পুঁজিবাজারগুলোয় যখন উচ্ছ্বাস লক্ষ্য করা যাচ্ছে, ঠিক তখনই যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে ক্রমবর্ধমান আর্থিক ভঙ্গুরতা সতর্ক সংকেত দিচ্ছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) সম্প্রতি এই উদ্বেগগুলোকে সমর্থন করে আসন্ন সংকটের আশঙ্কা উসকে দিয়েছে।
সংকটের পূর্বলক্ষণগুলো এখন সর্বত্র দৃশ্যমান। দুঃখজনক হলো এগুলো আগের পরিচিত সমস্যার পুনরাবৃত্তি। সম্পদমূল্য এমন মাত্রায় বেড়ে যাচ্ছে, যা কোনোভাবে অর্থনৈতিক মূলনীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। একই সময়ে ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ২০০৮ সালের আর্থিক সংকটের আগে ‘ছায়া ব্যাংক’গুলোর মতোই কার্যকর হচ্ছে।
অন্যদিকে ক্রিপ্টোকারেন্সি বা স্ট্যাবলকয়েনের উত্থান নিয়ন্ত্রিত ব্যাংকগুলোর সঙ্গে এই অস্বচ্ছ ডিজিটাল অর্থব্যবস্থাকে জড়িয়ে দিচ্ছে। বিনিয়োগকারীরাও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) সংক্রান্ত কোম্পানির শেয়ারে আগ্রহ দেখাচ্ছেন। কিন্তু এখানে প্রামাণ্য মুনাফার চেয়ে হাইপ অনেক বেশি। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সতর্কতা এখন আগের চেয়ে বেশি জরুরি। বাজারে উচ্ছ্বাস থাকলেও ঝুঁকি কম নয়।
এ প্রবণতাগুলো একটি আর্থিক বুদ্বুদের চূড়ান্ত ঝুঁকিপূর্ণ পর্যায়ে প্রবেশ করার স্পষ্ট চিহ্ন বহন করে, যেখানে বিনিয়োগকারীর মনোভাবের সামান্য পরিবর্তনও দ্রুত পরিবর্তনের সূচনা হতে পারে। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের গাড়ির যন্ত্রাংশ সরবরাহকারী ফার্স্ট ব্র্যান্ডস এবং সাব-প্রাইম অটো লেন্ডার ট্রাইকালারের পতন হয়েছে। প্রতিষ্ঠান দুটোর লিভারেজ ক্ষমতা ছিল বেশ উঁচু এবং সেগুলো ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিল। এ বিষয়গুলো কাঠামোগত দুর্বলতার প্রাথমিক ইঙ্গিত হতে পারে।
এ ক্রমবর্ধমান ভঙ্গুরতার পেছনে রয়েছে গত এক দশকে বেসরকারি আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর দ্রুত সম্প্রসারণ। ফাইন্যান্সিয়াল স্ট্যাবিলিটি বোর্ড অনুসারে, এ প্রতিষ্ঠানগুলো (যারা খুচরা বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে তহবিল সংগ্রহ করে এবং আগ্রাসী ঋণের মাধ্যমে তাদের অবস্থানকে লিভারেজ করে) এখন বিশ্বের মোট আর্থিক সম্পদের প্রায় অর্ধেকের জন্য দায়ী। তাদের ঝুঁকি গ্রহণের প্রবণতা বাণিজ্য অনিশ্চয়তা এবং নীতিগত অস্থিরতার মধ্যেও সম্পদমূল্য বৃদ্ধিতে সাহায্য করেছে। আর মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের অধীনে দুর্বল আর্থিক নিয়মকানুনগুলোকে আরো শিথিল করার প্রচেষ্টা পরিস্থিতিকে আরো বিপদাপন্ন করেছে।
ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, আরেকটি বড় আর্থিক বিপর্যয় ঘটবে কিনা—সেই প্রশ্ন নয়, প্রশ্ন হলো কখন ঘটবে। তবে বিশ্বের বেশির ভাগ মানুষের জন্য প্রধান উদ্বেগ হলো—যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে উদ্ভূত একটি সংকট উন্নয়নশীল দেশগুলোকে কীভাবে প্রভাবিত করবে।
