গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নির্বাচনের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা উত্তম কিছু নয়। ক্ষমতাসীনেরা ঠিকঠাকমতো অর্পিত দায়িত্ব পালন করতে পারলে এবং যেনতেনভাবে জয়ী হওয়ার মানসিকতা ত্যাগ করতে পারলে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার প্রয়োজন হতো না।
পৃথিবীর যেসব দেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা আছে, সেসব দেশের গণতন্ত্র টেকসই হওয়ার উদাহরণ নেই বললেই চলে। তারপরও আমাদের দেশের জন্য এটি মন্দের ভালো। তবে এই ব্যবস্থা অতীতে এমন রাজনৈতিক দল ধ্বংস করে দিয়েছে, যারা এই ব্যবস্থাকে নিজেদের আন্দোলনের ফসল বলে বড়াই করত।
বৃহস্পতিবার (২০ নভেম্বর) সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের রায়ের মাধ্যমে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তবে তা এখনই কার্যকর হচ্ছে না। এ জন্য জনগণকে অন্তত পাঁচ বছর অপেক্ষা করতে হবে। ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে যে নির্বাচনটি হওয়ার কথা, সেটি হবে অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনেই। নতুন গঠিত সংসদ ভেঙে যাওয়ার পর পরবর্তী নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হবে।
ত্রয়োদশ সংশোধনী আইনে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার-সংক্রান্ত ৫৮খ(১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছিল, সংসদ ভেঙে দেওয়ার পর বা মেয়াদ শেষ হওয়ার কারণে যে তারিখে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা কার্যভার গ্রহণ করেন, সেই তারিখ থেকে সংসদ গঠিত হওয়ার পর নতুন প্রধানমন্ত্রী তাঁর পদের কার্যভার গ্রহণ করার তারিখ পর্যন্ত মেয়াদে একটি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার থাকবে।
নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন, উপদেষ্টা নিয়োগ ইত্যাদি সংক্রান্ত অনুচ্ছেদ ৫৮গ(২)–এ বলা হয়েছিল, সংসদ ভেঙে দেওয়ার বা ভঙ্গ হওয়ার পরবর্তী ১৫ দিনের মধ্যে প্রধান উপদেষ্টা এবং অন্য উপদেষ্টারা নিযুক্ত হবেন।
কিন্তু এখন তো সেই সুযোগ নেই। চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানের পর সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শ অনুযায়ী অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। যার নেতৃত্ব দিচ্ছেন অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। সরকারপ্রধান ইতিমধ্যে ঘোষণা দিয়েছেন, ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন হবে।
অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলোপকে গণতন্ত্রের কবর ও এর পুনরুজ্জীবনকে গণতন্ত্রের মহাসড়কে হাঁটা বলে অভিহিত করেছেন। তাঁর এই বক্তব্যের সঙ্গে সহমত পোষণ করেও বলতে চাই, গণতন্ত্রের মহাসড়কে হাঁটা শুরু করলেও গন্তব্যে পৌঁছাতে পারবে কি না, তা নির্ভর করবে আমাদের রাজনীতিকদের গণতান্ত্রিক মানসিকতার ওপর।
তত্ত্বাবধায়ক বা অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে আমরা মোটামুটি চারটি ভালো নির্বাচন পেয়েছি। কিন্তু সেই নির্বাচনে যাঁরা পরাজিত হয়েছেন, তাঁরা তা মেনে নেননি। কোনো জাতীয় সংসদে বিরোধী দল পুরো সময় থাকেনি। আর সরকারি দলও আইন প্রণয়নের বিষয়ে বিরোধী দলের মত আমলে নেয়নি। সবকিছু করেছে স্বেচ্ছাচারী কায়দায়। ভবিষ্যতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠিত হলে তারা তিন মাসের জন্য থাকবে। নির্বাচিত সরকার থাকবে পাঁচ বছরের জন্য। তারা যদি গণতান্ত্রিকভাবে দেশ পরিচালনা না করে, তবে তিন মাসের তত্ত্বাবধায়ক সরকার কিছুই করতে পারবে না। তাদের পক্ষে পাঁচ বছরের জঞ্জাল সাফ করাও সম্ভব হবে না।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের যেমন দীর্ঘ ইতিহাস আছে, তেমনি বাতিলেরও আছে। এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় তিন জোটের রূপরেখার ভিত্তিতে বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয়। যদিও এর নাম ছিল অস্থায়ী বা অন্তর্বর্তী সরকার। সেই সরকারের আয়োজিত নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসে বিএনপি। পরে দলটির শাসনামলে আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি, জামায়াতে ইসলামী, বাম দলসহ রাজনৈতিক শক্তিগুলো আন্দোলন করেছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে। পরে সাংবিধানিকভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয় ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে।
