আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়া নিয়ে ‘কোনো অনিশ্চয়তা দেখেন না’ নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না। তবে, সেই নির্বাচন কতটা গ্রহণযোগ্য ও মানসম্মত হবে—সেই প্রশ্ন রয়ে গেছে বলে মনে করেন তিনি। সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশন ও প্রশাসনের নিরপেক্ষতা নিয়ে এখনো সন্দেহ দূর হয়নি। আর রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যকার মতপার্থক্যও সম্পূর্ণভাবে নিরসন হয়নি।
প্রশ্ন: আগামী ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন নিয়ে কোনো ধরনের অনিশ্চয়তা দেখেন কি না?
মাহমুদুর রহমান মান্না: নির্বাচন হবে—এই ব্যাপারে নিশ্চয়তা দেখি। তবে, নির্বাচন কতখানি গুণমানসম্পন্ন হবে, সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হবে, সেই বিষয়ে সংশয় আছে। এর মূল কারণ হলো—নির্বাচনী যন্ত্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শক্তি পুলিশ। দেশের পুলিশ বাহিনী বর্তমানে অসংগঠিত। তাদের মধ্যে কোনো স্পষ্ট কমিটমেন্ট দেখা যাচ্ছে না। পুলিশকে পুনর্গঠন করার কোনো কার্যকর উদ্যোগও নেওয়া হয়নি।
নির্বাচন কমিশনের ক্ষেত্রেও তাদের সক্রিয় ভূমিকা বা স্বাধীন ক্ষমতা দৃশ্যমান নয়। মনে হচ্ছে তারা সরকারের দেওয়া নির্দেশনা অনুসরণ করছে। এখানে ইতিবাচক দিক হলো একটাই—রাজনৈতিক দলগুলো আগের তুলনায় কিছুটা সুশীল ও সংলাপপ্রবণ হয়েছে। আগে যেখানে শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত বৈরিতাই রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু ছিল, এখন সেখানে মতপার্থক্য সত্ত্বেও দলগুলো একসঙ্গে বসছে, আলোচনা করছে, আপসের পথ খুঁজছে— এটি নিঃসন্দেহে ভালো পরিবর্তন। তবুও, সংঘর্ষ ও রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব এখনো রয়েই গেছে। প্রশাসনের উপর দলীয় প্রভাব খাটানোর প্রবণতাও দেখা যাচ্ছে। যা নিয়ন্ত্রণে রাখার যোগ্যতা বা উদ্যোগ সরকারের মধ্যে নেই।
বামপন্থী দলগুলোর দীর্ঘদিনের দাবি হলো—নির্বাচনে টাকার প্রভাব ও পেশিশক্তির ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। কিন্তু এই বিষয়ে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ দেখা যায়নি। সরকার সংস্কারের নামে আইনগত বিষয়গুলোতেও তেমন পরিবর্তন আনতে পারেনি। তারপরও সরকার আত্মবিশ্বাসী যে, তারা একটি গুণগত নির্বাচন করতে পারবে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, রাজনৈতিক দলগুলো বাহ্যিকভাবে যতটা সহযোগিতাপূর্ণ, অভ্যন্তরীণভাবে তাদের মতভিন্নতা ও বিভাজন ততটাই স্পষ্ট। সেই বিভাজনের নিষ্পত্তিও এখনো হয়নি। জুলাই সনদের ‘নোট অব ডিসেন্ট’ নিয়ে কী করা হবে? জুলাই সনদের আইনগত ভিত্তি কতটা দৃঢ় হবে? এটা কি রাষ্ট্রপতির আদেশ বা সরকারি প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে আইনগত ভিত্তি পেতে পারে? সেটাই এখন বড় প্রশ্ন।

প্রশ্ন: জুলাই সনদে বিএনপির ‘নোট অব ডিসেন্ট’ রয়েছে। বিএনপির এই মতভিন্নতাকে আপনারা কীভাবে দেখছেন?
