বর্তমানে আরএমজি খাতের বিশেষ এক আলোচনার বিষয় হলো কতগুলো কারখানা বন্ধ হয়েছে এবং এর পেছনের কারণ। কিছু বিষয় আসলেই খোলামেলাভাবে আলোচনা করলে হয়তো সবার ধারণা আরো স্পষ্ট হবে এবং নীতিনির্ধারকদের ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নির্ধারণে সহায়ক হবে।
প্রায় দেখা যায় সরকার এবং ইন্ডাস্ট্রিসংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলো বিপরীতমুখী অবস্থান নেয়। সরকার মনে করে তাদের পদক্ষেপ সঠিক এবং বাস্তবসম্মত; পক্ষান্তরে ইন্ডাস্ট্রি মনে করে তাদের কাঙ্ক্ষিত চাহিদা অনুযায়ী নীতিমালা প্রণয়ন বা বাস্তবায়ন হচ্ছে না। সত্যিকার অর্থে এ দুই পক্ষের আশা এবং বাস্তবায়নের সম্পূর্ণ মিল কখনই শতভাগ হবে না। কারণ সরকার সামগ্রিক অর্থনীতি ও দেশের স্বার্থ বিবেচনায় সিদ্ধান্ত নেয়, আর ইন্ডাস্ট্রি চাইবে তাদের বাণিজ্যিক লক্ষ্য পূরণের জন্য যত বেশি সহযোগিতা পাওয়া যায়। মূল বিষয় হলো, দুই পক্ষকেই এমন একটি যৌথ অবস্থানে আসতে হবে যেখানে দেশ, অর্থনীতি, সেক্টর এবং সংশ্লিষ্ট সব জনগণ উপকৃত হয়; এটি হতে পারে শ্রমিক বা মালিক উভয়ের জন্য।
দেশের অনেক শিল্প-কারখানা বন্ধ হচ্ছে, এটি অস্বীকার করার উপায় নেই। আবার নতুন কারখানাও আসছে এবং পুরনোগুলো যারা ভালো করছে তারা তাদের উৎপাদনশীলতা বাড়াচ্ছে। তবে সমস্যার মূল হলো, কারখানা কেন বন্ধ হচ্ছে এবং কী করা সম্ভব যাতে বন্ধের হার ন্যূনতম হয়। একই সঙ্গে নতুন কারখানাগুলো বাজারে এলে তারা সত্যিকারের অর্থনীতি ও সেক্টরের উপকারে কতটা কাজ করছে তা খতিয়ে দেখা জরুরি।
একটি মাত্রায় কারখানা বন্ধ হবেই, কারণ এটি শুধু বাণিজ্যিক ক্ষতি বা লাভের ওপর নির্ভর করে না; রাজনৈতিক, মালিকের কৌশলগত ও প্রশাসনিক কারণও থাকতে পারে। তবে যদি কোনো কারখানা সঠিক নীতি ও সহায়তার অভাবে বন্ধ হয়, যা দুঃখজনক। সুতরাং এসব ক্ষেত্রে খতিয়ে দেখা উচিত—কারখানাগুলো কি সঠিক পরিচর্যা ও সহায়তার অভাবে বন্ধ হচ্ছে। নতুন কারখানা আসার মানেই দেশের সেক্টর এগিয়ে যাচ্ছে তা বলা যায় না; এগুলো দেশের অর্থনীতি ও ভবিষ্যৎ লক্ষ্য কতটা পূরণ করছে তা মূল্যায়ন করা প্রয়োজন।
কারখানা যদি অধিক হারে বন্ধ না হয়, তবে বৈদেশিক মুদ্রা আহরণ, কর্মসংস্থান এবং বাজার স্থিতিশীল থাকবে। নতুন কারখানা যোগ হলে আরো কর্মসংস্থান ও বৈদেশিক মুদ্রা আহরণের সুযোগ তৈরি হবে। তবে নতুন কারখানাগুলো কি দেশের সেক্টরের দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য অনুযায়ী আসছে, তা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। বাংলাদেশের পোশাক শিল্প প্রাথমিকভাবে সস্তা শ্রমের ওপর ভিত্তি করেছিল, কিন্তু আজকের বাজারে শুধুই এটি যথেষ্ট নয়। খরচ বৃদ্ধি ও বৈশ্বিক প্রতিযোগিতার সঙ্গে খাপ খাওয়াতে হলে পণ্যের বৈচিত্র্য, নতুন উদ্ভাবন, বাজার সম্প্রসারণ এবং পশ্চাৎ শিল্পের উন্নয়নের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে।
