অন্তর্বর্তী সরকার সম্প্রতি সিদ্ধান্ত নিয়েছে ৪৭ হাজার বেসরকারি স্কুল-কলেজ, হাসপাতাল ও ক্লিনিকে নেট মিটারের মাধ্যমে সোলার প্যানেল স্থাপন করা হবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন এটি সময়োপযোগী এবং দেশের সৌরবিদ্যুৎ ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে সহায়ক।
নেট মিটারিং সিস্টেমের মাধ্যমে দিনে উৎপাদিত অতিরিক্ত বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যাবে। সোলার প্যানেল স্থাপনকারী প্রতিষ্ঠান অতিরিক্ত বিদ্যুতের জন্য অর্থ পাবেন। রাতের সময় সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন না হওয়ার কারণে প্রতিষ্ঠানগুলো জাতীয় গ্রিড থেকে বিদ্যুৎ কিনবে। মাস শেষে নেট মিটারের মাধ্যমে বিক্রীত সৌরবিদ্যুতের মূল্য এবং রাতের বিদ্যুতের খরচ সমন্বয় করা যাবে। যদি পাওনা বেশি হয়, পিডিবি ব্যবহারকারীকে অর্থ প্রদান করবে। আর যদি দেনা বেশি হয়, ব্যবহারকারী সেই অতিরিক্ত অর্থ পরিশোধ করবেন।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলছেন, বাংলাদেশের জন্য সৌরবিদ্যুৎ সবচেয়ে উপযোগী। তিনি আরও জোর দিয়ে বলেছেন যে দেশে জমির অভাব নিয়ে ধারণা ভুল। রেলওয়ের নিজস্ব জমি ও মহাসড়কের পাশে জায়গা ব্যবহার করে ভবিষ্যতে সরকারি সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্প গড়ে তোলা সম্ভব।
তিনি মনে করছেন, বেসরকারি স্কুল-কলেজ-হাসপাতাল-কলিনিকে সোলার প্যানেল স্থাপনের ব্যবস্থা বাস্তবায়ন হলে বাংলাদেশের সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যর্থতা দ্রুত কাটিয়ে ওঠা সম্ভব। আমি তার সঙ্গে একমত, ২০৩০ সালের মধ্যে ১০ হাজার মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব যদি এ বিষয়ে যথাযথ অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। এছাড়া, আমি সম্ভাব্য অন্যান্য স্থানের তালিকাও দেব যেখানে সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপন করা যেতে পারে।
সৌরবিদ্যুতের প্রতি অবহেলা আমার কাছে মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়। বাংলাদেশে এটি বিদ্যুতের প্রধান উৎসে পরিণত করা এখন সময়ের দাবি। সম্প্রতি হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ ২০১০ সালের ‘দ্রুত বিদ্যুৎ সরবরাহ বিশেষ আইন’ (দায়-অব্যাহতি অধ্যাদেশ) বাতিল ঘোষণা করেছে। আমরা আশা করি, অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত টাস্কফোর্সের প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে ডিজেল ও ফার্নেস অয়েল চালিত রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ প্লান্টের দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যবস্থার সমস্যার সমাধান হবে।
বাংলাদেশের ‘সাসটেইনেবল অ্যান্ড রিনিউয়েবল এনার্জি ডেভেলপমেন্ট অথরিটি’ তাদের ন্যাশনাল সোলার এনার্জি রোডম্যাপে ৩০ হাজার মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। এর মধ্যে ১২ হাজার মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ ছাদভিত্তিক সোলার প্যানেল থেকে আহরণের পরিকল্পনা করা হয়েছে। কিন্তু রোডম্যাপ ঘোষণার পরও এ টার্গেট বাস্তবায়নের জন্য যথাযথ কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়নি।
