্রমিক প্রেরণ করে তারা বেশি লাভবান হতে পারে এবং দায়বদ্ধতা এড়িয়ে যেতে পারে।
নরসিংদীর দুবাই ও কুয়েত ফেরত অভিবাসী মোহাম্মাদ আরিফ মিয়া বিদেশে যাওয়ার আগে ঢাকায় একটি গার্মেন্টসে কাটিং ইনচার্জ ছিলেন। কাজের দক্ষতায় খুশি হয়ে মালিক ২০১২ সালে তাকে বিনা খরচে দুবাই পাঠান। সেখানে তিনি ২০০ জন কর্মীর দায়িত্ব পান এবং কাটিং, সুইং ও ফিনিশিং বিভাগ পরিচালনা করেন। চার বছর দুবাই ও আরও চার বছর কুয়েতে কাজ শেষে ২০২০ সালে দেশে ফিরে আসেন।
তিনি বলেন, তার তিনটি গাড়ি, ‘দেব এগ্রো লিমিটেড’ নামে একটি কৃষি খামার, ভাড়ার জন্য নির্মিত ঘর এবং একটি কম্পিউটার ও স্টেশনারি দোকান রয়েছে। ‘বিদেশে অর্জিত অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে শুধু নিজের জীবিকা নয়, আরও অনেকের কর্মসংস্থান তৈরি করতে পেরে আমি গর্বিত।’
প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব মোহাম্মদ সেলিম রেজা বলেন, ‘সফল অভিবাসনের মূল চাবিকাঠি হলো দক্ষতা। সরকার টিটিসির সংখ্যা বাড়ালেও তা এখনো পর্যাপ্ত নয়, কারণ সমাজে কারিগরি শিক্ষা অবমূল্যায়িত। উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশে যেখানে ৪০-৭৩ শতাংশ মানুষ কারিগরি প্রশিক্ষিত, সেখানে বাংলাদেশে ২০১৩ সালে এ হার ছিল মাত্র ১.০৩ শতাংশ, যা ২০২৩ সালে বেড়ে হয়েছে ৫.০৪ শতাংশ।’
তিনি জোর দিয়ে বলেন, ‘কোন দক্ষতার চাহিদা আছে তা নিয়মিতভাবে চিহ্নিত করে তরুণদের সে অনুযায়ী প্রশিক্ষণ দিতে হবে। জাপান-কোরিয়ার মতো দক্ষতা ও ভাষা প্রশিক্ষণ ছাড়া কাউকে বিদেশে পাঠানো উচিত নয়। বিদেশ ফেরত কর্মীরা প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ব্যবসা শুরু করে স্বাবলম্বী হতে পারেন।’
টাঙ্গাইলের সৌদি আরব ফেরত সফল অভিবাসী আবুল কালাম বলেন, ‘২০০৬ সালে ৩ লাখ টাকা খরচ করে সৌদি আরব যাই। প্রথমে কফি শপে কাজ শুরু করি, দ্রুত দক্ষতা প্রদর্শনের ফলে খুব অল্প সময়ের মধ্যে ইনচার্জ পদে উন্নীত হই। পরবর্তীতে নিজেই কফি শপ খুলি এবং দেশে কিছু সম্পদ, একটি মার্কেট ও ৫০০ শতক কৃষিজমি গড়ে তুলি।’
‘২০২০ সালে দেশে ফিরে আমি একটি সমন্বিত খামার চালু করি, যেখানে গরু ও মাছের চাষের পাশাপাশি বেকারি ও কেক তৈরির কারখানাও রয়েছে। এই উদ্যোগের মাধ্যমে প্রায় ২০ জন মানুষের কর্মসংস্থান নিশ্চিত হয়েছে।’
অভিবাসন বিশেষজ্ঞ ড. মোহাম্মদ নুরুল ইসলাম বলেন, ‘দক্ষতা প্রশিক্ষণের সুবিধা সম্পর্কে পর্যাপ্ত প্রচার না থাকায় অনেকেই তা সম্পর্কে অবগত নন। সরকারি পর্যায়ে প্রচারণা খুব সীমিত। তাঁর মতে, সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রবাসী হওয়া ও দক্ষতা অর্জনের সুফল নিয়ে মোটিভেশনাল ভিডিও প্রচার করা জরুরি।’
তিনি আরও বলেন, ‘ওয়েল্ডিং, নার্সিং ও কেয়ারগিভারের মতো পেশায় বৈশ্বিক চাহিদা ক্রমেই বাড়ছে। বর্তমানে বাংলাদেশের কর্মীরা ১৭৪ দেশে যাওয়ার সুযোগ পেলেও মাত্র ৭টি দেশে ৯৩ শতাংশ শ্রমশক্তি যায়। তাই নতুন বাজার অনুসন্ধান করা এখন সময়ের দাবি।’
‘প্রধান গন্তব্য দেশগুলোর চাহিদা অনুযায়ী পেশার পূর্বাভাস ও কারিকুলামের নিয়মিত আপডেটের অভাবও দক্ষ অভিবাসনে বাধা সৃষ্টি করছে। বর্তমানে টিটিসির প্রায় অর্ধেক প্রশিক্ষক ও প্রধানের পদ শূন্য এবং ট্রেনিং অব দ্য ট্রেইনারস অনিয়মিতভাবে পরিচালিত হচ্ছে। অধিকাংশ প্রশিক্ষণ আন্তর্জাতিক মান পূরণ করে না।’
