সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে এক অনুষ্ঠানে জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান বলেছেন, ক্ষমতায় এলে কর্মজীবী নারীদের কর্মঘণ্টা ৮ থেকে কমিয়ে ৫ ঘণ্টা করা হবে। তাঁর ভাষায়, একজন মা সন্তান জন্ম দিচ্ছেন, লালন–পালন করছেন এবং পেশাজীবী হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন। আমারও ৮ ঘণ্টা, তারও ৮ ঘণ্টা—এটা কি অবিচার নয়?
ডা. শফিকুর রহমানের এই মন্তব্য সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। তাঁর বক্তব্যে তিনি নারীকে ‘মা’ ও ‘পেশাজীবী’—এই দুই ভূমিকায় ভারসাম্যের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছেন। তবে সমালোচকেরা প্রশ্ন তুলছেন, নারীর প্রতি ন্যায়বিচার কি সত্যিই কর্মঘণ্টা কমিয়ে দেওয়া, নাকি কর্মক্ষেত্রে সমান সুযোগ, মর্যাদা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করাই বেশি জরুরি?
বিশেষজ্ঞদের মতে, কর্মঘণ্টা কমানো নয়, বরং কর্মপরিবেশে সমতা ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা করাই নারীর প্রকৃত ক্ষমতায়নের পথ। সমাজে নারীর ভূমিকা এখন আর শুধু পরিবারে সীমাবদ্ধ নয়; অর্থনীতি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও প্রশাসনের প্রতিটি ক্ষেত্রে নারীর অবদান গুরুত্বপূর্ণ। তাই কর্মক্ষেত্রে সময় নয়, মূল্যায়নই হওয়া উচিত ন্যায়বিচারের মাপকাঠি।
বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতায়নের আন্দোলন দীর্ঘ, সংগ্রামী ও কঠিন পথ পেরিয়েছে। স্বাধীনতার পর থেকে শিক্ষা, কর্মসংস্থান, রাজনীতি ও সামাজিক অগ্রগতির প্রতিটি ক্ষেত্রে নারীরা নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণ করেছেন। আজ তাঁরা প্রশাসন, উদ্যোক্তা খাত, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী—সব জায়গায় সক্রিয় ভূমিকা রাখছেন।
তবু বাস্তবতা হলো, নারীর অধিকার এখনো পুরোপুরি সুরক্ষিত নয়। পরিবার, সমাজ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কর্মক্ষেত্র—প্রতিটি স্তরে নারীকে বৈষম্য, অবমূল্যায়ন ও কাঠামোগত প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হতে হয়। তাঁদের শ্রমের যথাযথ মূল্যায়ন হয় না, সিদ্ধান্ত গ্রহণে মতামত উপেক্ষিত থাকে, এবং নিরাপদ কর্মপরিবেশের নিশ্চয়তা এখনও অধরাই। তবুও এই বাস্তবতার মধ্যে নারীরা থেমে থাকেননি। প্রতিদিনের প্রতিকূলতার মধ্য দিয়েই তাঁরা নিজেদের অবস্থান দৃঢ় করেছেন এবং সমাজ পরিবর্তনের ধারায় নেতৃত্ব দিয়েছেন। এটি বাংলাদেশের নারীর অবিচল যাত্রা—দৃঢ়তা, সাহস ও আত্মনির্ভরতার স্পষ্ট প্রতিচ্ছবি।
নারীর প্রতি দয়া নয়, প্রয়োজন অধিকারভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গি:
ডা. শফিকুর রহমান বলেছেন, “পুরুষ ৮ ঘণ্টা কাজ করলে নারীরও সমান সময় দেওয়া কি ন্যায্য? আমরা ক্ষমতায় এলে তাঁদের (নারীদের) কর্মঘণ্টা কমিয়ে ৫ ঘণ্টা করব, যাতে মা হিসেবে তাঁরা সন্তানের প্রতি যথাযথ দায়িত্ব পালন করতে পারেন।”
প্রশ্ন হলো, তিনি আসলে কোন মায়েদের কথা বলছেন? যদি এটি শুধু ল্যাকটেটিং মায়েদের জন্য হয়, যারা সন্তান জন্মের পর নির্দিষ্ট সময় দুগ্ধপান করান ও অতিরিক্ত যত্নের প্রয়োজন অনুভব করেন, তবে এটি সহানুভূতিশীল ও প্রশংসনীয় প্রস্তাব। উন্নত অনেক দেশে মাতৃত্বকালীন ছুটি দুই বছর পর্যন্ত, আমাদের দেশে এটি ছয় মাস। সেই প্রেক্ষাপটে, ছুটি শেষে সন্তানের এক বা দুই বছর বয়স পর্যন্ত মায়েদের জন্য দৈনিক পাঁচ ঘণ্টার কর্মঘণ্টা নির্ধারণ করা সত্যিই নারীবান্ধব হতো।
