অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব নির্বাচনের আয়োজন করা। সেটি সুষ্ঠুভাবে করা, যাতে গত ১৫ বছরের অভিজ্ঞতার পরিবর্তন ঘটে। মানুষ যেন নিরাপদে এবং সুস্থভাবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারে, ভোট দিতে পারে। সংঘাত বা সহিংসতা যেন না হয়, কিংবা রাষ্ট্র বা সরকারের কোনো পক্ষপাত যেন দেখা না যায়—এগুলোই এই সরকারের প্রধান দায়িত্ব।
এই দায়িত্ব পালনের জন্য সরকারের কী ধরনের কাঠামো প্রয়োজন, সেটাই এখন প্রশ্ন। বিএনপির পক্ষ থেকে সরকারকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ভূমিকায় যাওয়ার কথা বলা হয়েছে। এমনিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনঃপ্রবর্তনের বিষয়ে একটি সংস্কার কমিশনের সিদ্ধান্ত আছে, আদালতের রায়ও আছে। সেই হিসেবে এই অন্তর্বর্তী সরকারই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ভূমিকা পালন করতে পারে, তাতে কোনো সমস্যা নেই।
কিন্তু সরকারের যা নিশ্চিত করতে হবে, তা হলো—সরকার যেন পক্ষপাতহীন থাকে, প্রশাসন এবং অন্যান্য প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোগুলোকে দক্ষতার সঙ্গে বিন্যাস করে। প্রয়োজনে পুনর্বিন্যাস করবে, প্রয়োজনে কাঠামোর ভেতরে যে পরিবর্তন দরকার, সেটা করবে।
বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপি তিনটি দলই আলাদা আলাদা বৈঠকে ‘কিছু উপদেষ্টার’ অপসারণ চেয়েছে। তিনটি দল আলাদাভাবে উপদেষ্টাদের অপসারণ চাওয়াটা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যে দলগুলো নির্বাচনে অংশ নেবে, উপদেষ্টাদের বিরুদ্ধে তাদের যদি সমবেতভাবে অভিযোগ থাকে, তবে সেটা গুরুত্বের সঙ্গে দেখা উচিত। উপদেষ্টাদের বিরুদ্ধে সাধারণত তিন ধরনের অভিযোগ হতে পারে—অদক্ষতা, দুর্নীতি ও দলীয় পক্ষপাত।
যদি এসব অভিযোগ সুনির্দিষ্ট হয়, সেখানে যদি তথ্যপ্রমাণ থাকে, তাহলে সরকারকে অবশ্যই গুরুত্বের সঙ্গে তা বিবেচনা করতে হবে। কিন্তু যদি অভিযোগগুলো অযৌক্তিক হয় কিংবা জোরজবরদস্তি হয়—যেমন আমরা অনেক সময় দেখি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে লোক বসানো বা সরানোর ক্ষেত্রে মব সন্ত্রাসের মতো প্রবণতা তৈরি হয়, তাহলে সেটাকে প্রশ্রয় দেওয়া যাবে না।
এখন এই অবস্থায় প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে পুরো দায়িত্বই অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের ওপর বর্তায়। তাঁর বিচার-বিবেচনা, দক্ষতা, সক্ষমতা, নিরপেক্ষতা এবং বস্তুনিষ্ঠতা সবকিছুর ওপর এখন অনেক কিছু নির্ভর করছে। তিনি কতটা তা কার্যকরভাবে করতে পারবেন, সেটিই এখন মূল বিষয়।
তিনটি রাজনৈতিক দল যে তিন ধরনের অভিযোগ করছে, আমরা তো বাইরে থেকে দেখছি। তবে এই তিন দলের মধ্যেই দলীয় প্রভাব বাড়ানোর একটা প্রবণতা আছে। কোথাও জোরজবরদস্তি হচ্ছে, কোথাও কৌশল প্রয়োগ হচ্ছে, কোথাও চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে। এই প্রবণতা গণতান্ত্রিক রূপান্তরের জন্য একটা বড় হুমকি। সাধারণভাবে এখন বলা হয় যে বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপি—এই তিন দলের সমন্বয়ে এই সরকার চলছে। তাই যদি এই তিন দলের মধ্যে নিজেদের অংশ বাড়ানোর প্রতিযোগিতা শুরু হয়, সেটা দেশের নির্বাচনের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠবে।
আমরা অতীতে দেখেছি, তত্ত্বাবধায়ক সরকারগুলো নির্বাচনকে সামনে রেখে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন করেছে, কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে বড় কোনো অভিযোগ ওঠেনি। এখনকার অন্তর্বর্তী সরকার শুরু থেকেই নানা বিতর্ক ও দলীয় প্রভাবের মধ্যে আছে, ফলে সমাজে একধরনের অনাস্থা তৈরি হয়েছে।
এই অনাস্থা অতিক্রম করে সরকারকে এমন এক অবস্থান নিতে হবে, যাতে মনে হয় তারা যথাযথ নির্বাচনের জন্য দৃঢ় অবস্থানে আছে এবং কোনো দলের অযৌক্তিক দাবির কাছে আত্মসমর্পণের মতো দুর্বলতা তাদের নেই।
-
লেখক: আনু মুহাম্মদ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক। সূত্র: প্রথম আলো