মাহমুদুর রহমান মান্না: এ বিষয়ে আমরা একটা উদ্যোগ নিয়েছিলাম, যাতে কিছুটা হলেও কমানো যায়। আমরা জানি, জামায়াতে ইসলামী যদিও পিআর নিয়ে বেশ জোর দিচ্ছিল, তবুও এটা তাদের মূল ইস্যু মনে হয়নি। তারা পিআর বিষয়টি নিম্নকক্ষ ও উচ্চকক্ষ দুটিতেই চাচ্ছে, কিন্তু বিএনপি একটিতেও চায় না। আমাদের প্রস্তাব ছিল, বর্তমান সময়ে নিম্নকক্ষে পিআর করা যাবে না, তবে উচ্চকক্ষে করা যেতে পারে। আমরা ভেবেছিলাম, বিএনপি এটা মেনে নেবে। একইভাবে, আরও কয়েকটি বিষয়ে মতভিন্নতা রয়েছে—কিছু তারা মানছে, কিছু মানছে না।
প্রশ্ন: বিএনপির সঙ্গে আসন বণ্টন নিয়ে আপনাদের কোনো সমঝোতা হয়েছে?
মাহমুদুর রহমান মান্না: আসন বণ্টনের আলোচনা এখন পর্যন্ত হয়নি।
প্রশ্ন: বিএনপি নির্বাচনে জয়ী হলে জাতীয় সরকার গঠন করার কথা বলছে। সে বিষয়ে কোনো আলোচনা হয়েছে কি না?
মাহমুদুর রহমান মান্না: আমি যত দূর বুঝি, তারেক জিয়া এখনো জাতীয় সরকার গঠনের পক্ষে আছেন। গণতন্ত্র মঞ্চের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে কোনো প্রতিক্রিয়া আসবে কি না, সেটা পরে বলা যাবে। তবে আমি ব্যক্তিগতভাবে বলছি, এরকম একটা উদ্যোগকে অন্য রাজনৈতিক দলগুলোও স্বাগত জানাতে পারত। এখানে যদি কর্মসূচিভিত্তিক আলোচনা হতো যে, সত্যি সত্যি এত রক্ত দেওয়ার পর দেশটাকে কোন পথে বদলাবে, তাহলে ঐক্যটা সেই পথেই হতো। এখনকার আলোচনায় প্রাধান্য পাওয়া উচিত ছিল এটাই। কিন্তু আলোচনা নোট অব ডিসেন্টে গিয়ে আটকে গেল। ফলে পরিবর্তনটা আর হলো না।
প্রশ্ন: আপনারাও বলছেন, সংস্কার কার্যক্রম সাংবিধানিক কিছু জটিলতার কারণে শেষ করা যায়নি। আর বাস্তব সমস্যাগুলো যেমন- যানজট, দুর্নীতি, নিয়োগ বাণিজ্য—সেগুলোরও তেমন কিছু করা যায়নি। তাহলে ২০২৪-এর অভ্যুত্থানের পর দেশের সাধারণ মানুষের যে আশা-আকাঙ্ক্ষা ছিল, তার বাস্তবায়নে আমরা কত দূর যেতে পেরেছি?
মাহমুদুর রহমান মান্না: কী কতটুকু, আমরা তো কোথাও যেতেই পারিনি! সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যেসব বিষয় ছিল, সেগুলোর কিছুই করিনি আমরা।

প্রশ্ন: বিএনপির প্রতিনিধি দল প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে অন্তর্বর্তী সরকারকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আদলে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছে। আপনি কি মনে করেন, এর মাধ্যমে বর্তমান সরকারের প্রতি তাদের অনাস্থা প্রকাশ পেয়েছে?