বর্তমান তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে যে অধিকাংশ নতুন কারখানা প্রথাগত পণ্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ, যা দেশের ভবিষ্যৎ লক্ষ্য পূরণে সহায়ক নয়। অপরিকল্পিতভাবে বাজারে আসার ফলে অতি প্রতিযোগিতা সৃষ্টি হয় এবং ক্রেতারা সঠিক মূল্য দিতে ব্যর্থ হন। এতে কারখানাগুলো আর্থিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে। অন্যদিকে যারা বৈচিত্র্যকরণ ও ভবিষ্যৎ চাহিদার সঙ্গে মিল রেখে কার্যক্রম চালাচ্ছেন, তাদের টিকে থাকার হার বেশি এবং সেক্টরের জন্যও উপকারী। সরকার ও বেসরকারি সংগঠনগুলো নতুন লাইসেন্স প্রদানের ক্ষেত্রে তদারকি করতে পারে এবং উদ্যোক্তাদের সঠিক পরিকল্পনা করতে সাহায্য করতে পারে।
বাংলাদেশে পোশাক শিল্প এরই মধ্যে প্রায় ৪৫ বছরের পরিপক্ব শিল্প। তাই আমাদের এখন সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে কারখানার গুণগত মান নিশ্চিতকরণে, সংখ্যার পরিবর্তে। নতুন লাইসেন্স দেয়ার আগে উদ্যোক্তা এবং ব্যবস্থাপনা টিমকে যথাযথ প্রশিক্ষণ ও মূল্যায়নের মাধ্যমে প্রস্তুত করা উচিত। এমনকি যদি কারখানা আন্তর্জাতিক সার্টিফিকেশন না রাখে, তার পরিচালনা, উৎপাদন পদ্ধতি এবং ব্যবস্থাপনা দক্ষতা যথাযথ হতে হবে। এটি শুধু কারখানার টিকে থাকার সম্ভাবনা বাড়াবে না, বরং দেশের পোশাক শিল্পকে আরো স্থায়ী ও প্রতিযোগিতামূলক করবে।
অতএব বিশ্ববাজারে চাহিদা হ্রাস, ক্রেতাদের কৌশল পরিবর্তন এবং সার্কুলার ইকোনমি ও স্থায়িত্বের চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলায় আমাদের প্রয়োজন একটি কার্যকর মনিটরিং ব্যবস্থা। সরকার এবং শিল্প সংগঠনগুলোর যৌথ উদ্যোগে একটি ‘ইন্ডাস্ট্রি হেলথ মনিটরিং সেল’ গঠন করা যেতে পারে, যা নিয়মিতভাবে কারখানার অবস্থা, ঝুঁকি, সুযোগ এবং প্রয়োজনীয় নীতিসহায়তার দিকগুলো পর্যবেক্ষণ করবে।
সবশেষে বাংলাদেশের পোশাক শিল্প যদি টিকে থাকতে এবং ভবিষ্যতের প্রতিযোগিতায় এগিয়ে যেতে চায় তবে নীতি, পরিকল্পনা ও বাস্তবতার সমন্বয়ে এগোতে হবে। প্রযুক্তি, প্রশিক্ষণ, আর্থিক সহায়তা এবং পরিবেশগত মানদণ্ডের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রেখে একটিই লক্ষ্য সামনে রাখতে হবে—দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক অগ্রগতি এবং টেকসই উন্নয়ন।
- মো. মহিউদ্দিন রুবেল: বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রফতানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সাবেক পরিচালক এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক, বাংলাদেশ অ্যাপারেল এক্সচেঞ্জ লি.। সূত্র: বণিক বার্তা

