বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার কর্তৃক গঠিত সংবিধান সংস্কার কমিশন দেশের গণতন্ত্রকে আরো শক্তিশালী ও অন্তর্ভুক্তিমূলক করার লক্ষ্যে একটি দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ গঠনের প্রস্তাব করেছে। এই প্রস্তাবনাটি দীর্ঘদিনের নির্বাচনী ব্যবস্থার অসামঞ্জস্য ও বিতর্কের সমাধান এবং ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের জন্য একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ বলে বিবেচিত হচ্ছে।
সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবনা: দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের বিস্তারিত কাঠামো-
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার কর্তৃক গঠিত সংবিধান সংস্কার কমিশনের অন্যতম প্রধান সুপারিশ হলো দেশে একটি দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ (Bicameral Parliament) প্রতিষ্ঠা করা। ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ রোধ এবং বহুমাত্রিক প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করাই এই কাঠামোর মূল লক্ষ্য।
১. নিম্নকক্ষ: হাউজ অব রিপ্রেজেন্টেটিভস (জাতীয় সংসদ)-
এই কক্ষটি হবে জনগণের সরাসরি ইচ্ছার প্রতিফলন এবং আইনসভার প্রাথমিক কেন্দ্র।
বৈশিষ্ট্য বিবরণ মোট আসন ৪০০টি নির্বাচন পদ্ধতি সদস্যরা জনগণের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হবেন। নারীর প্রতিনিধিত্ব ১০০টি আসন নারীদের জন্য সংরক্ষিত। এই ১০০ জন নারী সদস্য সারা দেশের নির্দিষ্ট ১০০টি নির্বাচনী এলাকা থেকে সরাসরি প্রতিদ্বন্দ্বিতার মাধ্যমে নির্বাচিত হবেন, যা নারীদের রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন বৃদ্ধি করবে। প্রধান ক্ষমতা আইন প্রণয়নের মূল ক্ষমতা নিম্নকক্ষের হাতে থাকবে।
২. উচ্চকক্ষ: সেনেট (Senate of Bangladesh)-
এই কক্ষটি মূলত ভারসাম্য রক্ষা এবং ক্ষুদ্র জনমতের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করবে।
বৈশিষ্ট্য বিবরণ মোট আসন ১০৫টি নির্বাচন পদ্ধতি ১০০টি আসন আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বভিত্তিক (PR) পদ্ধতিতে বণ্টন করা হবে। কোনো দল জাতীয় নির্বাচনে যত ভোট পাবে, আনুপাতিক হারে তারা উচ্চকক্ষে আসন পাবে। এটি ছোট দলগুলোর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করবে। মনোনয়ন বাকি ৫ জন সদস্যকে রাষ্ট্রপতি সমাজের বিভিন্ন পিছিয়ে পড়া অংশ বা বিশিষ্ট নাগরিকদের মধ্য থেকে মনোনয়ন দেবেন। প্রধান ক্ষমতা উচ্চকক্ষের আইনের প্রস্তাব করার ক্ষমতা থাকবে না। তবে নিম্নকক্ষে পাস হওয়া বিল অবশ্যই উচ্চকক্ষে তুলতে হবে। এটি নিম্নকক্ষের আইন পর্যালোচনা, সংশোধন ও বিলম্বে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে, যা ক্ষমতার ভারসাম্য (Check and Balance) নিশ্চিত করবে।
সার্বিক লক্ষ্য:
এই প্রস্তাবিত ৫০৫টি আসনের দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ কাঠামো বিদ্যমান ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ হ্রাস করে রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গ—নির্বাহী, আইনসভা এবং বিচার বিভাগের মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য আনয়ন করবে। উভয় কক্ষের মেয়াদ চার বছর হবে। তবে, সংবিধান সংশোধনের জন্য উভয় কক্ষের দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার অনুমোদন এবং পরবর্তীতে গণভোটের প্রয়োজন হবে। এই সংস্কারের সুষ্ঠু বাস্তবায়নের জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বৃহত্তর ঐকমত্য ও আন্তরিকতা অপরিহার্য।
