প্রশ্ন একটিই। কিন্তু এর ভেতর লুকিয়ে আছে সংবিধান, রাষ্ট্রব্যবস্থা, রাজনীতি ও জনগণের ভবিষ্যতের অজস্র সূক্ষ্ম সুতার টান। প্রধান উপদেষ্টার ঘোষণার পর চারটি মূল প্রস্তাব সামনে এসেছে। প্রতিটির অন্তরালে আছে সংস্কারের ইচ্ছা। তবে একই সঙ্গে কিছু জটিল প্রশ্নও—জনগণ কি এসব বুঝতে পারবে, নাকি বিভ্রান্ত হবে?
বাংলাদেশ বর্তমানে এক ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। একদিকে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন, অন্যদিকে সে নির্বাচনের দিনই অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে গণভোট। কিন্তু যে প্রস্তাবগুলোর প্রেক্ষিতে গণভোটের প্রশ্ন করা হয়েছে, তা নিয়ে মানুষের মনে ঘুরপাক খাচ্ছে নানা প্রশ্ন।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে ঘোষণা করেছেন জুলাই সনদের আলোকে গণভোটের প্রশ্ন। প্রশ্নটি হবে এ রকম—
‘আপনি কি জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ ২০২৫ ও জুলাই জাতীয় সনদে লিপিবদ্ধ সংবিধান সংস্কার সম্পর্কিত নিম্নলিখিত প্রস্তাবগুলোর প্রতি আপনার সম্মতি জ্ঞাপন করছেন?’
প্রশ্ন একটিই। কিন্তু এর ভেতর লুকিয়ে আছে সংবিধান, রাষ্ট্রব্যবস্থা, রাজনীতি ও জনগণের ভবিষ্যতের অজস্র সূক্ষ্ম সুতার টান। প্রধান উপদেষ্টার ঘোষণার পর চারটি মূল প্রস্তাব সামনে এসেছে। প্রতিটির অন্তরালে আছে সংস্কারের ইচ্ছা। তবে একই সঙ্গে কিছু জটিল প্রশ্নও—জনগণ কি এসব বুঝতে পারবে, নাকি বিভ্রান্ত হবে? প্রস্তাবগুলো একে একে বিশ্লেষণ করে দেখা যাক।
ক) নির্বাচনকালীন সময়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার, নির্বাচন কমিশন ও অন্যান্য সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান জুলাই সনদে বর্ণিত প্রক্রিয়ার আলোকে গঠন করা হবে।
প্রথম প্রস্তাবটি জনগণের কাছে তুলনামূলকভাবে সহজবোধ্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান গঠন প্রক্রিয়া। নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার—শব্দবন্ধটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক অভিধানে অনেক পুরনো। জনগণ জানে এর মানে নিরপেক্ষতা, জানে এর মানে রাজনৈতিক সংঘর্ষ থেকে স্বস্তি।
তবে এ প্রস্তাবে বলা হয়েছে ‘জুলাই সনদে বর্ণিত প্রক্রিয়া’ অনুযায়ী প্রতিষ্ঠান গঠনের কথা। এখানে সমস্যা হলো সনদটি সাধারণ মানুষ বিস্তারিত জানেন না, সেটি এখনো পুরোপুরি প্রচারিত হয়নি। তাই ভোটার বুঝবে কি করে যে সে ‘হ্যাঁ’ বলার মাধ্যমে কোন প্রক্রিয়াকে অনুমোদন দিচ্ছে? স্বচ্ছ ব্যাখ্যা ও গণশিক্ষা ছাড়া এ অংশ বিভ্রান্তি বাড়াবে।
খ) আগামী সংসদ হবে দুই কক্ষ বিশিষ্ট। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলগুলোর প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে ১০০ জন সদস্যবিশিষ্ট একটি উচ্চকক্ষ গঠিত হবে এবং সংবিধান সংশোধন করতে হলে উচ্চকক্ষের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের অনুমোদন দরকার হবে।
দ্বিকক্ষ সংসদ বাংলাদেশের জন্য একেবারে নতুন ধারণা। উন্নত গণতান্ত্রিক দেশগুলোয় এটি ভারসাম্য রক্ষার উপায়। কিন্তু এ দেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় এটি কতটা কার্যকর হবে, সেটি এখনই বলা মুশকিল।
