বাংলাদেশে সোনার বাজার সম্প্রসারণের জন্য বর্তমান ‘সোনা নীতিমালা’ যুগোপযোগী করা প্রয়োজন। নীতিমালার বাস্তবায়ন কার্যকর করতে সরকারি দপ্তর ও বাংলাদেশ জুয়েলার্স অ্যাসোসিয়েশন (বাজুস) সমন্বয়ে একটি পৃথক উইং গঠন করা উচিত।
নতুন কাঠামো তৈরি করে দেশীয় উদ্যোক্তাদের সঙ্গে নীতিনির্ধারকদের যৌক্তিক সংলাপের মাধ্যমে শুল্ককর ব্যবস্থা সহজ ও সাশ্রয়ী করা সম্ভব। আমদানি প্রক্রিয়া সহজ করা হবে, একই সঙ্গে আমদানিকারকদের নীতি-সহায়তা এবং প্রণোদনা প্রদানের সুযোগও নিশ্চিত হবে। এই বিষয়ে বাজুসের নবনির্বাচিত সভাপতি ও ডায়মন্ড অ্যান্ড ডিভাসের স্বত্বাধিকারী এনামুল হক খান জানান, দেশের সোনার বাজার সম্প্রসারণে এসব পদক্ষেপ জরুরি।
তিনি বলেন, উদ্যোক্তাদের স্বার্থ ও বাজারের চাহিদার মধ্যে সমন্বয় না করলে সোনার বাজারের যথাযথ বিকাশ সম্ভব নয়। সাক্ষাৎকারে তিনি আরও বলেন, “সরকারি নীতিমালা হালনাগাদ করা এবং আমদানিকারকদের সহায়তা বৃদ্ধি করলে বাজারের কার্যক্রম আরও গতিশীল হবে। এতে দেশের অর্থনীতিতেও ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।”
প্রশ্ন: দেশের সোনার বাজারে অস্থিরতা কেন?
এনামুল হক খান: দেশের সোনার বাজারে সাম্প্রতিক অস্থিরতার মূল কারণ হলো আন্তর্জাতিক বাজারে সোনার দামের অস্বাভাবিক ওঠানামা এবং সেই প্রভাবের সঙ্গে আমদানি কাঠামোর সীমাবদ্ধতা। বৈদেশিক বাজারে যখন সোনার দাম হঠাৎ বাড়ে বা কমে, তখন তার সরাসরি প্রভাব আমাদের দেশের বাজারেও পড়ে। বিশ্ববাজারে ডলারের মান বৃদ্ধি, আমদানি ব্যয় ও স্থানীয় মুদ্রার বিনিময়হারও সোনার দামে প্রভাব ফেলে। যেহেতু বাংলাদেশে এখনো সোনার বৈধ আমদানি পুরোপুরি কার্যকর হয়নি, তাই বাজারে সরবরাহ ও চাহিদার ভারসাম্য রক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়ে।
প্রশ্ন: : বাজারের সোনার দাম বেড়ে রেকর্ড করার পর কমেছে, এর অন্যতম কারণ কী?
এনামুল হক খান: সোনার দাম বেড়ে যাওয়া ও কমার বিষয়টি সম্পূর্ণভাবে বৈশ্বিক প্রক্রিয়ার সঙ্গে সম্পর্কিত। বিশ্ববাজারে যখন সোনার দাম হঠাৎ বেড়ে যায় যেমন, যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপে মুদ্রাস্ফীতি, ফেডারেল রিজার্ভের সুদের হার পরিবর্তন, শুল্ক বাণিজ্যযুদ্ধ বা ভূরাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে, তখন এর সরাসরি প্রভাব পড়ে বাংলাদেশের সোনার বাজারেও। সাম্প্রতিক সময়ে আন্তর্জাতিক বাজারে সোনার দাম একাধিকবার রেকর্ড সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছেছিল। ফলে স্থানীয় বাজারে ডলারের মানের পরিবর্তন, সরবরাহ কমে যাওয়ার কারণে সোনার দাম রেকর্ড উচ্চতায় পৌঁছেছিল। পরবর্তী সময়ে আন্তর্জাতিক বাজারে যখন সোনার দাম কিছুটা স্থিতিশীল হয় তখন আমাদের স্থানীয় বাজারেও স্বাভাবিকভাবেই মূল্য সংশোধন করা হয়।
প্রশ্ন: দেশ থেকে সোনা চোরাচালান হচ্ছে কেন?
