বাংলাদেশে করপোরেট গভর্ন্যান্সের এক দুর্বল দিক হলো উত্তরাধিকার পরিকল্পনা। বহুজাতিক কোম্পানিগুলো এখানে লিডারশিপ তৈরিতে বেতনকে দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগ হিসেবে দেখে, যেখানে স্থানীয় অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান এখনও তা কেবল খরচ হিসেবে বিবেচনা করে। এই ব্যবধানই ব্যাখ্যা দেয় কেন বহুজাতিক কোম্পানির পেশাজীবীরা কাঠামোবদ্ধ, যোগ্যতা-ভিত্তিক পরিবেশে সাফল্য অর্জন করে, আর স্থানীয় প্রতিষ্ঠানে অনেকে অব্যবহৃত ও হতাশ থেকে যায়।
গত দুই দশকে গার্মেন্টস, সিমেন্ট এবং ট্রেডিং খাতের পরিবারের মালিকানাধীন কংগ্লোমারেটগুলো পেশাদার ম্যানেজার নিয়োগের চেষ্টা করেছে। তবে সত্যিকারের সাফল্য খুবই কম। মূল কারণ হলো মালিকদের দৈনন্দিন কর্মকাণ্ডে প্রাধান্য। কাগজে পেশাজীবীরা ক্ষমতাশালী মনে হলেও, বাস্তবে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলো প্রায়শই মালিক বা পরিবারের হাতে ফিরে আসে। এতে উদ্যোগ নেয়ার সুযোগ কমে যায়, পেশাজীবীদের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয় এবং ধারণা তৈরি হয় যে, ব্যবসা শুধুমাত্র মালিকই সফলভাবে চালাতে পারে। ফলাফল স্বাভাবিক: প্রতিভাবান ম্যানেজাররা প্রায়শই বহুজাতিক কোম্পানিতে চলে যায়, যেখানে সিদ্ধান্ত গ্রহণের কাঠামো স্পষ্ট এবং ক্যারিয়ার প্রগতি নিয়মিত।
বহুজাতিক যৌথ উদ্যোগের সঙ্গে এই পার্থক্য খুবই স্পষ্ট। দ্রুত বিক্রি হওয়া ভোক্তা পণ্য, টেলিকম এবং সিমেন্ট খাতের কোম্পানিগুলোতে সাধারণত পেশাজীবীরা পরিচালনা করেন, আর বিদেশি বা প্রাতিষ্ঠানিক শেয়ারহোল্ডাররা গভর্ন্যান্স ও কৌশলগত তদারকিতে মনোনিবেশ করেন। মালিকানা ও পরিচালনা আলাদা থাকায়, ম্যানেজারদের নেতৃত্ব দেওয়ার উপর বিশ্বাস রাখা হয় এবং তাদের পারফরম্যান্সের জন্য দায়বদ্ধ করা হয়। এসব প্রতিষ্ঠান নিয়মিত শীর্ষ গ্র্যাজুয়েট আকৃষ্ট করে, অভ্যন্তরীণভাবে লিডার তৈরি করে এবং দ্রুত পরিবর্তনশীল বাজারে প্রতিযোগিতামূলক থাকে।
বাংলাদেশি প্রথম প্রজন্মের উদ্যোক্তাদের ভূমিকা বোঝা গুরুত্বপূর্ণ। আজকের অনেক ব্যবসায়ী ছিলেন সাধারণ অবস্থান থেকে শুরু – কেউ কাঁচামালের ব্যবসা শুরু করেছেন, কেউ ফ্যাক্টরিতে বা ছোট সেলাই দোকানে কাজ করেছেন। অধ্যবসায় ও পরিশ্রমের মাধ্যমে তারা এমন প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন যা খাতগুলোতে প্রাধান্য পেয়েছে। তাদের শক্তি ছিল হাতে-কলমে অভিজ্ঞতা এবং স্বাভাবিক বাজার জ্ঞান। কিন্তু এই ইতিহাসই একটি কাঠামোগত চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে, পেশাজীবীদের নিয়োগের সময় মালিকরা প্রায়শই আশা করেন যে তারা মালিকদের মতো অন্তর্দৃষ্টি ও সহনশীলতা দেখাবে। অধিকাংশ ম্যানেজারের জন্য এটি অসম্ভব, যা অবিশ্বাস ও হতাশা তৈরি করে। তাদের জন্য এটি “আগুনের মাধ্যমে পরীক্ষা”।