কিন্তু ডা. শফিকুর রহমানের বক্তব্যে কোনো নির্দিষ্টতা নেই। বাস্তবে তিনি ‘মায়েদের’ বলতে সব কর্মজীবী নারীকে বোঝাচ্ছেন। এর ফলে বিষয়টি সহানুভূতির চেয়ে বেশি নারীদের প্রাতিষ্ঠানিক পেশা থেকে ধীরে ধীরে প্রত্যাহারের ইঙ্গিত দেয়। কর্মঘণ্টা কমানোর এই প্রস্তাব নারীর অর্থনৈতিক স্বাধীনতা, কর্মজীবনের সুযোগ এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণে অংশগ্রহণ সীমিত করবে। এটি নতুন ধরনের বৈষম্যের কাঠামো তৈরি করতে পারে।
সময়ের স্রোত উল্টো চলে না। বাংলাদেশি নারীরা অনেক দূর এগিয়েছে। এখন রাজনীতিকদের দায়িত্ব হলো সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা। নারীর প্রতি সহানুভূতি নয়, প্রয়োজন অধিকারভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গি। নারীকে পাঁচ ঘণ্টার কর্মঘণ্টা নয়, দিতে হবে সমান মর্যাদা, নিরাপদ কর্মপরিবেশ, অর্থনৈতিক সুযোগ এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণে অংশগ্রহণের নিশ্চয়তা।
নারীকে কর্মক্ষেত্রে টিকিয়ে রাখার উপযোগী পরিবেশই প্রকৃত সমাধান:
প্রকৃতপক্ষে, এমন প্রস্তাব নারীর ক্ষমতায়ন নয়; বরং তার সক্ষমতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। বাংলাদেশে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে নারী কর্মীদের জন্য ইতিমধ্যে চার থেকে ছয় মাসের মাতৃত্বকালীন ছুটি চালু রয়েছে। অনেক প্রতিষ্ঠান দিবাকালীন শিশু যত্ন কেন্দ্র, ব্রেস্টফিডিং সুবিধা ও ফ্লেক্সিবল কর্মঘণ্টার সুযোগ দিচ্ছে। নীতিনির্ধারণী প্রক্রিয়ায় নারীর সক্রিয় অংশগ্রহণ আজ বাস্তবতা। এই অগ্রগতি দীর্ঘদিনের সংগ্রামের মাধ্যমে অর্জিত হয়েছে।
এমন পরিস্থিতিতে কর্মঘণ্টা কমানোর প্রস্তাব নারীকে ‘কম কর্মক্ষম’ হিসেবে চিহ্নিত করতে পারে। এটি নিয়োগদাতাদের চোখে তাকে অগ্রহণযোগ্য করে তুলবে। ফলে সহানুভূতিমূলক এই প্রস্তাব বাস্তবে নারীর অর্থনৈতিক স্বাধীনতা বিপন্ন করবে। আর অর্থনৈতিক সক্ষমতা হারালে নারী তার স্বনির্ভরতার জায়গা হারায়, সমাজে কণ্ঠস্বর ক্ষীণ হয় এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতাও সীমিত হয়। এভাবে তার নিজস্ব পরিচয়, বিদ্যমানতা ও সত্তা ধীরে ধীরে ক্ষয় পায়।
ডা. শফিকুর রহমান যদি সত্যিই নারীর প্রতি ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে চান, তবে মনোযোগ দেওয়া উচিত নারীবান্ধব কর্মপরিবেশ তৈরিতে, কর্মক্ষেত্রে বৈষম্য ও হয়রানি প্রতিরোধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণে এবং নারীর সমান সুযোগ ও মর্যাদা নিশ্চিতকরণে। প্রকৃত সম্মান ও ন্যায্যতা এখানেই নিহিত—নারীর পূর্ণ অংশগ্রহণে, তার সম্ভাবনা সীমিত করার মধ্যে নয়।
সমান সুযোগ ও ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠার প্রথম শর্ত:
কর্মক্ষেত্রে নারীরা আজও নানা ধরনের বৈষম্য ও হয়রানির শিকার হন। সবচেয়ে বেশি তাঁরা মানসিক নির্যাতনের সম্মুখীন হন। এরপর আসে যৌন নিপীড়ন, বেতনবৈষম্য এবং পদোন্নতিতে বঞ্চনা। সাম্প্রতিক সময়ে কর্মস্থলে যৌন হয়রানির শিকার হয়ে আত্মহত্যার মতো মর্মান্তিক ঘটনাও ঘটেছে। তবু রাজনৈতিক নেতৃত্বের পক্ষ থেকে এখনও কোনো দৃঢ় অবস্থান দেখা যায়নি। একইভাবে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগে নারী কোটা বাতিলের ঘোষণার পরও রাজনৈতিক নীরবতা প্রশ্ন তোলে। অথচ শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষায় নারী শিক্ষকের ভূমিকা কতটা গুরুত্বপূর্ণ, তা আলাদা করে বলার প্রয়োজন নেই।
