গত ২২ অক্টোবর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প রাশিয়ার সবচেয়ে বড় দুটি তেল কোম্পানি রোসনেফট ও লুকঅয়েলকে ব্যাপক নিষেধাজ্ঞার আওতায় আনেন। এটি ছিল মস্কোর প্রতি স্পষ্ট বার্তা যে ওয়াশিংটন চাপ বাড়াচ্ছে।
এর ধাক্কা কেবল রাশিয়াতেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। এটি পৌঁছে গেছে সরাসরি নয়া দিল্লিতে। ভারত রাশিয়ার তেলের অন্যতম বড় ক্রেতা, এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার।
ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে ভারত খুব নীরবে রাশিয়ার অন্যতম প্রধান তেল সরবরাহকারী দেশ হয়ে উঠেছে। ২০২২ সালের শুরুতে রাশিয়া থেকে ভারতে অপরিশোধিত তেলের আমদানি দিনে ১ লাখ ব্যারেলের কম ছিল। এ বছর সেটা প্রায় ১৮ লাখ ব্যারেল হয়েছে।
রাশিয়ার তেলের প্রতি ভারতের এই আকর্ষণের কারণটা স্পষ্ট। রাশিয়ার অপরিশোধিত তেল আন্তর্জাতিক দামের তুলনায় ব্যারেলপ্রতি ১০ থেকে ২০ ডলার সস্তা। এতে প্রতি তিন মাসে ভারতের কয়েক বিলিয়ন ডলার সাশ্রয় হয়। এটি ভারতের বাজারে জ্বালানির দাম স্থিতিশীল রাখতে সহায়তা করে।
রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজ, ইন্ডিয়ান অয়েল করপোরেশন ও নায়ারা এনার্জি সস্তায় রাশিয়ার তেল কিনে স্থানীয়ভাবে পরিশোধন করে এবং প্রায়ই ইউরোপে রপ্তানি করে লাভজনক ব্যবসা গড়ে তুলেছে।
তেল ব্যবসার এই মডেলে এখন ব্যাঘাত সৃষ্টি করছে। কারণ, যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি ডিপার্টমেন্ট নির্বাহী আদেশে রোসনেফট বা লুকঅয়েলের সঙ্গে যেসব কোম্পানি, ব্যাংক ও বিমা ব্যবসা করে সবাইকে শাস্তির হুমকি দিয়েছে। ফলে আদেশ অমান্যকারীরা যুক্তরাষ্ট্রের বাজার ও বৈশ্বিক ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে।
জ্বালানি ব্যবসায়ী ও বিমা প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য এই হুমকি এতটাই কঠিন যে তারা রাশিয়ার সঙ্গে চলমান লেনদেন পুনর্বিবেচনা করতে বাধ্য হচ্ছে।
তেল–সংক্রান্ত এই বিবাদ এরই মধ্যে বড় পরিসরে বাণিজ্যিক রাজনীতিতেও ছড়িয়ে পড়ছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সতর্ক করেছেন, রাশিয়ার তেল আমদানি বন্ধ না করলে তিনি ভারতের ওপর ‘বিশাল শুল্ক’ বহাল রাখবেন। যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক এরই মধ্যে ভারতের ওপর বড় ধরনের প্রভাব ফেলেছে। ভারতের সরকারি তথ্য থেকে দেখা যাচ্ছে, সেপ্টেম্বর মাসে যুক্তরাষ্ট্রে ভারতের রপ্তানি ২০ শতাংশের বেশি কমেছে। সে কারণে পর্দার অন্তরালে দুই পক্ষই একটি সমঝোতায় পৌঁছানোর চেষ্টা করছে।
মনে করা হচ্ছে যে ওয়াশিংটন ও নয়া দিল্লি এমন একটি চুক্তির কাছাকাছি পৌঁছে গেছে, যেখানে ভারতের পণ্যের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক ১৫–১৬ শতাংশ পর্যন্ত কমবে। সংবাদে বলা হচ্ছে, শুল্ক ছাড়ের বিনিময়ে ভারত ধারাবাহিকভাবে রাশিয়ার তেল আমদানি কমাতে পারে। এতে ট্রাম্প কূটনৈতিক সাফল্য দাবি করতে পারবেন আর মোদি নিজের দেশে যে বেকায়দা অবস্থায় পড়েছেন, সেটা সামলানোর সুযোগ পাবেন।
ট্রাম্প বারবার করে ভারতীয় প্রতিশ্রুতির বিষয়টির কথা বলছেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত ভারতের দিক থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে নিশ্চিত করা হয়নি; বরং বার্লিনে গ্লোবাল ডায়ালগে ভারতের বাণিজ্যমন্ত্রী বেশ দৃঢ় কণ্ঠেই বলেছেন, ‘ভারত তড়িঘড়ি করে কোনো চুক্তি করবে না অথবা মাথায় বন্দুক থাকা অবস্থায় চুক্তি করবে না।’
ভারতের বাণিজ্যমন্ত্রীর এই মন্তব্য ভারতের মনোভাবকে তুলে ধরে। সেটা হলো ভারত নিজেদের শর্তে সিদ্ধান্ত নেবে, ওয়াশিংটনের চাপে নয়।
বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, যুক্তরাষ্ট্রের চাপ বাড়ার কারণে ভারত রাশিয়ার তেল আমদানি ৩০–৪০ শতাংশ কমাতে পারে। এটি ভারতের জন্য যথেষ্ট লোকসানের কারণ হবে। ভারতকে যদি রাশিয়ার থেকে ব্যয়বহুল তেল মধ্যপ্রাচ্য থেকে আমদানি করতে হয়, তাহলে দেশটির আমদানি খরচে মাসে অতিরিক্ত ১ থেকে দেড় বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার বাড়তে পারে। এতে চলতি হিসাবে ঘাটতি যেমন বাড়বে, ডলারের বিপরীতে রুপিও দুর্বল হবে।
ভারতের ব্যাংক খাতও ঝুঁকির মুখে পড়তে পারে। রুপি–রুবল এবং দিরহাম–রুবল লেনদেন পরিচালনা করা ভারতীয় ব্যাংকগুলোও যুক্তরাষ্ট্রের নজরদারিতে পড়তে পারে। এতে বছরে কমবেশি ৫–৭ বিলিয়ন ডলারের তেল–সংক্রান্ত লেনদেন ব্যাঘাত সৃষ্টি করতে পারে।
ওয়াশিংটনের চাপের মুখে তেলবাণিজ্য যখন সংকুচিত হচ্ছে, তখন ভারত রাশিয়ার সঙ্গে প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে সম্পর্ক শক্তিশালী করছে।
সংবাদে বলা হয়েছে, ভারত এস-৪০০ বিমান প্রতিরক্ষাব্যবস্থা কিনতে রাশিয়ার সঙ্গে প্রায় ১ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলারের চুক্তি করতে যাচ্ছে। নিষেধাজ্ঞার কারণে তেল থেকে রাশিয়ার আয় কমেছে, তাই নতুন অস্ত্র ক্রয় রাশিয়ার জন্য আর্থিক সহায়তা হিসেবে কাজ করবে। একই সঙ্গে এই কৌশলগত নিশ্চয়তা দিচ্ছে যে হাইড্রোকার্বনের বাইরেও দুই দেশের সম্পর্ক টিকে থাকবে।
ভারতের জন্য যুক্তিটা সমানভাবে পরিষ্কার। ভারতের সামরিক সরঞ্জামের প্রায় ৪৫ শতাংশ এখনো মস্কো থেকে আসে। তাই রাশিয়ার সঙ্গে সম্পূর্ণ বিচ্ছেদ বাস্তবসম্মত অথবা কাম্য নয়। পশ্চিমা অস্ত্র সরবরাহকারীদের কাছ থেকে অস্ত্র কিনে ভারত বৈচিত্র্য আনার চেষ্টা করছে। কিন্তু ভারতের সশস্ত্র বাহিনী রাশিয়ার ওপর নির্ভরশীল। এটি ক্রেমলিনকে ওয়াশিংটনের সঙ্গে দর–কষাকষির ক্ষেত্রে সুবিধা করে দেবে।
ভারতের পরবর্তী সিদ্ধান্ত চীনের ওপর অনেকখানি নির্ভর করছে। চীনের রাষ্ট্রীয় তেল কোম্পানি এখন সমুদ্রপথে রাশিয়ার অপরিশোধিত তেলের আমদানি সাময়িকভাবে বন্ধ করেছে। ভবিষ্যতে চীন মধ্যস্থতাকারীদের মাধ্যমে আমদানি চালিয়ে যেতে পারে। চীন যদি সেটা করে, ভারতেরও একই পথ অনুসরণ করার সম্ভাবনা রয়েছে। ভারতের জন্য মার্কিন নিষেধাজ্ঞা মেনে চলা সহজ হবে না। ওয়াশিংটনের দিক থেকে নিষেধাজ্ঞা অমান্য করার অর্থ হচ্ছে, উচ্চ শুল্ক, বাণিজ্যিক দ্বন্দ্ব এবং পশ্চিমা পুঁজিতে প্রবেশাধিকার হ্রাসের ঝুঁকি তৈরি হওয়া।
মোদি সরকার একসঙ্গে অনেক লক্ষ্য পূরণের চেষ্টা করছে। শুল্ক কমানো, জ্বালানি মূল্যের স্থিতিশীলতা, রাশিয়ার সঙ্গে প্রতিরক্ষা অংশীদারত্ব বজায় রাখা। এ ছাড়া ভোটারদের কাছে তাঁকে প্রমাণ করতে হবে যে সিদ্ধান্তগুলো ভারতের স্বার্থ বজায় রেখেই নেওয়া হচ্ছে।
দশকের পর দশক ধরে ভারত প্রতিদ্বন্দ্বী শিবিরের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখতে পেরেছে। ভারত একই সঙ্গে ব্রিকসের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য এবং কোয়াডে কৌশলগত অংশীদার। কিন্তু ট্রাম্প যখন হাতের মুঠো শক্ত করছেন কঠোর আইন প্রয়োগ করছে এবং পুতিন যখন বিশ্বস্ত ক্রেতাদের ওপর আরও নির্ভরশীল হতে চাইছেন, তখন ভারসাম্য বজায় রাখার কাজটা কঠিন হয়ে যাচ্ছে।
রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র দুই পক্ষই ভারতের কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি চায়। ফলে ভারত হয়তো খুব শিগগির সেই কঠিন সিদ্ধান্তের মুখোমুখি হতে হবে, যেটি বহুদিন দেশটি এড়িয়ে চলে এসছে। ভারতকে কোনো একটি পক্ষকে বেছে নিতে হবে।
- ইশাআল জেহরা পাকিস্তানের ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক। এশিয়া টাইমস থেকে সংক্ষিপ্তাকারে অনূদিত (সূত্র)