১০০ সদস্যের উচ্চকক্ষ ভোটের অনুপাতে গঠনের প্রস্তাবটি কিছুটা ইতিবাচক, এতে ছোট দলগুলোর প্রতিনিধিত্বের সুযোগ বাড়বে। তবে কিছু জটিলতাও দেখা দিতে পারে। আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাস থেকে সামাজিক বা পারিবারিক জীবনে তাকালে আমরা দেখতে পাই, তিনজন মানুষ কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে গেলেও একমত হতে পারে না। সেখানে জাতীয় ইস্যুতে উচ্চ ও নিম্নকক্ষ একমত হওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। যদি দুই কক্ষ একমত না হয়, সেক্ষেত্রে তাহলে সিদ্ধান্তগুলোর কী হবে? বিশেষ করে ইসলামিক দলগুলোর সঙ্গে অন্যান্য দল ও সাধারণ মানুষের আদর্শগত, আচরণগত পার্থক্য অনেক। সেক্ষেত্রে যেকোনো সংস্কার, নীতিনির্ধারণ বা আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত গ্রহণে জটিলতা দেখা দেবে।
একই বিষয় এ প্রস্তাবের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। শিক্ষাগত ও রাজনৈতিক সচেতনতার বর্তমান স্তরে সাধারণ মানুষ কি পুরোপুরি জানে বা বোঝে ‘দুই কক্ষ’ মানে কী বা ‘সংবিধান সংশোধনে উচ্চকক্ষের অনুমোদন’ কেন প্রয়োজন? এ প্রস্তাব তাই বাস্তবে এক ধরনের সাংবিধানিক জটিলতা তৈরি করতে পারে, যদি জনগণের মাঝে পর্যাপ্ত ব্যাখ্যা না পৌঁছায়।
গ) সংসদে নারীর প্রতিনিধি বৃদ্ধি, বিরোধী দল থেকে ডেপুটি স্পিকার ও সংসদীয় কমিটির সভাপতি নির্বাচন, প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ সীমিতকরণ, রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বৃদ্ধি, মৌলিক অধিকার সম্প্রসারণ, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও স্থানীয় সরকারসহ বিভিন্ন বিষয়ে যে ৩০টি প্রস্তাবে জুলাই জাতীয় সনদে রাজনৈতিক দলগুলো ঐকমত্য হয়েছে, সেগুলো বাস্তবায়নে আগামী নির্বাচনে বিজয়ী দলগুলো বাধ্য থাকবে।
এ অংশ সবচেয়ে ব্যাপক ও আকর্ষণীয়—নারীর প্রতিনিধি বৃদ্ধি, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার ভারসাম্য, স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করা ইত্যাদি। শুনতে নিখুঁত এক গণতান্ত্রিক স্বপ্নের নকশা হলেও এখানেও প্রশ্ন—‘বিজয়ী দলগুলো বাধ্য থাকবে’ এ কথার মধ্য দিয়ে নির্দিষ্ট কয়েকটি দলের ইচ্ছার বাস্তবায়ন কি হচ্ছে না? তার চেয়ে বড় প্রশ্ন, বিরোধী দল থেকে ডেপুটি স্পিকার ও সংসদীয় কমিটির সভাপতির মতো গুরুত্বপূর্ণ পদে অনির্বাচিত দল থেকে নির্বাচন করাটা সাধারণ জনগণ কি মেনে নেবে? কেননা জনগণ যার নেতৃত্ব পছন্দ করবে, তাকে ভোট দিয়েই বিজয়ী করবে। এছাড়া যে ত্রিশটি প্রস্তাব রয়েছে তার সুবিধা-অসুবিধা বা কার্যকারিতা শিক্ষিত ভোটার হয়তো বুঝবে। কিন্তু প্রান্তিক মানুষ, অশিক্ষিত বা রাজনৈতিকভাবে কম সচেতন মানুষ না বুঝে ভোট দিলে কি সেটা গণমানুষের ইচ্ছার প্রতিফলন আদৌ হবে?
ঘ) জুলাই সনদে বর্ণিত অন্যান্য সংস্কার রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিশ্রুতি অনুসারে বাস্তবায়ন করা হবে।
শেষ প্রস্তাবটি সবচেয়ে বিমূর্ত। এখানে বলা হয়েছে, ‘রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিশ্রুতি অনুসারে অন্যান্য সংস্কার বাস্তবায়ন করা হবে’। অর্থাৎ যা-ই হোক, সেটি নির্ভর করবে রাজনৈতিক দলের কথায়। এ অংশে জনগণের ভূমিকা প্রায় অদৃশ্য। গণভোটে ‘হ্যাঁ’ দিলে মানুষ আসলে অজানা কিছু সংস্কারের প্রতিও হ্যাঁ বলবে, যা পরবর্তী সময় পরিবর্তনযোগ্য বা ব্যাখ্যাতীত হতে পারে। সচেতনতা কম থাকা জনগণের জন্য এটি এক বিপজ্জনক ধোঁয়াশা তৈরি করতে পারে। অন্য দিকে রাজনৈতিকভাবে সচেতন ব্যক্তির জন্য এটি একটি সমস্যাজনক পরিস্থিতি। কেননা রাজনৈতিকভাবে সচেতন ব্যক্তিদের অনেকেই কোনো দলের সঙ্গে যুক্ত নেই বা দলগুলোর সব আদর্শ, নীতির সঙ্গে একমত নন। তারা কিসের ভিত্তিতে তাদের ভোট দেবেন?