বর্তমান নির্বাচন ব্যবস্থা বনাম পিআর পদ্ধতি-
বাংলাদেশে বহুদিন ধরে প্রচলিত আছে ‘ফার্স্ট পাস্ট দ্য পোস্ট’ (FPTP) পদ্ধতি। এতে কোনো আসনে সর্বাধিক ভোট পাওয়া প্রার্থী জয়ী হন, এমনকি তিনি মোট ভোটের অর্ধেকও না পেলেও। উদাহরণ হিসেবে ধরুন—একটি আসনে চারজন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। একজন প্রার্থী পেয়েছেন ২৫% ভোট, বাকিরা মিলে ৭৫% ভোট। FPTP পদ্ধতিতে ২৫% ভোট পাওয়া প্রার্থীই জয়ী হবেন, যা সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতকে প্রতিফলিত করে না।
অন্যদিকে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বভিত্তিক (পিআর) পদ্ধতি ভোটের প্রকৃত ফলাফলকে সংসদে প্রতিফলিত করে। কোনো দল যদি জাতীয় পর্যায়ে ৩০% ভোট পায়, সংসদে তাদের আসনও প্রায় ৩০% হবে। এতে ছোট ও মাঝারি দলগুলোও উপযুক্ত প্রতিনিধিত্ব পাবে এবং ভোটারদের মনে হবে ভোটের মূল্য রয়েছে।
FPTP-তে প্রায়শই দেখা যায়, একটি দল সীমিত ভোট পেলেও সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে যায়, আবার বেশি ভোট পাওয়া দল কম আসন পায়। পিআর ব্যবস্থায় এমন বৈষম্য হয় না।
রাজনৈতিক দলের অবস্থান-
বাংলাদেশে পিআর পদ্ধতি নিয়ে রাজনৈতিক দলের মধ্যে মতবিরোধ দীর্ঘদিনের।
- বিএনপি ও মিত্র দল: সরাসরি ভোটাভুটির পক্ষে। তাদের যুক্তি—পিআর পদ্ধতি নির্বাচনী প্রক্রিয়া জটিল করবে এবং নির্বাচন বিলম্বিত হওয়ার অজুহাত তৈরি হতে পারে। তারা মনে করে, বর্তমান ব্যবস্থা তাদের জন্য সুবিধাজনক।
- জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, এনসিপি: পিআর পদ্ধতির পক্ষে। তাদের মতে, বর্তমান FPTP পদ্ধতিতে ভোটের প্রকৃত প্রতিফলন হয় না। পিআর চালু হলে ভোটের সঠিক ফলাফল সংসদে প্রতিফলিত হবে এবং ছোট দলগুলোও অংশগ্রহণ নিশ্চিত হবে।
দলগুলোর অবস্থান মূলত নিজস্ব রাজনৈতিক স্বার্থের সঙ্গে যুক্ত। যারা বর্তমান ব্যবস্থায় সুবিধাজনক, তারা পিআর-এর বিরোধিতা করছে। যারা ভোটের প্রকৃত প্রতিনিধিত্ব চান, তারা সমর্থন দিচ্ছে।
পিআর পদ্ধতির সুবিধা-
- ভোটের সঠিক প্রতিফলন: ভোটের অনুপাতে আসন বিতরণ হয়। প্রতিটি ভোটের মূল্য থাকে।
- ছোট দলগুলোর প্রতিনিধিত্ব: ছোট দলও সংসদে আসন পায়।
- ক্ষমতার ভারসাম্য: কোনো দল সহজে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায় না; জোটভিত্তিক রাজনীতি প্রসারিত হয়।
- ভোটার আস্থা বৃদ্ধি: ভোট হারিয়ে যাচ্ছে না, ফলে অংশগ্রহণ বাড়ে।
- আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা: ইউরোপসহ বিশ্বের উন্নত দেশে পিআর চালু, যা রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং বহুমাত্রিক সংসদ নিশ্চিত করেছে।
পিআর পদ্ধতির অসুবিধা ও চ্যালেঞ্জ-
- সংসদ অস্থিতিশীল হওয়ার সম্ভাবনা: একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকায় জোট বাধ্যতামূলক, যা টেকসই না হলে সংসদ অস্থিতিশীল হতে পারে।
- নীতি প্রণয়নে জটিলতা: অনেক দল সংসদে থাকলে আইন প্রণয়ন ও নীতি বাস্তবায়ন বিলম্বিত হতে পারে।
- ছোট দলগুলোর অতিরিক্ত প্রভাব: অল্প ভোট পেলেও তারা বড় দলকে প্রভাবিত করতে পারে।
- ভোটার বিভ্রান্তি: পিআর তুলনামূলক জটিল, ভোটার বুঝতে পারবে না ভোট কিভাবে আসনে রূপান্তরিত হবে।
- রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার প্রশ্ন: বাংলাদেশে রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব প্রবল, তাই পিআর পদ্ধতি সহজে কার্যকর নাও হতে পারে।