মাহমুদুর রহমান মান্না: বর্তমান সরকারের প্রতি অনাস্থার কথা বিভিন্ন পর্যায়ে সরাসরি তুলেছে বিএনপি। উপদেষ্টাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছে যে, তারা পক্ষপাতমূলক আচরণ করছেন এবং রাজনীতিনির্ভর সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন ইত্যাদি। যারা রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত, তাদের বাদ দেওয়ার দাবি জানিয়েছে। অনেক উপদেষ্টার বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগ তৈরি হয়েছে। তবে, আপনি একটি পয়েন্ট মিস করেছেন—এমন এক সময়ে প্রশ্ন বা আলোচনাটা তুলছেন, যখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিষয়ে উচ্চ আদালতে শুনানি চলছে। এখন যদি আদালত বলেন, বর্তমান অবস্থা বহাল থাকবে, একই সঙ্গে এই দিকনির্দেশনাও দিতে পারে যে, এই সরকার থাকবে, তবে কিছু পরিবর্তন আনতে হবে। আবার আদালত যদি বলেন, এটাই তত্ত্বাবধায়ক সরকার, তারাই দায়িত্ব পালন করবে। সেক্ষেত্রে সেটাও সম্ভব। বিএনপিও এই দাবিটা তুলেছে। এখন বিষয়টি এক ধরনের ক্রসরোডে এসে দাঁড়িয়েছে। একটি জটিল ও সংকটময় অবস্থার মধ্যে আছি আমরা।
প্রশ্ন: জামায়াতের পক্ষ থেকে একটা অভিযোগ তোলা হয়েছে যে, বর্তমান উপদেষ্টাদের মধ্যে অনেকে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে গোপনে বৈঠক করছেন। বিএনপি থেকেও একই ধরনের অভিযোগ এসেছে। এ অবস্থায় তারা কতটা সফলভাবে নির্বাচন পরিচালনা করতে পারবেন বলে মনে করেন?
মাহমুদুর রহমান মান্না: সবাই এটা স্বীকার করবে যে, সরকার এখন পর্যন্ত তুলনামূলকভাবে ভালো পারফর্ম করছে । কিন্তু ‘অনাস্থা’ প্রকাশ একটা বড় বিষয়। অনাস্থা মানে হচ্ছে, আস্থা দেওয়ার মতো আর কেউ নেই। বিএনপি বড় অভিযোগ তুলেছে কিন্তু তারাও স্বীকার করেছে যে, ড. ইউনূস ভালো কাজ করছেন। অর্থাৎ পুরো সরকারকে তারা অনাস্থার জায়গায় ফেলছে না। আমরা এক ধরনের অচলাবস্থায় পড়ে গেছি। এই সরকার যদি না থাকে, তাহলে নতুন সরকার আসবে কোন পথে? সেই পথের বৈধতাই এখন প্রশ্নের মুখে। এটা কি জনগণের রায়ে নাকি অন্য কোনো প্রক্রিয়ার ফল হবে? এই বিতর্কে সবাই এক ধরনের নীরবতায় চলে গেছে।
তবে বাস্তবতা হলো, নির্বাচনের মাধ্যমেই এই সংকটের সমাধান সম্ভব। যতই রাজনৈতিক টানাপোড়েন থাকুক, দিনের শেষে সমাধানটা আসতে হবে নির্বাচনের মাধ্যমেই। বড় রকমের কোনো বাধা-বিপত্তি ছাড়া একটি স্বাভাবিক নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সমাধানটা আসতে হবে।

প্রশ্ন: নির্বাচনের আগে বড় দলগুলোর সঙ্গে ছোট বা মাঝারি দলগুলো জোট গঠন করে। এবার আপনারা যুগপৎ আন্দোলন করেছেন বিএনপির সঙ্গে। আপনার কি মনে হয়, বড় দলের সঙ্গে জোটে গেলে ছোট দলগুলোর আদর্শ ও নীতি বাস্তবায়নে বাধাগ্রস্ত হয়?