এনামুল হক খান: আমাদের দেশকে সোনা চোরাচালানের রুট হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে, এতে আন্তর্জাতিক সিন্ডিকেট জড়িত। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে সোনার বার্ষিক চাহিদা ৭০০ টন। এই বিপুল চাহিদা পূরণের পাশাপাশি অধিক মুনাফার জন্য ভারতের ব্যবসায়ীরা বাংলাদেশকে সোনা চোরাচালানের রুট হিসেবে ব্যবহার করছে। অন্যদিকে বাংলাদেশের স্থানীয় কার্ব মার্কেট পুরোটাই ভারতের ওপর নির্ভরশীল। এ ছাড়া বিলাসবহুল কাপড়, উন্নত মানের কাগজ ও প্রসাধনসামগ্রী আন্ডার ইনভয়েসের মাধ্যমে স্থানীয় ব্যবসায়ীরা দেশের বাজারে নিয়ে আসেন। সোনা মূল্যবান ধাতু ও সহজে বহনযোগ্য হওয়ায় সোনার মাধ্যমে সব পণ্যের মূল্য পরিশোধ করা হয়। সীমান্ত ও বিমানবন্দরে দুর্বল নজরদারি থাকায় চোরাকারবারিরা সুযোগ নিয়ে থাকে।
প্রশ্ন: : চোরাচালান বন্ধ করার জন্য কী কী করা উচিত?
এনামুল হক খান: চোরাচালান বন্ধের জন্য সোনা আমদানি সহজ করা উচিত। উন্নত মানের ফ্যাক্টরি স্থাপনের জন্য দেশীয় উদ্যোক্তাদের উৎসাহী করার জন্য সোনা খাতের সংশ্লিষ্ট মেশিনারিজ, কাঁচামাল আমদানিতে অসম শুল্ক-করহার হ্রাস করা উচিত। সোনা আমদানি প্রক্রিয়া সহজলভ্য করার পাশাপাশি সোনা খাত সম্পর্কিত অপ্রয়োজনীয় জটিলতা ও বিধিনিষেধ পরিহার করা উচিত। আইনের কঠোর অনুশাসন পালনসহ চোরাচালানের সঙ্গে সম্পৃক্ত সিন্ডিকেটের নেতাদের বিচারের আওতায় আনতে হবে। সীমান্তে ও কাস্টমস কর্মকর্তাদের দক্ষতা বৃদ্ধি, আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার এবং আইনের যথাযথ প্রয়োগ করতে হবে।
প্রশ্ন: : সোনা আমদানির অনুমতি থাকা সত্ত্বেও কেন আমদানি হচ্ছে না? কেন অসুবিধায় পড়তে হচ্ছে?
এনামুল হক খান: সোনা আমদানিতে শুল্ক-কর তুলনামূলক কম হওয়া সত্ত্বেও আমদানি প্রক্রিয়া অত্যন্ত জটিল। আমদানিকারকরা সোনা আমদানির জন্য অনুমতির আবেদন করা থেকে কাস্টমস হাউস থেকে সোনা খালাস করতে ২৫-৩৫ দিন সময় লাগে। এই সময়ের মধ্যে আন্তর্জাতিক বাজারে সোনার দাম ন্যূনতম ২০০ ডলারের পরিবর্তন হয়ে থাকে। অন্যদিকে আমদানি-পরবর্তী সোনা স্থানীয় বিক্রেতাদের কাছে বিক্রি করার ক্ষেত্রে অপ্রয়োজনীয় ভ্যাটের বোঝা আমদানিকারক এবং খুচরা বিক্রেতাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়। সোনা প্রক্রিয়াকরণের প্রত্যেক ধাপে একই পরিমাণে ভ্যাট সংযুক্ত করা এবং ভ্যাট রেয়াত না থাকার কারণে আমদানি করা সোনার মূল্য বেশি হয়ে থাকে। লাইসেন্সপ্রাপ্ত আমদানিকারকের সংখ্যা কম ও বৈদেশিক মুদ্রার সংকট থাকার কারণে ব্যবসায়ীরা আমদানিতে অনীহা প্রকাশ করে থাকেন।