ডা. শফিকুর রহমান যদি সত্যিই নারীর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতে চান, তবে এসব বাস্তব বৈষম্যের বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান নিতে হবে। কর্মঘণ্টা কমানোর প্রতিশ্রুতি নয়, প্রয়োজন নারীবান্ধব কর্মপরিবেশ, নিরাপত্তা এবং সমান সুযোগ নিশ্চিত করা। ন্যায্যতা আসে সমতার ভিত্তিতে, দয়া বা সহানুভূতি থেকে নয়।
শ্রমবাজারে নারীর বাস্তবতা:
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যমতে, দেশে বর্তমানে নারী কর্মীর সংখ্যা ২ কোটি ৪০ লাখের বেশি। গার্মেন্টস ও কৃষি খাতেই তাদের বড় অংশ নিয়োজিত। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অটোমেশনের কারণে গার্মেন্টস খাতে নারীর অংশগ্রহণ কমছে। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় নারীর ডিজিটাল দক্ষতা উন্নয়ন, নতুন কর্মক্ষেত্র সৃষ্টির পরিকল্পনা এবং কর্মসংস্থান সুরক্ষা প্রয়োজন। তবে এ বিষয়ে কোনো সুস্পষ্ট বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
নারীর কাজ কেবল সন্তান জন্ম দেওয়া বা লালন-পালনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। সন্তান লালন-পালনেও অর্থের প্রয়োজন, আর সেই অর্থ উপার্জন করা নারীর মৌলিক অধিকার। নারীর অর্থনৈতিক সক্ষমতা কেড়ে নেওয়া মানে তাকে ক্ষমতাহীন করা, যা সভ্য সমাজের ন্যায্যতার পরিপন্থী।
সিডও সনদের পূর্ণ বাস্তবায়ন সময়ের দাবি:
বাংলাদেশ ১৯৮৪ সালে জাতিসংঘের ‘নারীর প্রতি বৈষম্য দূরীকরণ সনদ’ (সিডও) অনুমোদন করলেও এখনও কিছু অনুচ্ছেদে সংরক্ষণ রেখেছে। বিশেষত রাজনীতি, নেতৃত্ব ও পারিবারিক আইনের ক্ষেত্রে এই সংরক্ষণ নারীর ক্ষমতায়নের পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ডা. শফিকুর রহমান যদি সত্যিই নারীর মর্যাদা ও ন্যায্যতার কথা বলেন, তবে তাঁর রাজনৈতিক অঙ্গীকারে সিডও সনদের পূর্ণ বাস্তবায়ন থাকা উচিত। আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী নারীর সমান অধিকার নিশ্চিত করা এখন সময়ের দাবি।
সময়কে পিছিয়ে নেওয়া নয়, সময়ের সঙ্গে এগিয়ে চলা:
একটি সমাজে ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠার মানে পেশা কেড়ে নিয়ে নারীকে ঘরে ফেরানো নয়; বরং তাকে আরও সক্ষম করে তোলা। সময়ের সঙ্গে সমাজে লিঙ্গভিত্তিক ভূমিকা পরিবর্তিত হয়। নারী যেমন নেতৃত্বে এগিয়ে আসছে, পুরুষও কেয়ারগিভিংয়ের মতো দায়িত্ব নিচ্ছে। এটাই আধুনিক সমাজের ভারসাম্য।
বাংলাদেশের নারী আজ শিক্ষা, রাজনীতি, প্রশাসন, উদ্যোক্তা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীতেও সমান সাফল্য দেখাচ্ছেন। এই অগ্রযাত্রাকে পিছিয়ে দেওয়ার যেকোনো প্রচেষ্টা দেশের সামগ্রিক অগ্রগতির জন্য প্রতিবন্ধক। ডা. শফিকুর রহমানের উচিত হবে নারীর প্রতি প্রগতিশীল, বাস্তবমুখী ও সময়োপযোগী দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করা।
সময়ের স্রোত উল্টো চলে না। বাংলাদেশি নারীরা অনেক দূর এগিয়েছে। এখন রাজনীতিকদের দায়িত্ব সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা। নারীর প্রতি সহানুভূতি নয়, প্রয়োজন অধিকারভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গি। নারীকে পাঁচ ঘণ্টার কর্মঘণ্টা নয়, দিতে হবে সমান মর্যাদা, নিরাপদ কর্মপরিবেশ, অর্থনৈতিক সুযোগ এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণে অংশগ্রহণের নিশ্চয়তা।
নারী ও পুরুষের সমান অধিকারই প্রকৃত ন্যায্যতার মানদণ্ড। এখানেই নিহিত বাংলাদেশের নারীর ক্ষমতায়ন, ন্যায়বিচার ও টেকসই উন্নয়নের ভবিষ্যৎ।

