বেতনের মাপকাঠি শিক্ষাগত যোগ্যতা ও মেধার উৎকর্ষতার ওপর নির্ভর করা উচিত বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. কামরুল হাসান মামুন। বৃহস্পতিবার (৩০ অক্টোবর) সকালে নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক আইডিতে দেওয়া এক পোস্টে এ কথা বলেন তিনি।
তার পোস্টটি হুবহু তুলে দেওয়া হলো—
বেতনের মাপকাঠি হোক শিক্ষাগত যোগ্যতা ও মেধার উৎকর্ষতা! বেতনের নির্ধারণ কেবল পদ বা কর্মঘণ্টার ভিত্তিতে নয়, বরং শিক্ষাগত যোগ্যতা ও মেধার উৎকর্ষতার ওপর নির্ভর করা উচিত। তবে এখানে শুধু কাগুজে সার্টিফিকেটই যথেষ্ট নয়—প্রকৃত যোগ্যতার মূল্যায়নের জন্য প্রয়োজন যোগ্য ব্যক্তিদের নিয়ে গঠিত বহুধাপী নিয়োগ ও প্রমোশন বোর্ড, যেখানে প্রতিটি ধাপেই থাকবে স্বচ্ছ ও কার্যকর ফিল্টারিং পদ্ধতি। এতে প্রকৃত যোগ্যতা ও সক্ষমতাই চিহ্নিত হবে, মুখস্থবিদ্যা বা প্রভাব নয়। একটি সভ্য সমাজে বেতন কেবল কাজের সময়ের বিনিময় নয়—এটি একজন মানুষের পরিশ্রম, মেধা ও শিক্ষাগত অর্জনের প্রতি সম্মান। কিন্তু দুঃখজনকভাবে, আমাদের সমাজে এই যৌক্তিক সম্পর্কটি বহু সময়েই উপেক্ষিত হয়।
ন্যায্যতার দৃষ্টিকোণ থেকে ভাবলে বেতনস্কেল নির্ধারণের মূল গাইডলাইন হওয়া উচিত শিক্ষাগত যোগ্যতা। যে শুধু এসএসসি পাস, তার চেয়ে এইচএসসি পাসের বেতন বেশি হওয়া যুক্তিযুক্ত; আবার স্নাতক ডিগ্রিধারীর বেতন হওয়া উচিত এইচএসসি পাসের চেয়ে বেশি। কারণ শিক্ষার প্রতিটি ধাপ পেরোতে একজন মানুষকে অর্থ, সময়, শ্রম এবং মেধা বিনিয়োগ করতে হয়—তাই তার পারিশ্রমিকেও সেই বিনিয়োগের প্রতিফলন থাকা উচিত।
একজন মাস্টার্স ডিগ্রিধারী সাধারণত স্নাতক ডিগ্রিধারীর তুলনায় গভীরতর জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জন করেন—এটাই কাঙ্ক্ষিত। যদিও সব ক্ষেত্রেই এটি শতভাগ সত্য নাও হতে পারে, তবুও সাধারণভাবে এটি ন্যায্য প্রত্যাশা। একইভাবে, যিনি পিএইচডি সম্পন্ন করেছেন, তিনি গবেষণার মাধ্যমে নতুন জ্ঞান সৃষ্টি ও মানবজাতির জ্ঞানের ভাণ্ডার সমৃদ্ধ করছেন—এটাই বিশ্বজুড়ে কাঙ্ক্ষিত ও স্বীকৃত। তাই তার বেতন মাস্টার্স পাসের চেয়ে বেশি হওয়া শুধু যুক্তিসঙ্গত নয়, বরং এটি গবেষণা ও জ্ঞানচর্চার প্রতি সামাজিক সম্মানের প্রকাশ।
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের ক্ষেত্রে বিষয়টি আরও তাৎপর্যপূর্ণ। যিনি ন্যূনতম যোগ্যতা অর্জন করেছেন, তিনি নিঃসন্দেহে যোগ্য; কিন্তু যিনি গবেষণায় ন্যূনতম চাহিদার দ্বিগুণ সাফল্য অর্জন করেছেন, তার জন্য থাকা উচিত বিশেষ প্রণোদনা বা অতিরিক্ত আর্থিক স্বীকৃতি। এতে কেবল শিক্ষকই উৎসাহিত হবেন না, বরং পুরো একাডেমিক পরিবেশে তৈরি হবে সৃজনশীলতা, উদ্ভাবন ও প্রতিযোগিতার ইতিবাচক সংস্কৃতি।
শিক্ষাগত যোগ্যতা ও মেধার যথাযথ স্বীকৃতি না থাকলে সমাজে ছড়িয়ে পড়ে একটি বিপজ্জনক বার্তা—‘বেশি পড়াশোনা করলেও লাভ নেই।’ এই ধারণা তরুণ প্রজন্মকে জ্ঞানচর্চা থেকে দূরে সরিয়ে দেয়, আর রাষ্ট্র হারায় তার সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ: দক্ষ, সৃজনশীল ও চিন্তাশীল মানবসম্পদ।
তাই সময় এসেছে বেতন কাঠামোকে শিক্ষাগত যোগ্যতা, গবেষণার গভীরতা ও মেধার উৎকর্ষতার সঙ্গে যুক্ত করার। যিনি বেশি জানেন, বেশি পরিশ্রম করেছেন এবং জ্ঞানের জগতে নতুন সংযোজন ঘটিয়েছেন—তার প্রাপ্যও হোক বেশি। এমন ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠিত হলে তবেই গড়ে উঠবে এক জ্ঞাননির্ভর, ন্যায়ভিত্তিক ও মর্যাদাপূর্ণ সমাজ।
- —লেখক: ড. কামরুল হাসান মামুন, অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