মাহমুদুর রহমান মান্না: তা তো হয় …, তবে এজন্য আমি বড় দলগুলোকে একতরফা দায়ী করব না। ছোট দলগুলো নিজেদের আদর্শের লড়াইটা ঠিকভাবে করতে পারে না বলেই এমনটা হয়। আসলে ছোট বা মাঝারি দলগুলো একসঙ্গে দাঁড়িয়ে যদি বড় দলগুলোকে প্রশ্ন করত, তোমরা আগামীতে বাংলাদেশকে কেমন দেখতে চাও? তোমাদের কর্মসূচি কী? আমরা দেখি, সেটা সমর্থনযোগ্য কি না। তাহলেই জোটের রাজনীতিতে ভারসাম্য আসত। এখন আমরা ঠিক সেই কথাটাই বলতে শুরু করেছি।
প্রশ্ন: নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের কথা বলে গণতন্ত্র মঞ্চ মাঠে নেমেছিল, মানুষও সাড়া দিয়েছিল। ৫ আগস্ট-পরবর্তী সময়ে সেই নতুন বন্দোবস্ত কতটা বাস্তবায়ন করতে পেরেছেন বা এটি এখন কতটা প্রাসঙ্গিক?
মাহমুদুর রহমান মান্না: সামগ্রিকভাবে বলতে পারি, আমরা যতটা এগোতে পেরেছি, তা আমাদের ধারাবাহিক আন্দোলন ও সংগ্রামের ফল। ‘নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত’ কথাটা আসলে খুব প্রাসঙ্গিক কিছু নয়; বরং এটাকে বলা যায় এক ধরনের সংস্কার প্রচেষ্টা। আমরা অর্থনীতি ও রাজনীতি—উভয় ক্ষেত্রেই একটি উন্নত কাঠামো গড়ে তোলার চেষ্টা করেছি। যদিও সবার সহযোগিতা ছাড়া সেটা পুরোপুরি বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। তবুও অনেক কিছু অর্জিত হয়েছে, যা শুধু অবিরাম প্রচেষ্টার কারণেই সম্ভব হয়েছে।
আমরা যে পরিবর্তন-সংস্কারের কথা বলেছিলাম, বর্তমান সরকারও সেদিকেই হাঁটছে। তারা একটা নতুন ফরম্যাট ও পদক্ষেপ হাতে নিয়েছে। তবে, বাস্তবায়নের পর্যায়ে এসে কিছুটা স্থবিরতা তৈরি হয়েছে। ফলে এখন প্রশ্ন উঠছে, তাদের পদক্ষেপগুলো কতটা সঠিক। আগামী দিনগুলোতে এই সংস্কার প্রসঙ্গই আরও বেশি গুরুত্ব পাবে।
নেপাল ও শ্রীলঙ্কায়ও গণঅভ্যুত্থান হয়েছে। তারা আমাদের মতো সংস্কার প্রক্রিয়ায় যায়নি। কিন্তু সেসব দেশেও পরিবর্তন এসেছে। তবে, সেটা আমাদের মতো সমন্বিতভাবে নয়। আমরা পুরোপুরি প্রস্তুত না থাকায় কিছু জায়গায় দুর্বলতা দেখা দিয়েছে। হঠাৎ করে আমরা ভেবেছি, সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে যাবে। সেটা তো হবে না। যদিও রাজনীতিতে ঐক্য মানেই ঐকমত্য নয়; বরং ভিন্নতা বজায় রেখেই ঐক্য ধরে রাখা। এই সামর্থ্যটা দেখানোই এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
প্রশ্ন: নির্বাচন সামনে এলেই কূটনীতিকদের প্রভাব, চাপ কিংবা হস্তক্ষেপের অভিযোগ ওঠে। এবারও বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপির সঙ্গে বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিদের বৈঠক হচ্ছে। আপনি কী মনে করেন, কূটনীতিকরা বাংলাদেশের ওপর চাপ সৃষ্টি করে বা এখনো করছে?
