সাংবাদিকদের ওপর সংঘটিত অপরাধের দায়মুক্তি অবসানে আন্তর্জাতিক দিবসে স্বাধীনতাপ্রেমী বিশ্বের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করছে দ্য ডেইলি স্টার। স্বাধীন ও নিরপেক্ষ গণমাধ্যম ছাড়া গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা যায় না; ব্যক্তি ও সমাজের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা সম্ভব না; মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা প্রকাশ পায় না এবং এর বিচারও হয় না। এক কথায় স্বাধীন ও নিরপেক্ষ গণমাধ্যম ছাড়া জবাবদিহিমূলক সরকার প্রতিষ্ঠা অসম্ভব। স্বাধীন গণমাধ্যম ছাড়া কোনো সমাজেই ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয় না এবং দায়মুক্তির সংস্কৃতি বিলোপ করা যায় না। এই দৃঢ় বিশ্বাস থেকেই আমরা দিবসটিতে সংহতি প্রকাশ করছি।
ইউনেসকোর তথ্য অনুযায়ী, ২০০৬ সাল থেকে গত ১৯ বছরে বিশ্বজুড়ে এক হাজার ৮০০ জন সাংবাদিক নিহত হয়েছেন। দুঃখজনকভাবে, জাতিসংঘের এই সংস্থাটি জানাচ্ছে, ‘এই হত্যাকাণ্ডগুলোর প্রতি ১০টির মধ্যে নয়টির বিচার আজও হয়নি।’
সর্বশেষ তথ্য নিয়ে রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস জানিয়েছে, গাজায় গণহত্যার খবর সংগ্রহকারী ২৭০ জনের বেশি ফিলিস্তিনি সাংবাদিককে ইচ্ছাকৃতভাবে, বেপরোয়াভাবে ও প্রতিশোধপরায়ণ মনোভাব নিয়ে হত্যা করেছে ইসরায়েল।
এই ভয়াবহ হত্যাকাণ্ডের পরও জাতিসংঘ, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কিংবা বিশ্বের গণতান্ত্রিক দেশগুলো যথাযথভাবে এর নিন্দা পর্যন্ত জানায়নি। তারচেয়েও কষ্টদায়ক হলো, বিশ্ব সাংবাদিক সমাজেরও এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে যতটা তীব্র ও ধারাবাহিক প্রতিবাদ জানানো উচিত ছিল, সেটা জানায়নি।
শেখ হাসিনা সরকার দেশকে অপমানিত করেছিল নজিরবিহীন দমননীতির মাধ্যমে। আর বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার আমাদের অপমান করছে বাংলাদেশের ইতিহাসে সাংবাদিকদের ওপর সবচেয়ে বড় বিচারিক হয়রানি হতে দিয়ে।
সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়াই ১৮ জন সাংবাদিককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আরও লজ্জাজনক বাস্তবতা হলো, অন্তত ২৯৬ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করা হয়েছে—যার অনেকগুলোই হত্যার অভিযোগে—যেসব মামলায় তাদের সম্পৃক্ততার বিষয়ে তদন্তই হয়নি, কিংবা আজ অব্দি কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
সাম্প্রতিক সময়ে সাংবাদিকদের হত্যা মামলায় অভিযুক্ত করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম শীর্ষস্থানে রয়েছে। স্বাধীন ও নৈতিক সাংবাদিকতায় গর্বিত এবং সাংবাদিকদের অধিকার রক্ষায় অঙ্গীকারবদ্ধ সংবাদপত্র হিসেবে এই ঘটনায় আমরা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন।
আইন উপদেষ্টা বলেছেন, সরকার কাউকে মামলা করতে বাধা দিতে পারে না। কিন্তু, আমাদের প্রশ্ন হলো, যেখানে আইন অপব্যবহারের বিষয়টি স্পষ্ট, সেখানেও কি সরকার বাধা দিতে পারে না?
আমাদের বিশ্বাস, কর্তৃপক্ষ চাইলে সহজেই তদন্ত করে দেখতে পারত যে, এই মামলাগুলোর অধিকাংশই প্রমাণ করা প্রায় অসম্ভব। কিছু সাংবাদিকের বিরুদ্ধে দলীয় সাংবাদিকতা বা এমনকি দুর্নীতির অভিযোগ থাকতে পারে এবং এর জন্য তাদের উপযুক্ত আইনে বিচার ও শাস্তি দেওয়া সম্ভব। কিন্তু তাই বলে তাদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দিতে হবে?
২০২৪ সালের ৭ অক্টোবর তথ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিবের নেতৃত্বে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলা পর্যবেক্ষণে একটি কমিটি গঠন করেছিল সরকার। ওই বছরের ২৭ অক্টোবর সাংবাদিকদের প্রতি আহ্বান জানানো হয়, তারা যেন হয়রানির প্রমাণসহ তথ্য জমা দেন। কমিটি ৭২টি মামলার তথ্য সংগ্রহ করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য।
চলতি বছরের ২৮ সেপ্টেম্বর এক বৈঠকে তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলম বলেছেন, ‘একজন সাংবাদিকও যদি প্রতিহিংসামূলক মামলার শিকার হন, সেটার প্রতিবাদ আমাদের করতে হবে। আমরা এমন ৭২ জন সাংবাদিকের নাম পেয়েছি। আমাদের মন্ত্রণালয়ের এখতিয়ার না থাকায় তালিকাটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছি তদন্তের জন্য।’
তার মানে, সেখানেই বিষয়টি আটকে আছে। কমিটি গঠনের পর ১৩ মাস পেরিয়ে গেলেও কোনো অগ্রগতি হয়নি।
চলতি বছর আইন মন্ত্রণালয় একটি অধ্যাদেশ জারি করেছে, যেখানে প্রাথমিক তদন্তে প্রমাণ না পাওয়া গেলে মামলা থেকে অভিযুক্তের নাম বাদ দেওয়ার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে পুলিশকে। আগে এর জন্য ম্যাজিস্ট্রেটের অনুমোদন প্রয়োজন হতো। অথচ, এখন পর্যন্ত কোনো সাংবাদিক এই সুবিধা পাননি।
আজ আমরা আবারও সেই মৌলিক সত্যটি স্মরণ করিয়ে দিতে চাই—যদি একটি গণতান্ত্রিক সমাজ গড়তে চাই, যদি আমাদের নেতারা সত্যিকারের জবাবদিহিমূলক ও স্বচ্ছ সরকার প্রতিষ্ঠায় আগ্রহী হন এবং যদি রাজনৈতিক দলগুলো বিশ্বাস করে যে, আইন দ্বারা ন্যায়ভিত্তিক সমাজ পরিচালিত হবে, কোনো ব্যক্তির ইচ্ছায় নয়—তাহলে স্বাধীন, নৈতিক ও মুক্ত গণমাধ্যম এর জন্য অপরিহার্য শর্ত।
সাংবাদিকদের স্বাধীনতার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। কিন্তু প্রতিটি আমলেই আমাদের সহ্য করতে হয় হয়রানি, অপমান, বন্দিত্ব ও কারাবাস। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, জুলাই সনদেও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা রক্ষার সুস্পষ্ট কোনো অঙ্গীকার নেই।
- মাহফুজ আনাম: সম্পাদক ও প্রকাশক, দ্য ডেইলি স্টার। (সূত্র)