আর্থিক সংকট মোকাবেলার পূর্ববর্তী উদাহরণগুলো আশাব্যঞ্জক নয়। ২০০৮ সালের সংকট এবং কভিড-১৯ মহামারী উভয়ই দেখিয়েছে যে যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য ধনী অর্থনীতির অস্থিরতা কীভাবে সীমিত রাজস্ব পরিসর এবং বাহ্যিক ধাক্কা মোকাবেলার দুর্বল সুরক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে থাকা দরিদ্র দেশগুলোকে ধ্বংস করে দিতে পারে। সংকট যখন আর্থিক বাজার ছাড়িয়ে যায়, তখন এর ক্ষতি হয় দ্রুত ও সুদূরপ্রসারী। বিনিয়োগ ফুরিয়ে যায়, প্রবৃদ্ধি থমকে যায় এবং বেকারত্ব বেড়ে যায়, যা বিশ্বজুড়ে রফতানি চাহিদা হ্রাস করে এবং পর্যটন ও রেমিট্যান্স থেকে বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহ সংকুচিত করে।
অন্তর্নিহিত মুদ্রার শ্রেণীবিন্যাস এ সমস্যাকে আরো বাড়িয়ে তোলে। ডলারের আধিপত্য নিশ্চিত করে যে চরম অনিশ্চয়তার সময়ে, বেসরকারি মূলধনপ্রবাহ দ্রুত যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে যায়। নিম্ন আয়ের দেশগুলোয় এর ফলে তীব্র মুদ্রা অবমূল্যায়ন এবং ব্যাংকিং সংকট দেখা দেয়। মূলধনপ্রবাহ বন্ধের আশঙ্কায় সরকারগুলো প্রতি-চক্রাকার সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতি অনুসরণ করার ক্ষমতা হারায়, যা কঠিন অর্থনৈতিক সমন্বয়কে আরো কঠিন করে তোলে।
যারা উন্নত দেশগুলোয় রফতানির ওপর ভিত্তি করে তাদের প্রবৃদ্ধি কৌশল তৈরি করেছিল, সেই ঋণগ্রস্ত দেশগুলোর জন্য এ পতন বিশেষভাবে গুরুতর হতে পারে। ট্রাম্পের সংরক্ষণবাদী নীতিগুলো সেই মডেলকে এরই মধ্যে দুর্বল করে দিয়েছে। এর ফলে ঋণের ভারে জর্জরিত দেশগুলো অর্থনৈতিক, ভূরাজনৈতিক এবং জলবায়ুগত ধাক্কার সংমিশ্রণে বিপজ্জনকভাবে উন্মুক্ত হয়ে পড়েছে, যা পরবর্তী বৈশ্বিক আর্থিক সংকটকে সত্যিকারের বিপর্যয়কর ঘটনায় পরিণত করার হুমকি দিচ্ছে। উন্নয়নশীল দেশগুলোকে অবশ্যই এ ঝুঁকিগুলো উপলব্ধি করতে হবে এবং তাদের অর্থনৈতিক স্থিতিস্থাপকতা জোরদার করার জন্য জরুরি পদক্ষেপ নিতে হবে। সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার হওয়া উচিত বাণিজ্যিক সম্পর্কের বহুমুখীকরণ।
আর্থিক স্থিতিস্থাপকতা বাড়াতে উন্নয়নশীল দেশগুলোর উচিত কার্যকর মূলধন ব্যবস্থাপনা সরঞ্জাম গ্রহণ করা এবং আর্থিক তদারকি জোরদার করার মাধ্যমে অস্থির মূলধনপ্রবাহের প্রতি তাদের এক্সপোজার সীমিত করা। এ সুরক্ষাগুলো পরবর্তী সংকট শুরু হওয়ার আগেই কার্যকর করতে হবে। মধ্যম মেয়াদে, বহিরাগত ঋণের ওপর নির্ভরতা কমানো অপরিহার্য, যেমন বিদেশী বিনিয়োগকারীদের পরিচালনার শর্তাবলি নতুন করে সংজ্ঞায়িত করে অস্থিতিশীল মূলধন বহিঃপ্রবাহ রোধ করা।
ট্রাম্প প্রশাসনের মতো পক্ষগুলো তাদের বাণিজ্য অংশীদারদের বিপরীত দিকে—নিয়ন্ত্রণ শিথিল করার দিকে, বিশেষ করে ক্রিপ্টোকারেন্সির—ঠেলে দেয়ার প্রচেষ্টা এ কাজকে অত্যন্ত কঠিন করে তোলে। কিন্তু এ ধরনের চাপগুলোকে প্রতিহত করার মাধ্যমেই উন্নয়নশীল দেশগুলো তাদের নিজেদের দ্বারা তৈরি নয় এমন আরেকটি সংকটে ভেসে যাওয়া এড়াতে পারে।
জয়তী ঘোষ: অর্থনীতিবিদ ও অধ্যাপক, ইউনিভার্সিটি অব ম্যাসাচুসেটস অ্যামহার্স্ট; ক্লাব অব রোমের রূপান্তরমূলক অর্থনীতি কমিশনের সদস্য এবং আন্তর্জাতিক করপোরেট কর সংস্কারের জন্য স্বাধীন কমিশনের কো-চেয়ার।