বাংলাদেশের নির্বাচনী বাস্তবতা ও সম্ভাব্য প্রভাব-
বাংলাদেশের নির্বাচনী ইতিহাসে FPTP পদ্ধতির অসামঞ্জস্যের উদাহরণ প্রচুর।
- ২০০১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচন: বিএনপি ৪০.৯৭% ভোট পেয়ে ১৯৩টি আসন লাভ করে। আর আওয়ামীলীগ ৪০.১৩% ভোট পেয়ে ৬২টি আসন পায়।
এতে দেখা যায়, আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে ভোটের পার্থক্য ছিল প্রায় ১.৮৪%। তবে আসনের সংখ্যা ছিল উল্লেখযোগ্যভাবে ভিন্ন, যা FPTP পদ্ধতির অপ্রতিফলিত ফলাফলকে তুলে ধরে।
- ২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচন: আওয়ামীলীগ ৪৮.০৪% ভোট পেয়ে ২৩০টি আসন লাভ করে। আর বিএনপি ৩২.৫০% ভোট পেয়ে ৩০টি আসন পায়।
এতে দেখা যায়, আওয়ামী লীগের ভোটের পার্থক্য ছিল প্রায় ১৫.৫৪%। তবে আসনের সংখ্যা ছিল তুলনামূলকভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
এ ধরনের ফলাফলে দেখা যায়, ভোটের প্রকৃত প্রতিফলন হয় না। পিআর পদ্ধতি প্রবর্তন হলে ভোটের সঠিক প্রতিবিম্ব দেখা যাবে, ছোট দলও অংশগ্রহণ পাবে এবং নির্বাচনী প্রক্রিয়া হবে অন্তর্ভুক্তিমূলক ও স্বচ্ছ।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, পুরো দেশে পিআর কার্যকর করা কঠিন হলেও সীমিত আসনে বা সংরক্ষিত নারী আসনে পরীক্ষা করা যেতে পারে। উচ্চকক্ষের আসনও পিআর ভিত্তিতে বণ্টন করা যেতে পারে, যেখানে ভোটার দলকে ভোট দিবে এবং দল তাদের তালিকার ভিত্তিতে প্রতিনিধি মনোনয়ন দেবে।
জনগণের আপত্তির প্রসঙ্গ হতে পারে-
প্রস্তাবিত উচ্চকক্ষের জন্য আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (PR) পদ্ধতি প্রবর্তিত হলে, জনগণের একটি অংশ আপত্তি জানাতে পারে। এর কারণ হলো, বাংলাদেশের ভোটাররা দীর্ঘদিন ধরে আঞ্চলিক প্রার্থীকে সরাসরি ভোট দেওয়া এবং নির্বাচিত ব্যক্তির মাধ্যমে এলাকার উন্নয়ন নিশ্চিত করার ধারণায় অভ্যস্ত। পিআর পদ্ধতিতে ভোটার সরাসরি প্রার্থীকে নয়, বরং রাজনৈতিক দলকে ভোট দেওয়ায়, জনগণ উচ্চকক্ষের সদস্যদের কাছ থেকে সরাসরি দায়বদ্ধতা (Direct Accountability) অনুভব নাও করতে পারে। ফলে, ভোটারদের মনে হতে পারে যে তারা নিজেদের অঞ্চলের জন্য যোগ্য ও পরিচিত ব্যক্তিকে সংসদে পাঠানোর ক্ষমতা হারাচ্ছে, যা এই পদ্ধতি গ্রহণের ক্ষেত্রে একটি বড় রাজনৈতিক ও মানসিক চ্যালেঞ্জ তৈরি করতে পারে।
পরিশেষে, বাংলাদেশে পিআর পদ্ধতি পুরোপুরি কার্যকর করার আগে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্য অপরিহার্য। সীমিতভাবে প্রবর্তন করলেই এটি ভোটের স্বচ্ছতা, ভারসাম্যপূর্ণ প্রতিনিধিত্ব এবং গণতান্ত্রিক অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করতে সহায়ক হবে।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, পিআর নিয়ে বিতর্ক মূলত ক্ষমতার ভাগাভাগি ও রাজনৈতিক স্বার্থের সঙ্গে যুক্ত। দীর্ঘমেয়াদে এটি সফলভাবে বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশে নির্বাচনী প্রক্রিয়া হবে আরো সমৃদ্ধ, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ।
তবে, উচ্চকক্ষে পিআর চালু হলে জনগণ আঞ্চলিক প্রার্থীকে সরাসরি ভোট দিয়ে এলাকার উন্নয়নে যোগ্য প্রতিনিধি পাঠানোর ক্ষমতা হারানোর মানসিক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে পারে, যা তাদের মধ্যে দ্বিমত বা অনাস্থা সৃষ্টি করতে পারে।
- বিশ্লেষক: এফ. আর. ইমরান, নিউজ ইডিটর ‘সিটিজেনস ভয়েস’।