নয়া উদারনৈতিক দুনিয়ায় আদর্শ রাষ্ট্র বা ন্যায্য শাসনব্যবস্থার প্রধান কয়েকটি বুলি হচ্ছে ‘আইনের শাসন’, ‘মানবাধিকার’ ও ‘গণতন্ত্র’। বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের ত্রাণসহায়তা ও বিনিয়োগের অন্যতম শর্ত আইনের শাসন। এমনকি রাশিয়া, চীন প্রভৃতি কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থার দেশগুলোও আইনের শাসনের পক্ষে কথা বলে। বস্তুত যেকোনো সরকারের বৈধতার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মাপকাঠি আইনের শাসন।
কিন্তু আইনের শাসন আসলে কী? সহজভাবে বললে ব্যাপারটা এই যে শাসনব্যবস্থা পরিচালিত হবে সবার জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য কিছু সুনির্দিষ্ট নিয়মকানুন বা আইনের অধীন। শাসনকার্য পরিচালিত হবে শুধু আইনমাফিক, আইন সবার জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য, আইনের অনুমোদন ছাড়া কারও অধিকার লঙ্ঘন করা যাবে না, সবাই আইনের সমান সুরক্ষা পাবে ইত্যাদি।
এখানে আইনের শাসন প্রধানত কিছু পদ্ধতি নির্দেশ করে। আইন কীভাবে তৈরি হবে (গণতান্ত্রিক না স্বৈরতান্ত্রিক পদ্ধতিতে), তার উপাদানগুলো কী হবে (মৌলিক অধিকার, ন্যায্যতা, সমতা, ন্যায়বিচার থাকবে কি না)—এসব বিষয়ে কিছু বলে না। এই ধারণায় চরম কর্তৃত্ববাদী সরকারও দাবি করতে পারে যে সে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করেছে; কিছু পদ্ধতি অনুসরণ করে সে স্বৈরতান্ত্রিক সিদ্ধান্তকেও আইনসিদ্ধ করে নিতে পারে।
আইনের শাসনের সবচেয়ে সমাদৃত ধারণায় বলা হয়, আনুষ্ঠানিক আইনি কাঠামোর পাশাপাশি আইন প্রণয়নপ্রক্রিয়ায় জনগণের সম্মতি বা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া থাকতে হবে। এখানে আইনসিদ্ধতার পাশাপাশি বৈধতার ধারণা গুরুত্ব পায়। আনুষ্ঠানিক আইনি কাঠামো ছাড়া গণতন্ত্র বর্মহীন; কারণ, নির্বাহী বিভাগ আইনের পরিধি নিজের ইচ্ছেমতো কমাতে-বাড়াতে পারে। একইভাবে গণতন্ত্র ছাড়াও আনুষ্ঠানিক আইনি কাঠামো বৈধতার সংকটে পড়ে। এখানে নাগরিকের মৌলিক অধিকার কেবল প্রত্যক্ষ আইনের উপাদান নয়, বরং পুরো ব্যবস্থার বৃহত্তর পটভূমি হিসেবে বিবেচিত হবে। স্বাধীন বিচার বিভাগ ও তার জুডিশিয়াল রিভিউর ক্ষমতা হবে ভারসাম্যের কেন্দ্র। প্রকৃতপক্ষে বিচার বিভাগকে এখানে সালিসকার হিসেবে কাজ করার কর্তৃত্ব দেওয়া থাকে।
আইনের শাসনের এই ধারণার সারমর্ম দাঁড়ায়—আইনের শাসনে রাষ্ট্রের যাবতীয় ক্ষমতা আইন-নির্ধারিত আওতা, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও মৌলিক অধিকার অনুযায়ী এবং স্বাধীন ও নিরপেক্ষ আদালতের অধীন কাজ করবে। আইন প্রণীত হবে স্বচ্ছ, জবাবদিহিমূলক, গণতান্ত্রিক ও বহুত্ববাদী প্রক্রিয়ায়; মৌলিক অধিকার পরিপন্থী কোনো আইন প্রণীত হবে না। আইন প্রয়োগকারীদের স্বেচ্ছাচারের বিরুদ্ধে জুডিশিয়াল রিভিউর সুরক্ষা থাকবে; ক্ষমতার পৃথক্করণ, মৌলিক অধিকারের সুরক্ষা, আইনের দৃষ্টিতে সমতা, নিরপেক্ষ আদালতে সহজ, দ্রুততর ও হয়রানিমুক্ত প্রবেশাধিকার থাকবে। সর্বোপরি নাগরিকদের সঙ্গে আচরণের ক্ষেত্রে রাষ্ট্র নিজেও আইন দ্বারা সীমাবদ্ধ থাকবে। বাংলাদেশেও আইনের শাসনের এসব নীতিমালা গৃহীত হয়েছে, পাঁচ দশকের সব শাসকই মুখে মুখে তা প্রতিষ্ঠার কথা বলে এসেছেন। কিন্তু এই আইনের শাসন আসলে আমাদের জন্য কী বয়ে এনেছে আর কী আনতে যাচ্ছে?