বাংলাদেশে এ পর্যন্ত যে সরকার সংসদে দুই–তৃতীয়াংশ আসন পেয়েছে, তাদের বিদায় কখনো সুখকর হয়নি। স্বাধীনতার পর প্রথম নির্বাচনে ২৯৩টি আসনে জয়ী হয় আওয়ামী লীগ। তিন বছরের মাথায় তাদের বাকশাল করতে হয়। জিয়াউর রহমানের সংসদও দুই–তৃতীয়াংশ আসন পায় এবং সামরিক অভ্যুত্থানের মুখে সাত্তার সরকারকে বিদায় নিতে হয়। ১৯৮৮ সালের সংসদ নির্বাচনে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সরকার দুই–তৃতীয়াংশ আসন পেয়ে দুই বছরের বেশি ক্ষমতায় থাকতে পারেনি। নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানে তাদের বিতাড়িত হতে হয়।
বাংলাদেশে এ পর্যন্ত দুটি সংসদই ছিল ভারসাম্যপূর্ণ। ১৯৯১ ও ১৯৯৬ সালে। প্রথমটিতে বিএনপি ও দ্বিতীয়টিতে আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন হয়। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এই দুই সংসদই অপেক্ষাকৃত কার্যকর ছিল এবং সীমিত পরিসরে হলেও বিরোধী দল ভূমিকা রাখতে পেরেছে।
২০২৪ সালে গণ–অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে অওয়ামী লীগের পতনের সূচনা হয়েছিল ২০১১ সালে, তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিলের মাধ্যমে। বিরোধী দলহীন সংসদ কখনো গণতন্ত্র দিতে পারে না। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রায় একক সিদ্ধান্তে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করেছিলেন। আর এ জন্য ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন উচ্চ আদালতের একটি রায়কে। যদিও বিচারপতি খায়রুল হকের সংক্ষিপ্ত রায়ে বলা হয়েছিল, দুটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হতে পারে। পূর্ণাঙ্গ রায়ে অবশ্য সেটি পরিবর্তন করা হয়েছিল। আর জাতীয় সংসদ তার আগেই সংসদে আইন পাস করে ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করে দেয়।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনর্বহালকে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, খেলাফত মজলিসসহ বিভিন্ন দল স্বাগত জানিয়েছে। বিএনপি বলেছে, এর মাধ্যমে ফ্যাসিস্ট ব্যবস্থা পুনরাবির্ভাব রোধ করা যাবে। জাতীয় নাগরিক পার্টি তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনর্বহালের রায়কে ‘যুগান্তকারী’ অভিহিত করেছ। এই রায়ের পর এই প্রশ্ন সামনে এসেছে যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার কি ত্রয়োদশ সংশোধনীর মতো করে হবে, নাকি জুলাই সনদে যেভাবে বলা হয়েছে, সেভাবে গঠিত হবে।
এমনকি কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের পলাতক নেতারাও অজ্ঞাত স্থান থেকে আগামী নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে করার দাবি জানিয়েছেন। একেই বলে ইতিহাসের পরিহাস। ক্ষমতায় থাকতে যদি আওয়ামী লীগ নেতারা বিষয়টি মনে রাখতেন, তাহলে হয়তো রাজনীতির গতিপথ ভিন্ন হতো। অন্তর্বর্তী ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে অনুষ্ঠিত চারটি নির্বাচনে পর্যায়ক্রমে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ জয়ী হয়েছে। কখনো এককভাবে, কখনো জোটগতভাবে। কিন্তু রাজনীতির মঞ্চ থেকে বিতাড়িত হয়নি।
২০১১ সালে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিল করে ২০১৪ সালে বিনা ভোটের, ২০১৮ সালে রাতের ভোটের এবং ২০২৪ সালে আমি-ডামির নির্বাচন করে আওয়ামী লীগ নিজেদেরই সর্বনাশ করেছে।
-
সোহরাব হাসান কবি ও সাংবাদিক। সূত্র: প্রথম আলো