দেশের বড় শহর ও মফস্বল এলাকার প্রাইভেট প্রতিষ্ঠান ও বসতবাড়ির ছাদ ব্যবহার করে সাত-আট হাজার মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন অসম্ভব নয়। এর জন্য প্রয়োজন সোলার প্যানেল ও ব্যাটারির ভর্তুকি-দাম কর্মসূচি, সৌরযন্ত্রপাতির ওপর শুল্ক হ্রাস এবং যুগোপযোগী ‘নেট মিটারিং’ পদ্ধতি চালু করা।
ভারতের উদাহরণ অনুসরণ করলে এ বিষয় আরও বাস্তবসম্মত হয়ে উঠবে। ভারতের ‘প্রধানমন্ত্রীর সূর্যোদয় যোজনা’ বা ‘পিএম রুফটপ সোলার যোজনা’-তে সাধারণ নাগরিকরা বাড়ির ছাদে তিন কিলোওয়াট সোলার প্যানেল মাত্র ৪৭ হাজার রুপি খরচে স্থাপন করতে পারছেন। সরকারের পক্ষ থেকে ১৮ হাজার রুপি ভর্তুকি দেওয়া হচ্ছে, বাকিটা ব্যবহারকারী খরচ করবেন। ইউটিউবে প্রকাশিত বিবরণ অনুযায়ী, এক কোটি পরিবার এই যোজনার আওতায় আনা হবে। আমার মনে হয়েছে, এই ভারতীয় মডেল সরাসরি বাংলাদেশে প্রয়োগযোগ্য। দেশের ছাদভিত্তিক সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়াতে এটি কার্যকর পথ হতে পারে।
বাংলাদেশে বর্তমানে চারটি আমদানীকৃত কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ প্লান্ট নির্মাণ ও বাস্তবায়ন হয়েছে। এগুলো হলো পায়রা, রামপাল, মাতারবাড়ী এবং বাঁশখালী বিদ্যুৎ কেন্দ্র। প্রত্যেকটি মেগা প্রকল্প থেকে মোট ৫ হাজার ২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হওয়ার কথা।
কিন্তু পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নের মধ্যে বাংলাদেশের এবং বিশ্বের জ্বালানি খাতে বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে কয়লার আন্তর্জাতিক দাম বেড়ে যায়। সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে ধস বাংলাদেশকে কঠিন পরিস্থিতিতে ফেলেছে। ফলে এই বাড়তি দামে কয়লা আমদানির সক্ষমতা অনেক সংকুচিত হয়েছে। ২০২৪ সালের আগস্ট থেকে বাংলাদেশ কঠোর আমদানি নিয়ন্ত্রণ নীতি বাস্তবায়ন করছে। এর লক্ষ্য হলো বাণিজ্য ঘাটতি ও কারেন্ট অ্যাকাউন্টের ভারসাম্য ঠিক রাখা। কিন্তু এর ফলে নির্মাণ সম্পন্ন হওয়া সত্ত্বেও কয়লার অভাবে এসব বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রায়ই বন্ধ থাকতে হচ্ছে।
এই পরিস্থিতিতে আমদানীকৃত কয়লানির্ভর বিদ্যুতের মেগা প্রকল্প বাংলাদেশের জন্য বড় বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হলো ভারতের আদানি গ্রুপ থেকে অন্যায্য শর্তে বিদ্যুৎ আমদানির চুক্তি। এই চুক্তি অনুসারে বাংলাদেশকে সর্বোচ্চ ১ হাজার ৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কিনতে হবে আদানির ঝাড়খন্ডের গড্ডা প্রকল্প থেকে। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার এখনো এই চুক্তি থেকে বের হওয়ার উপায় খুঁজছে। বাংলাদেশে আমদানীকৃত এলএনজির ওপর নির্ভরশীলতা বিদ্যুৎ উৎপাদনকে বড়সড় বিপদে ফেলেছে। ডলার সংকটের কারণে এলএনজি আমদানি কমে যাওয়ায় অনেক এলএনজি চালিত প্লান্ট বন্ধ আছে।