২
বাংলাদেশে আইন প্রণয়ন করা হয় জাতীয় সংসদে, জনগণের নির্বাচিত ‘জনপ্রতিনিধি’দের মাধ্যমে। এটা আইন প্রণয়নের আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া মাত্র। আসলে আমাদের আইন প্রণীত হয় সচিবালয়ে, আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায়, পুরোপুরি নির্বাহী বিভাগের প্রযোজনায়। আইনের খসড়া তৈরি করেন আমলারা। ফলে দণ্ডবিধিতে সুস্পষ্ট বিধান থাকার পরও প্রতিটি আইনে আমলাদের জন্য ‘সরল বিশ্বাসে কৃতকর্মের’ জন্য দায়মুক্তির বিধান রাখা হয়। খসড়া তৈরিতে সাহায্য করেন ক্ষমতাসীন দলের অনুগত শিক্ষক-পরামর্শক-বুদ্ধিজীবীরা।
বিলের খসড়া মন্ত্রিসভায় অনুমোদিত হওয়ার পর আইন মন্ত্রণালয়ে যায়। মন্ত্রিসভার অনুমোদন মানেই প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন। তারপর প্রধানত কারিগরি ত্রুটিবিচ্যুতি পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে সংসদে যেতে পারে আইন হিসেবে পাস হওয়ার জন্য। প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনের পর তা সংসদে পাস না হওয়ার কোনো কারণ থাকে না। সংসদের মোট সময়ের মধ্যে আইন প্রণয়নে ব্যয় হয় সর্বোচ্চ ১০-১২ শতাংশ। ২০-৩০ মিনিটেই একটা বিল পাস হয়ে যায়। সেখানে আইন প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় কেবলই ‘হ্যাঁ জয়যুক্ত’ হয়।
জাতীয় সংসদের অধিবেশন না থাকলে বা সংসদ ভেঙে দেওয়া হলে রাষ্ট্রপতি অধ্যাদেশ জারি করেন। কিন্তু রাষ্ট্রপতি যেহেতু ক্ষমতাহীন, তাঁর নামে এই ক্ষমতাও চর্চা করেন প্রধানমন্ত্রী কিংবা অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা। সংসদের পরবর্তী অধিবেশনের সংসদে তা অনুমোদিত হয়। সংসদে গৃহীত আইনের প্রায়োগিক নীতিমালার জন্য প্রণীত হয় বিধি বা প্রবিধিমালা। এগুলো পুরোপুরি আমলাতান্ত্রিক প্রযোজনা। অংশীজনদের মতামত চাওয়া হয়, জনপরিসরে বিভিন্ন তর্কবিতর্ক ওঠে, কিন্তু চূড়ান্ত খসড়ায় সেসবের কোনো প্রতিফলন দেখা যায় না।
৩
আইনের শাসন অনুযায়ী প্রত্যেক নাগরিক আইনের সমান সুরক্ষা পাবেন এবং রাষ্ট্র আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে বৈষম্যহীন হবে, নাগরিকের অধিকার ও মর্যাদাকে ক্ষুণ্ন করবে না। কিন্তু জন্ম-মৃত্যুনিবন্ধন, জমিজমা, ব্যবসার নিবন্ধন, পেনশন উত্তোলন ইত্যাদি ন্যূনতম প্রাথমিক নাগরিক সেবায় হয়রানির শেষ নেই। নাগরিক নিরাপত্তা নেই, মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা নেই। আপনি প্রতিবাদে যাবেন, রাষ্ট্র আপনাকে লাঠিপেটা করবে, গুলি করবে, গ্রেপ্তার করবে, কারাগারে ঢোকাবে; নয়তো গুম-খুন করবে; আবার ‘পালিয়ে গেছেন’ বা ‘জঙ্গি দলে যোগ দিয়েছেন’ বলে আপনাকে এবং আপনার পরিবারকে কালিমালিপ্ত করবে, ভুয়া মামলা দেবে, জামিন চাইলে দেবে না, দিয়ে আবার জেলগেটে নতুন মামলা দেবে। আপনি যাবেন আদালতে, কিন্তু আদালতেও আপনি ন্যায়বিচার পাবেন না। কারণ, কাঠামোটাই বৈষম্যমূলক।
বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের (২০২৫) জরিপ অনুযায়ী, ৮০.১০ শতাংশ নাগরিক মনে করেন, আইনজীবীরা অহেতুক সময় নষ্ট করেন। ৯০ শতাংশ মনে করেন, আদালতের কর্মচারীরা হয়রানি করেন। ৮৪ শতাংশ মনে করেন, কর্মচারীরা ঘুষ চান। আইনজীবীরা আদালত বর্জন করেন, মুলতবি করেন আর করেন রাজনীতি। জামিন না পেলে, পছন্দমতো অর্ডার না পেলে বিচারকদের হুমকি দেন। বিচারকের অনুপাত দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে কম। বিচারকেরা কোর্টে উঠতে দেরি করবেন। মুহুরি, পেশকারদের বকশিশ দিতে হবে। এরপর এক অনন্ত গোলকধাঁধায় ঘুরতে থাকা। কমপক্ষে ১৫ থেকে ১৮টি ধাপ। সমন হতে দেরি হবে, প্রতিপক্ষ বারবার সময় চাইবে, অন্তর্বর্তী আদেশ চাইবে। দিন যাবে, দশক যাবে, উত্তর প্রজন্ম হাল ধরবে, আদালত আপনার নথিও হারিয়ে ফেলবেন, আপনার উত্তর পুরুষ আদালত আর উকিলের চেম্বারের চারপাশে ঘুরতে থাকবে, ৫ বছর, ২০ বছর, ৫০ বছর।