রামরুর গবেষণা অনুযায়ী, ১৯৭৬ থেকে সেপ্টেম্বর ২০২৪ পর্যন্ত ১ কোটি ৬৭ লাখ ৭৪ হাজার ৪৫ জন বাংলাদেশি শ্রমিক বিদেশে কর্মসংস্থানের জন্য গেছেন। এর মধ্যে সর্বোচ্চ প্রবাসী (১৩ লাখ ৫ হাজার ৪৫৩ জন) গিয়েছেন ২০২৩ সালে।
২০২৩ সালে মোট অভিবাসীর ১৩ শতাংশ নারী ছিলেন। তবে ফেরত আসা অভিবাসীদের সঠিক তথ্য রেকর্ড করার কোনো সিস্টেম এখনও নেই। একই বছর, প্রায় ৯০ শতাংশ শ্রমিক মাত্র ছয়টি দেশে গিয়েছেন—সৌদি আরব, মালয়েশিয়া, ওমান, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার ও সিঙ্গাপুর। নারী শ্রমিকদের ক্ষেত্রে সৌদি আরব সবচেয়ে জনপ্রিয় গন্তব্য, যেখানে মোট নারী অভিবাসীর ৬৫ শতাংশ গিয়েছিলেন।
প্রফেসর ড. তাসনিম সিদ্দিকী শ্বেতপত্রে বলেন, ‘প্রধান গন্তব্য দেশগুলোর চাহিদা অনুযায়ী পেশার পূর্বাভাস ও কারিকুলামের নিয়মিত আপডেটের অভাবও দক্ষ অভিবাসনে বাধা সৃষ্টি করছে। বর্তমানে টিটিসির প্রায় অর্ধেক প্রশিক্ষক ও প্রধানের পদ শূন্য এবং ট্রেনিং অব দ্য ট্রেইনারস অনিয়মিতভাবে পরিচালিত হচ্ছে। অধিকাংশ প্রশিক্ষণ আন্তর্জাতিক মান পূরণ করে না।’
‘এ ছাড়া, বাংলাদেশি সার্টিফিকেটের সমতুল্যতা মূল শ্রম গৃহীত দেশের সার্টিফিকেটের সঙ্গে নেই। পূর্ব শিক্ষা সার্টিফিকেট শুধুমাত্র সেই ফেরত অভিবাসীদের জন্য প্রদান করা হয় যাদের কমপক্ষে এসএসসি ডিগ্রি রয়েছে; তাই ৯১ শতাংশ ফেরত অভিবাসী এই সুবিধা নিতে পারে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘বিএমইটির তিন মাসের প্রশিক্ষণও বাংলাদেশ জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ দ্বারা স্বীকৃত নয়। টিটিসিগুলো উন্নয়ন বাজেটের আওতায় নির্মিত হলেও, বার্ষিক রাজস্ব বাজেট থেকে প্রশিক্ষক নিয়োগ, সরঞ্জাম ক্রয় ও প্রশিক্ষণের জন্য পর্যাপ্ত সম্পদ বরাদ্দ করা হয় না। নতুন স্থাপিত প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলো তাদের লক্ষ্যকৃত প্রশিক্ষণের মাত্র এক-তৃতীয়াংশ প্রদান করছে। সম্প্রতি ৪০টি নতুন উপজেলার জন্য ১ হাজার ৬৬৭ কোটি টাকা ব্যয় করে টিটিসি স্থাপন করা হয়েছে, যা কোনো স্ট্যান্ডার্ড ফিজিবিলিটি স্টাডি ছাড়া করা হয়েছে।’
সুইস এজেন্সির সহায়তায় হেলভেটাস বাংলাদেশের সিমস প্রকল্প রামরুর কুমিল্লা ফিল্ডের মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ অর্থ ছাড়াই সম্ভাব্য অভিবাসীদের দক্ষতা উন্নয়নের কাজ করে যাচ্ছে ২৫টি ইউনিয়নে। এই প্রকল্পের আওতায় স্থানীয় অংশীজনদের প্রশিক্ষণ, ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারের উদ্যোক্তাদের প্রশিক্ষণ, বিদেশ যাত্রায় সিদ্ধান্ত গ্রহণের পূর্ববর্তী পরিচিতিমূলক দিকনির্দেশনা, বিদেশ যাত্রার পূর্বে প্রয়োজনীয় তথ্য ও প্রস্তুতি বিষয়ক পরিচিতি সেশন, অভিযোগ ব্যবস্থাপনা কমিটি- এই উদ্যোগগুলো নিশ্চিত করার জন্য যেন প্রশিক্ষিত শ্রমিকরা বিদেশে গিয়ে যেন আত্মনির্ভরশীলভাবে কাজ করতে সক্ষম হয়।
এছাড়াও কমিউনিটি থেকে আগত প্রশিক্ষণপ্রত্যাশীদের দক্ষতা ও ভাষা প্রশিক্ষণের জন্য রেফারেল প্রদান করা হয় এবং তাদের প্রশিক্ষণ গ্রহণের অগ্রগতি নিয়মিতভাবে পর্যবেক্ষণ ও ফলোআপ করা হয়।
- তানজিলা মোস্তাফিজ, রেফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিট (রামরু)-এ এডভোকেসি ও নলেজ ম্যানেজমেন্ট অফিসার। সূত্র: ডেইলি স্টার