মাহমুদুর রহমান মান্না: আমি বিষয়টিকে কোনোভাবেই চাপ হিসেবে দেখি না। বিদেশিরা তো সরাসরি কিছু বলছে না। তারা সবার নির্বাচনে অংশগ্রহণের অধিকার নিয়ে কথা বলছে। এটা বেআইনি নয়। তবে, আমাদের বাস্তবতা ভিন্ন। যদি প্রকৃত স্বৈরাচারীদের সব গণতান্ত্রিক সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়, তারা সেটাকে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করবে। তার নমুনা আমরা ইতোমধ্যে দেখেছি। তাই সরকার সাময়িকভাবে তাদের কার্যক্রম সীমিত রেখেছে। এটা না করলে সরকারের কাজ করা কঠিন হয়ে যেত।
আমি ব্যক্তিগতভাবে চাই, তাদের (আওয়ামী লীগ) মধ্যে শুভবুদ্ধির উদয় হোক। তারা নিজেরাই উপলব্ধি করুক যে, কত অন্যায় ও নির্যাতন তারা চালিয়েছে। মানুষ হত্যা করেছে এবং কীভাবে গণতন্ত্র ও নির্বাচনী ব্যবস্থাকে ধ্বংস করেছে। সেই ধারা আর চলতে পারে না। তবে, আমার মনে হয় সরকার বিদেশি চাপ নিয়ে অতটা চিন্তিত নয়; বরং খুব ঠান্ডা মাথায় ও সংযতভাবে পুরো পরিস্থিতি সামলাচ্ছে।

প্রশ্ন: জাতিসংঘের প্রতিবেদনে সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত করা হলেও দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার কথা বলা হয়নি। একই সঙ্গে বিভিন্ন মহল দাবি তুলছে যে, আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগ দিতে হবে। অন্যদিকে, আপনারাও গত ১৫–১৬ বছর ধরে অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন করে আসছেন। সেক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ ও তাদের সহযোগী দলগুলোকে বাদ দিয়ে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন সম্ভব বলে মনে করেন কি না, যাদের প্রায় ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ ভোট আছে?
মাহমুদুর রহমান মান্না: তাদের সমর্থক গোষ্ঠীকে কেউ ভোট দিতে বাধা দিচ্ছে না। তারা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নিতে পারবে, প্রচার-প্রচারণা চালাতে পারবে। আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে অংশ নিতে দিতে হবে—এ নিয়ে যে চাপ আসছে, সেটা আমরা বুঝতে পারি। ঠিক আছে, এই অধিকার দেওয়া হবে, কিন্তু তার আগে বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়া জরুরি। কারণ, বিচার না হলে মানুষের ক্রোধ ও প্রশ্ন আরও বাড়বে, যা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলতে পারে। এখন কেউ যদি এসে বলে, আওয়ামী লীগের শাসনামলে গুম, হত্যা ও ক্রসফায়ারের ঘটনাগুলো মিথ্যা। তাহলে মানুষের ক্ষোভ তো আরও বাড়বে।
প্রশ্ন: অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় আগামীতে সরকারকে কতটা কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে বলে আপনি মনে করেন?