এই সমস্যা আরও জটিল হয় যখন ব্যবসাগুলো দ্বিতীয় বা তৃতীয় প্রজন্মে যায়। অনেক পরিবারের উত্তরাধিকারীরা বিদেশের শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছে। এই শিক্ষা মূল্যবান হলেও, কেউ কেউ পরিবারিক ব্যবসায় যোগ দিতে অনিচ্ছুক থাকে, আর কেউ কেউ সরাসরি বিদেশি ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি প্রয়োগ করতে চায়। এই মডেলগুলো প্রায়শই স্থানীয় বাস্তবতার সঙ্গে মিল না খেয়ে, কর্মীদের সঙ্গে ঘর্ষণ সৃষ্টি করে এবং পারফরম্যান্সকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।
প্রধান ধারা স্পষ্ট। পরিবার-প্রধান কংগ্লোমারেটগুলো প্রায়শই উত্তরাধিকার সমস্যায় পড়েন, কারণ ক্ষমতা প্রতিষ্ঠাতা বা উত্তরাধিকারীর হাতে কেন্দ্রীভূত থাকে, পেশাজীবী ম্যানেজারদের বিকাশের সুযোগ কম থাকে। অন্যদিকে, তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠান ও বহুজাতিক যৌথ উদ্যোগে নেতৃত্ব বিকাশ কাঠামোবদ্ধ এবং গভর্ন্যান্স ও পরিচালনার মধ্যে স্পষ্ট বিভাজন থাকে। এতে তারা প্রতিভা আকর্ষণ, ধরে রাখা এবং পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে বেশি সক্ষম।
বাংলাদেশের বেসরকারি খাতের জন্য মনোভাব পরিবর্তন জরুরি। পেশাজীবী ম্যানেজারদের বিকাশের সময় ও স্বাধীনতা দিতে হবে, যাতে তাদের মূল্যায়ন হয় মালিকদের জীবদ্দশার অভিজ্ঞতার সঙ্গে তুলনা না করে। মালিকরা কৌশল ও গভর্ন্যান্সে মনোযোগ দিন, পরিচালনা ম্যানেজারদের হাতে দিন। দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্রজন্মের উত্তরাধিকারীরা বোর্ডরুমে সোজাসুজি বসানো উচিত নয়, বরং পদক্রমে কাজ করে তাদের অবস্থান অর্জন করতে হবে। বৈশ্বিক শিক্ষা দর্শন বৃদ্ধি করতে পারে, তবে তা স্থানীয় অভিজ্ঞতার সঙ্গে মিশে কাজ করবে।
বাংলাদেশের প্রথম প্রজন্মের উদ্যোক্তারা ইতিমধ্যেই অধ্যবসায় ও পরিশ্রমের মাধ্যমে সাফল্য দেখিয়েছেন। এখন চ্যালেঞ্জ হলো, তাদের প্রতিষ্ঠানে স্থায়িত্ব এবং বিকাশ নিশ্চিত করা। তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠান ও যৌথ উদ্যোগের গভর্ন্যান্স অভ্যাস থেকে শিক্ষা নিয়ে পরিবার-প্রধান ব্যবসাগুলো উত্তরাধিকার পরিকল্পনা কাঠামোবদ্ধ করতে, নেতৃত্ব তৈরি করতে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য ঐতিহ্য সংরক্ষণ করতে পারে। এই পরিবর্তন ছাড়া অনেক প্রতিষ্ঠান স্থবির হয়ে যেতে পারে। তবে সঠিকভাবে করলে, বাংলাদেশের নিজস্ব প্রতিষ্ঠানগুলো আরও দৃঢ়তা ও আত্মবিশ্বাস নিয়ে ব্যবসায়িক যাত্রা চালিয়ে যেতে পারবে।
লেখক: মাসুদ খান: চেয়ারম্যান, ইউনিলিভার কনজ্যুমার কেয়ার লিমিটেড।