উল্লিখিত চারটি প্রস্তাবনা বিশ্লেষণ করলে বেশ কয়েকটি সমস্যাই সামনে আসে। গণভোটে যেহেতু সরাসরি জনগণের সিদ্ধান্তে রাষ্টের গুরুত্বপূর্ণ আইন, নীতি ও সংস্কার হয় এবং জুলাই জাতীয় সনদেও সংবিধান সংস্কারের মতো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়সহ আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় অন্তর্ভুক্ত, সেহেতু সর্বস্তরের মানুষের বোধগম্যতার প্রশ্নই এখন সবচেয়ে বড়। বাংলাদেশের ভোটার সমাজ এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি রাজনৈতিকভাবে সংবেদনশীল, সচেতন হলেও সাংবিধানিক পরিভাষা এখনো তাদের কাছে দুরূহ, বিশেষ করে মেট্রোপলিটনের বাইরের জনগণের কাছে। ‘দ্বিকক্ষ’, ‘সংবিধান সংস্কার পরিষদ’ এসব শব্দ তাদের কাছে বিমূর্ত এক প্রশাসনিক গোলকধাঁধা।
দ্বিতীয়ত, যে চারটি মূল প্রস্তাবনা রয়েছে তার ভেতরও অনেকগুলো বিষয় রয়েছে, অথচ একটি প্রশ্নের ভিত্তিতেই দিতে হবে হ্যাঁ বা না ভোট। এখন যদি মোটাদাগেও ধরি যে কোনো ব্যক্তি দুটি বিষয়ে সম্মত এবং দুটি বিষয়ে সম্মত নন, তিনি কি করবেন?
তৃতীয়ত, জাতীয় নির্বাচনের দিন গণভোট একদিক থেকে জনগণের জন্য সুবিধা, দুবার ভোট কেন্দ্রে যাওয়ার কষ্ট হবে না। কিন্তু জাতীয় নির্বাচনের প্রচারণার সময় রাজনৈতিক দলগুলো ভোটারদের প্রভাবিত করবে সে সন্দেহও অমূলক নয়। এছাড়া অর্থের বিনিময়ে ভোট কেনার ইতিহাস বাংলাদেশে পুরনো, সেই একই বিষয় ঘটতে পারে গণভোটেও।
শেষ কথা, বাংলাদেশের সংবিধানে ধারা ১৪২(১) অনুযায়ী, সংবিধানের নির্দিষ্ট কিছু অংশ পরিবর্তন করতে চাইলে, জাতীয় সংসদে অনুমোদনের পর রাষ্ট্রপতি গণভোটের মাধ্যমে জনগণের মতামত নিতে পারেন। সেক্ষেত্রে সংসদ গঠনের আগেই গণভোট নেয়া কি সংবিধানসম্মত?
গণভোট সফল করতে হলে শুধু প্রশ্ন নয়, প্রতিটি প্রস্তাবের অর্থ ও প্রভাব সহজ ভাষায় জনগণের কাছে তুলে ধরা জরুরি। গ্রামীণ ভোটার থেকে শুরু করে শহরের তরুণ পর্যন্ত সবাইকে বুঝতে হবে—তারা কিসে ভোট দিচ্ছেন, কেন দিচ্ছেন আর ফলাফল কী হবে।
জুলাই সনদ ও আসন্ন গণভোট ইতিহাসের নতুন দিগন্ত খুলতে পারে—যদি তা হয় স্বচ্ছ, জনমুখী ও সচেতন অংশগ্রহণের মাধ্যমে। কিন্তু যদি জনগণ না বোঝে প্রশ্নের গভীরতা, তাহলে এ গণভোট হতে পারে এক পরিসংখ্যানিক নাটক, যার মঞ্চে থাকবে কেবল রাজনৈতিক কণ্ঠ, জনগণের নয়।
তাই বর্তমানে প্রয়োজন আলোচনা, ব্যাখ্যা ও সর্বোপরি জনগণকে বোঝানোর এক সৎ প্রয়াস। কারণ গণভোটে জনগণের ভোটই শেষ কথা। সে কথার মূল্য তখনই প্রকৃত অর্থে গণতন্ত্রের জয়গান হবে—যখন জনগণ জানবে, তারা কী বলছে, কেন বলছে, কার জন্য বলছে।
- শাকিলা জেরিন: জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক, বণিক বার্তা (সূত্র)।

