বিশ্বের নানান প্রান্তের যেসব শুভাকাঙ্ক্ষী দেশের বাউলসমাজের খোঁজখবর রাখেন কিংবা নানান উৎসবে বাউলদের দেখা পান এ দেশে বাস করা যেসব বিদেশি, তাঁরা হয়তো ভাবতে পারেন দেশের বাউলসমাজ খুবই সম্মানের সঙ্গে দিন কাটাচ্ছে।
তাঁদের এ ভাবনার পেছনে রাষ্ট্রের বিজ্ঞাপনের ভূমিকা অস্বীকার করা যায় না। পয়লা বৈশাখে আনন্দ শোভাযাত্রার প্রথম সারিতে শত শত বাউলের উপস্থিতি কিংবা লালনের তিরোধানে দেশ-বিদেশ থেকে সাব-অল্টার্ন তাত্ত্বিকদের ডেকে এনে উদ্যাপন তো এ দেশে বাউলদের সম্মানের বার্তাই বহন করে।
কিন্তু বিজ্ঞাপন আর বাস্তবতা তো খুবই আলাদা বিষয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বিজ্ঞাপনের সঙ্গে বাস্তবতার মিল কমই থাকে। বাংলাদেশের বাউল-ফকির, সন্ন্যাসীদের নিয়ে রাষ্ট্রের যে বিজ্ঞাপন, বাস্তবতা তার চেয়ে কেবল ভিন্ন নয়, বরং পুরোপুরি উল্টো। নয়তো নিরাপত্তা দেওয়ার অজুহাতে পালাগানের আসর থেকে তুলে নিয়ে আবুল সরকারকে মামলা দিয়ে কারাগারে নেওয়া হলো কেন?
গত বছরের আগস্ট মাসের শেষ দিনের কথা। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের তৎকালীন সংস্কৃতিবিষয়ক উপদেষ্টা আসিফ নজরুল এক মতবিনিময় সভার আয়োজন করেছিলেন জাতীয় জাদুঘরে, গণ-অভ্যুত্থানের পরে নতুন বাস্তবতায় সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের ভূমিকা নির্ধারণ নিয়ে। সেখানে লেখক, সাংবাদিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন কর্মীসহ অনেকেই উপস্থিত ছিলেন। প্রত্যেকের কাছে প্রস্তাবনা চাওয়া হয়েছিল সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সম্ভাব্য ভূমিকা ও সংস্কার নিয়ে।
সেখানে আমি প্রস্তাব করেছিলাম ‘ন্যাশনাল হেরিটেজ প্রোটেকশন অ্যাক্ট’-এর। যেই অ্যাক্ট বা আইনের মাধ্যমে সুরক্ষা দেওয়া যাবে এই জনজাতির মৌলিক চিন্তার পাঠশালা-বাউল-ফকির-সাধকদের আখড়া, মঠ, মাজারগুলোকে। শত শত বছর ধরে যে জনপ্রতিষ্ঠানগুলোই আমাদের সামগ্রিক চিন্তা কাঠামোর বিকাশ ঘটিয়েছে, পথ দেখিয়েছে—রক্ষা করা যাবে সেই প্রতিস্থানগুলোকে। একই সঙ্গে সুরক্ষা দেওয়া যাবে এসব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত বাউল, ফকির-সন্ন্যাসীদের। বলা বাহুল্য, আসিফ নজরুল আর সংস্কৃতি উপদেষ্টা নেই। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়েরও তেমন কোনো উদ্যোগ চোখে পড়েনি।
কেবল আইন দিয়ে অবশ্যই বাউল-ফকির, সন্ন্যাসীদের সুরক্ষা দেওয়া সম্ভব নয়। বিশেষ করে ডানপন্থীদের প্রবল জৌলুশের মৌসুমে তো নয়ই। কিন্তু আইনটাও জরুরি। কারণ, আইনের উদ্দেশ্য তো নিপীড়িতের পাশে দাঁড়ানো। বাংলাদেশের বৃহৎ সাংস্কৃতিক বলয়ে সুফিসাধক-বাউল-ফকিরদের চেয়ে বেশি নিপীড়িত এই মুহূর্তে আর কেউই নয়। হামলা থেকে মামলা—কোনো নিপীড়ন থেকেই যেন রেহাই নেই এই মরমি সাধকদের। এমন বাস্তবতায় রাষ্ট্র নিজেই যদি তাঁদের সুরক্ষা দিতে পাশে না দাঁড়ায়, তাহলে দাঁড়াবে কে? হামলা না হয় জনতাই প্রতিরোধ করবে, কিন্তু হয়রানিমূলক মামলা থেকে সুরক্ষা দেওয়ার দায়িত্ব তো রাষ্ট্রের।