দৈনিক উৎপাদন সীমিত হয়ে এখন ১৩-১৪ হাজার মেগাওয়াটে আটকে রয়েছে, যদিও দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্যাপাসিটি প্রায় ২৭ হাজার মেগাওয়াট। এই সংকটের মূল কারণ হলো আমদানীকৃত এলএনজিনির্ভর নীতি। সঙ্গে কয়লানির্ভর মেগা প্রকল্পগুলোর জটিলতা এই সমস্যাকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। ওয়াকিবহাল মহল মনে করে, সাবেক সরকার কিছু প্রভাবশালী এলএনজি আমদানিকারককে সুবিধা দেওয়ার জন্য নীতি গ্রহণ করেছিল। ফলে গ্যাস অনুসন্ধান ও সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন যথাযথ অগ্রাধিকার পায়নি। দেশের স্থলভাগে গত ১৪ বছরে কয়েকটি ছোট গ্যাসকূপ ব্যতীত উল্লেখযোগ্য তেল-গ্যাস ক্ষেত্রের সন্ধান পাওয়া যায়নি। ভোলা গ্যাস থাকলেও তা দেশের মূল ভূখণ্ডে আনার পাইপলাইন এখনও চালু হয়নি।
২০১২ ও ২০১৪ সালে মিয়ানমার ও ভারতের বিরুদ্ধে মামলায় জিতে বাংলাদেশ ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটার সমুদ্রসীমার নিয়ন্ত্রণ পেয়েছে। কিন্তু তারপরও ১০-১২ বছরে সমুদ্রে গ্যাস-অনুসন্ধান চালানো হয়নি। কয়েক মাস আগে সমুদ্রসীমায় তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য পেট্রোবাংলা আন্তর্জাতিক টেন্ডার আহ্বান করেছিল, তবে সাড়া পাওয়া যায়নি।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, বাংলাদেশের সেন্ট মার্টিনের কাছে সমুদ্রেও গ্যাস পাওয়া সম্ভব। কারণ মিয়ানমার সেখানে ইতোমধ্যেই পাঁচ টিসিএফের বেশি গ্যাস আহরণ করছে। একই ভূতাত্ত্বিক কাঠামো বাংলাদেশের অংশেও আছে। ভারতের অন্ধ্র প্রদেশের উপকূলের কাছে বঙ্গোপসাগরের গোদাবরী বেসিনেও ইতোমধ্যেই বিশাল গ্যাস ও তেলক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়েছে।
দেশের বিদ্যুৎ খাতকে জীবাশ্ম জ্বালানিনির্ভরতা থেকে মুক্ত করতে ভারতের ‘প্রধানমন্ত্রী সূর্যোদয় যোজনা’ অবিলম্বে বাংলাদেশে চালু করার প্রয়োজন অনুভব করছি। বাড়ির মালিকদের জন্য এই ভর্তুকি কর্মসূচি তাদেরকে বাড়ির ছাদে সোলার প্যানেল স্থাপনে উৎসাহিত করবে। গণচীন, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, ভারত, ফিলিপাইন এবং জার্মানি ছাদভিত্তিক সৌর বিদ্যুৎ উৎপাদনে চমকপ্রদ সাফল্য অর্জন করেছে। সাফল্যের মূল কারণ হলো সোলার প্যানেল ও ব্যাটারির জন্য সুনির্দিষ্ট ভর্তুকি এবং ‘নেট মিটারিং’ প্রযুক্তি স্থাপনের প্রণোদনা। এই প্রযুক্তি গণচীন থেকে সুলভে আমদানি করা যায়। তবে বাংলাদেশে এ ক্ষেত্রে অগ্রগতি খুবই নগণ্য।
রূপপুর পরমাণু শক্তি কেন্দ্র স্থাপনের জন্য আমরা ১ লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগ করছি। এর মাধ্যমে ২০২৫ সালের মধ্যে ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের আশা করা হচ্ছে। কিন্তু ছাদভিত্তিক সৌরবিদ্যুৎকে অগ্রাধিকার দিলে সমান বিদ্যুৎ উৎপাদনের ব্যয় রূপপুর পারমাণবিক কেন্দ্রের অর্ধেকও হতো না। সৌরবিদ্যুৎ সবচেয়ে পরিবেশবান্ধব এবং ঝুঁকিমুক্ত প্রযুক্তি।
সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, এক ইউনিট সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ গণচীন, ভিয়েতনাম ও থাইল্যান্ডে বাংলাদেশী ১০ টাকার নিচে নেমে এসেছে। ১৭ নভেম্বর ২০২৩ তারিখে দ্য ডেইলি স্টার পত্রিকায় প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, ব্লুমবার্গের এক গবেষণায় দেখানো হয়েছে যে ২০২৫ সালের পর সৌরবিদ্যুতের উৎপাদন খরচ অন্যান্য বিকল্পের তুলনায় বাংলাদেশেও কমে আসবে। ২০৩০ সালে এক মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুতের উৎপাদন খরচ হবে মাত্র ৪২ ডলার, যেখানে এলএনজিচালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ৯৪ ডলার এবং কয়লাচালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ১১৮ ডলার পড়বে।
বাংলাদেশে সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনে খালি জায়গার অভাবের ধারণা ঠিক নয়। আমার প্রস্তাব, বঙ্গোপসাগরে জেগে ওঠা চরাঞ্চল, সমুদ্র-উপকূল এবং নদ-নদী ও খালগুলোর দুপারে সোলার প্যানেল স্থাপনের সম্ভাবনা খতিয়ে দেখা হোক। বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের সীমানায় যে কয়েকশ চরাঞ্চল গড়ে উঠছে, সেখানে জনবসতি তৈরি হওয়ার আগেই বড় বড় সৌরবিদ্যুৎ ও বায়ুবিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপন করা সম্ভব। এভাবে আগামী চার-পাঁচ বছরের মধ্যে কয়েক হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যেতে পারে।
সাম্প্রতিক সোশ্যাল মিডিয়া রিপোর্টে বলা হয়েছে, জার্মানি নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদন খাতে বাংলাদেশকে আর্থিক ও কারিগরি সহায়তা দিতে প্রস্তুত। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, দেশের বিশাল সমুদ্র-উপকূলে একই সঙ্গে সৌর ও বায়ুবিদ্যুৎ উৎপাদন প্লান্ট স্থাপন করলেই জমির তুলনামূলক স্বল্পতার সমস্যা সমাধান করা সম্ভব হবে।
চরাঞ্চলগুলোতে মানুষ বসতি স্থাপন করেনি, তাই ভূমি অধিগ্রহণে কোনো ঝামেলা হবে না। উৎপাদিত বিদ্যুৎ সাবমেরিন কেবলের মাধ্যমে দেশের মূল গ্রিডে সহজেই আনা সম্ভব। ডেনমার্কও সমুদ্র-উপকূলে ১৩০০ মেগাওয়াট বায়ুবিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য বিনিয়োগ প্রস্তাব দিয়েছে। এটি অবিলম্বে গ্রহণ করা উচিত।
নদ-নদী দুপারের চর, বঙ্গোপসাগরের নতুন চর এবং সমুদ্র-উপকূলে বড় বড় সৌর ও বায়ুবিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপন করলে দেশের বিদ্যুতের চাহিদার অধিকাংশই নবায়নযোগ্য উৎস থেকে আহরণ করা সম্ভব হবে। এর ফলে আমদানীকৃত কয়লা ও এলএনজির ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা থেকে দেশ মুক্তি পাবে।
ড. মইনুল ইসলাম: সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি ও অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। সূত্র: বনিক বার্তা