৪
ফৌজদারি বিচারব্যবস্থার প্রবেশদ্বার থানা বা পুলিশ। থানায় জিডি বা অভিযোগ করে প্রতিকার চাইতে হবে। আগে জিডি করতে টাকা দিতে হতো; এখন অনলাইন জিডির কথা বলা হয়, কিন্তু সার্ভার সমস্যা, পুলিশের অনীহা-অসহযোগিতা আপনাকে ভোগাবে। আমলযোগ্য মামলায় অভিযোগ করতে হয়। অভিযোগের ভিত্তিতে পুলিশ তদন্ত করে মামলা গ্রহণ করে। কিন্তু অভিযোগের কোনো রেকর্ড রাখা হয় না বলে পুলিশের স্বেচ্ছাচারিতার সুযোগ থাকে। পুলিশ মামলা নিতে গড়িমসি করবে। মামলা নিলে তদন্ত কর্মকর্তাকে ঘুষ দিতে হবে। তবু তদন্তে হেলাফেলা, সময়ক্ষেপণ চলবে।
থানা মামলা না নিলে কোর্টে নালিশি মামলা দায়ের করতে হয়। আদালত তদন্তের জন্য পুলিশের কাছে পাঠান। এরপর আদালতে পিপির দায়িত্বহীনতা, ঘুষ গ্রহণের প্রবণতা, মিথ্যা বা হয়রানিমূলক মামলা জেনেও সরকারের তাঁবেদার হয়ে জামিনের বিরোধিতা করা। পুলিশ/প্রসিকিউশন সাক্ষী হাজির করতে পারবে না, নানা কারণে মামলা ঝুলতে থাকবে। জামিনের জন্যও খরচ করতে হবে প্রচুর, খরচ করার ক্ষমতা না থাকলে বিনা বিচারে জেলে পচতে হবে। সরকার বা কোনো কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিকার পেতে যেতে হবে উচ্চ আদালতে। এটা ব্যয়বহুল, সাধারণের নাগালের বাইরে।
৫
এর মধ্যে সমস্যা সমাধানে নানা প্রচেষ্টা থাকবে। থাকবে আনুষ্ঠানিক, প্রক্রিয়াগত সংস্কারের উদ্যোগ। বিচারকের সংখ্যা বাড়ানো, পৃথক বিচার বিভাগীয় সচিবালয় প্রতিষ্ঠা। কিছু বাস্তবায়িত হবে, কিছু হবে না। স্বতন্ত্র তদন্ত ও প্রসিকিউশন সংস্থা হবে না। হয়রানিমূলক মামলার জন্য বিশেষ ক্ষমতা আইন হয়তো কিছুদিন ব্যবহৃত হবে না, কিন্তু ‘সন্ত্রাসবিরোধী আইন’ হবে। পুলিশকে একবার বলা হবে, মামলা নাও। হরেদরে মামলা নেবে, বাণিজ্য হবে। আবার বলা হবে, হয়রানিমূলক মামলা বন্ধ করো। সাধারণ নাগরিক মামলা করতে গিয়ে হয়রানির শিকার হবে। কখনো আসামি জামিন পাবে না, কখনো কয়েক ঘণ্টায় কয়েক হাজার জামিন পেয়ে যাবে। এর মধ্যে আমরা শুনতে পাব ‘বিচার বিভাগে ঘোষিত সংস্কার কর্মসূচির প্রায় ৮০ শতাংশ ইতিমধ্যে বাস্তবায়িত হয়েছে’। মানে ‘আইনের শাসন’ বারো আনা প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে!
এটা অবশ্যম্ভাবী। কারণ, আইন ও বিচার বিভাগকে আমরা দেখি পদ্ধতিগত দৃষ্টিকোণ থেকে, যেন–বা পদ্ধতি ঠিক করতে পারলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। এই মানসিকতার কারণে আমরা আইনের শাসনকে রাজনৈতিক-দার্শনিক দৃষ্টিকোণ থেকে, আধুনিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ইতিহাস হিসেবে পাঠ করতে পারি না। ‘আধুনিক রাষ্ট্র’ তৈরিই হয়েছে উপনিবেশায়ন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে, যেখানে রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বকে স্থান দেওয়া হয় জনগণের সার্বভৌমত্বের ওপর। আমাদের রাষ্ট্রক্ষমতার গঠন ও ক্রমবিস্তার পর্যালোচনামূলকভাবে পাঠ করতে পারাই সবচেয়ে জরুরি কাজ।
- রাশেদ রাহম: আইনের ইতিহাস গবেষক। সূত্র: প্রথম আলো