মাহমুদুর রহমান মান্না: দেশের অর্থনৈতিক পুনর্গঠনের জন্য একটি দীর্ঘমেয়াদি কর্মপরিকল্পনা প্রয়োজন, যা আমরা এখনো কার্যকরভাবে শুরু করতে পারিনি। এ সংক্রান্ত শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির একটি প্রতিবেদন আছে, সেটি প্রকাশ করা উচিত। যার মাধ্যমে পুনর্গঠন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের রূপরেখা অনুসরণ করা সম্ভব হবে। অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য একাধিকবার এ ধরনের উদ্যোগের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছেন। কিন্তু তা বাস্তবায়িত হয়নি।
আমরা এখন রেমিট্যান্স বাড়ার খুশিতে কিছুটা দিশেহারা হয়ে পড়েছি। তবে, বিদেশি সংস্থাগুলো স্পষ্ট করে বলছে যে, সুষ্ঠু নির্বাচন না হলে তারা অর্থনৈতিক সহায়তা বা ঋণ প্রদান করবে না। আমি মনে করি, বিদেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধি, শিল্পবান্ধব নীতি গ্রহণ, গ্যাস সরবরাহ বাড়ানো এবং ভ্যাট ব্যবস্থায় ভারসাম্য আনার মতো উদ্যোগ সরকার যথাযথভাবে নিতে পারত, কিন্তু নেয়নি। সরকারের অনেক নীতিই শিল্প ও ব্যবসাবান্ধব ছিল না। এসব চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে অন্তত একটি মোটামুটি গতিশীল অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব ছিল। কিন্তু বাস্তবতা হলো, আমরা এখনো সেই পর্যায়ে পৌঁছাতে পারিনি।
প্রশ্ন: আপনি নিজেও বলছেন, রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপির মধ্যে কিছু পরিবর্তন এসেছে। সেই পরিবর্তন কতটা কার্যকর বলে মনে করেন?
মাহমুদুর রহমান মান্না: বিএনপির মধ্যে কিছু পরিবর্তন অবশ্যই লক্ষ করা যায়। বাস্তবে আমি দেখেছি, তাদের নেতৃত্বের উচ্চস্তরে কিছু কার্যকর পরিবর্তন ঘটেছে, যা মাঝে মাঝে আমাকে আশাবাদী করে তোলে। তবে নিচের স্তরে, অর্থাৎ তৃণমূল পর্যায়ে এখনো সেই পরিবর্তনের পূর্ণ প্রতিফলন দেখা যায়নি।
প্রশ্ন: সম্প্রতি অনুষ্ঠিত বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল জামায়াতের ছাত্র সংগঠন ছাত্রশিবিরের বেশ বড় উত্থান লক্ষ করা গেছে। এটাকে আপনি কীভাবে দেখেন?
মাহমুদুর রহমান মান্না: এখানে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির কোনো বিষয় নেই। ধর্ম নিয়ে কোনো ক্যাম্পেইন নির্বাচনে হয়নি। তারা বলেনি যে, ইসলামী শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করব, আপনাদের ভোট এর উপর। এই ব্যাখ্যাটা আমি আগেই করেছি।

প্রশ্ন: এক সাক্ষাৎকারে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল দাবি করেছেন যে, ছাত্র সংসদের ফলাফল ভবিষ্যতে জাতীয় নির্বাচনেও প্রভাব ফেলবে। আর বিএনপি মহাসচিব বলেছেন, জাতীয় রাজনীতিতে বা নির্বাচনে এর কোনো প্রভাব পড়বে না। আপনার কী মনে হয়?
মাহমুদুর রহমান মান্না: আমি মনে করি, অবশ্যই কিছু প্রভাব পড়বে। যেসব ছাত্র ভোট দিয়ে ভিপি নির্বাচিত করেছে, তাদের পরিবার, বন্ধু ও আত্মীয়রা জাতীয় নির্বাচনে ভোট দেবে। সেখানে এর একটা প্রভাব পড়তে পারে। তবে, ছাত্র রাজনীতির এই ফলাফল জাতীয় রাজনীতির ফলাফলে সরাসরি প্রতিফলিত হবে না। অর্থাৎ ক্ষমতা পরিবর্তন করার মতো প্রভাব ফেলতে পারবে না।
প্রশ্ন: আপনার নিজের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক পরিকল্পনা কী এবং আপনার দলের পরিকল্পনা কী?