সবশেষ ২১ নভেম্বর বাউলশিল্পী আবুল সরকারকে গ্রেপ্তার করেছে প্রশাসন। আদালত তাঁকে কারাগারে পাঠিয়েছেন। আবুল সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ, সংগীতের মাধ্যমে তিনি ধর্ম অবমাননা করেছেন। ২১ নভেম্বরের ঘটনা বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ভবিষ্যতের জন্য এক কঠিন সতর্কবার্তা। সেই রাতেই মাদারীপুরের এক নিভৃত পল্লি থেকে বাউলশিল্পী আবুল সরকারকে নিয়ে যায় পুলিশ, তাঁর ‘নিরাপত্তার’ অজুহাতে। বাস্তবে এটি ছিল প্রশাসনের আত্মসমর্পণ, উগ্র ডানপন্থীদের সামনে প্রশাসনের অসহায় স্বীকারোক্তি। কেউ যদি বাউলকে আক্রমণ করতে পারে বলে আশঙ্কা থাকে, তবে পুলিশের কাজ ছিল হামলাকারীকে আটক করা, ভুক্তভোগীকে নয়। কিন্তু আমরা দেখলাম উল্টোটা।
মানিকগঞ্জের ঘিওর বন্দর মসজিদের ইমাম যখন ধর্ম অবমাননার মামলা করলেন এবং স্থানীয় ‘তৌহিদী জনতা’ যখন ফাঁসির দাবিতে মিছিল শুরু করল, তখন পুলিশ তদন্তের আগেই আদালতে আবুল সরকারকে হাজির করে তাঁকে কারাগারে পাঠাল। যেন রাষ্ট্র আর সংবিধান নয়, ‘প্রেশার গ্রুপের’ ইচ্ছায় চলছে।
একদিকে বাউল-ফকিরদের ওপর নির্বিকারভাবে চলছে নিপীড়ন, হামলা, মামলা। অন্যদিকে এই নিপীড়নের প্রতিবাদ করতে গেলে বাউল-ফকিরদের অনুসারী ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের ওপর করা হচ্ছে বর্বর আক্রমণ। প্রকাশ্যে প্রশাসনের সামনেই রক্তাক্ত করা হচ্ছে সুফি ও মরমি ধারার নাগরিকদের। প্রশাসনের এই নির্লিপ্ত দশা ফকির বিদ্রোহ থেকে শুরু করে জুলাই অভ্যুত্থান পর্যন্ত এ অঞ্চলের মানুষের সমস্ত সংগ্রামের সঙ্গে স্পষ্ট প্রতারণা।
জুলাই অভ্যুত্থানের চেতনা ছিল নিপীড়নমুক্ত, ভয়হীন একটি সমাজ গড়ে তোলা। কিন্তু অভ্যুত্থানের পর থেকে আমরা দেখছি, সবচেয়ে প্রান্তিক, নিরীহ, শান্তিপ্রিয় বাউল-ফকিরদের জনগোষ্ঠী ওপর নেমে এসেছে নিপীড়নের প্রবল খড়্গ। একদিকে মাজার ভাঙা, কবর থেকে লাশ তুলে পোড়ানো, অন্যদিকে বাউলদের গ্রেপ্তার। এগুলো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়; এগুলো পরিকল্পিত ‘সাংস্কৃতিক প্রতিবিপ্লব’-এর অংশ, যা বহুত্ববাদকে ধ্বংস করতে চায়।
এই গ্রেপ্তার ও প্রতিবাদকারীদের ওপর হামলা একটি ভয়াবহ বার্তা দিয়ে গেল। বাউলদের ভয় দেখানো মানে বাংলার মরমি চেতনাকে ভয় দেখানো। কোনো গোষ্ঠী যদি মনে করে ভয় দেখিয়ে সংস্কৃতি নিয়ন্ত্রণ করা যাবে, তবে তারা ইতিহাস ভুলে যাচ্ছে, সংস্কৃতি কখনো দমন মানে না। তাই আবুল সরকারের গ্রেপ্তার শুধু একজন শিল্পীর বিরুদ্ধে মামলা নয়, এটি জনতার বিবেকের বিচার। রাষ্ট্র সিদ্ধান্ত নিক, সে কি বহুত্ববাদী সংস্কৃতিকে রক্ষা করবে, ‘প্রেশার গ্রুপ’-এর উৎপাতে গলা চেপে ধরবে মানবতার গান গাওয়া বাউলদের!
-
সৈকত আমীন, প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক (সূত্র)।