মাহমুদুর রহমান মান্না: আমার এবং দলের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক পরিকল্পনা একই লক্ষ্যকে কেন্দ্র করে পরিচালিত। আমাদের লক্ষ্য হলো, দেশকে একটি উন্নয়নশীল, ন্যায়ভিত্তিক ও কল্যাণমূলক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলা। আমি বিশ্বাস করি, রাজনীতির মূল লক্ষ্য এখন ইতিবাচক কর্মসূচি ও বাস্তবসম্মত সমাধান উপস্থাপন করা। যাদের সঙ্গে আমাদের জোট আছে, যাদের সঙ্গে নেই, সবাইকে বলব—ইতিবাচক কর্মসূচি নিয়ে আসুন, জনগণ এখন আর মতভেদ চায় না।
আমাদের ক্যাম্পেইনের মূল থিম হবে—দুর্নীতি ও দখল বন্ধ করে ন্যায্যতা, সমতা ও দক্ষতাভিত্তিক উন্নয়ন নিশ্চিত করা। আগামীতে রাজনৈতিক দলগুলোর ইশতেহার নির্দেশ করবে ‘নতুন বাংলাদেশ’ কেমন হবে। আমি চাই, নির্বাচনের এই ইশতেহার জনগণের সামনে স্পষ্টভাবে আসুক। এটি হবে দেশের জন্য একটি বড় দিকনির্দেশনা; সঠিক ও বাস্তবসম্মত রাজনৈতিক পরিকল্পনা। যা নিয়ে কেউ সহজে বিতর্ক তুলতে পারবে না।
প্রশ্ন: ৫ আগস্টের পর বিএনপিসহ কিছু দল দাবি করেছে যে, দেশের রাজনীতিতে দক্ষিণপন্থীদের উত্থান ঘটেছে। আপনি কী মনে করেন?
মাহমুদুর রহমান মান্না: আমাদের একটি সমস্যা হলো—আমরা সহজেই ঘটনা মূল্যায়ন করে ফেলি। অথচ যেকোনো ঘটনারই গভীর বিশ্লেষণ প্রয়োজন। ডাকসু, চাকসু, রাকসু নির্বাচনের প্রসঙ্গে বলি, এটি ইসলামী রাজনীতির ফলাফল নয়। বরং ফোকাস ছিল কিছু নতুন ধারার ওপর। এখন কেউ যদি এটাকে ‘ইসলামিক রিভাইভালিজম’ বা ইসলামী পুনরুজ্জীবন বা জামায়াতের উত্থান দাবি করে, সেটা তাদের ব্যাপার। তবে বিশ্লেষক জানে, এটা ভুল। বরং এটি একটি আপডেটেড ওয়েলফেয়ার টাইপ পলিটিক্স, যেখানে দলগুলো মানুষের সাথে সরাসরি যোগাযোগ করে, সুখ-দুঃখ শেয়ার করে; দক্ষিণপন্থা বা ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নয় এটি। এখন সোশ্যালিস্ট (সমাজতান্ত্রিক) নীতির প্রয়োজন নেই, ওয়েলফেয়ার ইকোনমি কার্যকরভাবে কাজ করছে। বিএনপি ও জামায়াতসহ সব বড় দলও ওয়েলফেয়ার স্টেটের (কল্যাণ রাষ্ট্র) দিকে যাচ্ছে। এটাকে যদি গুরুত্ব দিয়ে এগিয়ে নেওয়া হয় তাহলে দারিদ্র্য ও বৈষম্য দূর করা সম্ভব; মানুষে মানুষে তফাৎ কমানো সম্ভব। এটিই আমার স্বপ্নের বাংলাদেশ।
- সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী: সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
- মাহমুদুর রহমান মান্না: আপনাকেও ধন্যবাদ, কৃতজ্ঞতা।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ঢাকা পোস্টের চিফ অব পলিটিক্যাল অ্যান্ড স্টেট অ্যাফেয়ার্স আদিত্য রিমন। ঢাকা পোস্টের সাক্ষাৎকার

