দেশের বিনিয়োগ পরিস্থিতি, রাজস্ব আদায়, মূল্যস্ফীতি, পুঁজিবাজার ও ব্যাংক খাতসহ সামগ্রিক অর্থনীতির বিষয় নিয়ে বিশ্লেষণ করেছেন অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন।
ড. জাহিদ হোসেন বলেন, বিগত সরকারের রেখে যাওয়া অর্থনৈতিক নীতি ও কর্মকাণ্ডের প্রভাব এখনও দেশের অর্থনীতিতে লক্ষ্য করা যায়। তিনি উল্লেখ করেন, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে আমলাতন্ত্রের দীর্ঘসূত্রতা, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণের কিস্তি পাওয়ায় বিলম্ব এবং হঠাৎ সরকারি কর্মচারীদের বেতন বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত অর্থনীতিতে গতি আনতে বাধা সৃষ্টি করছে। তিনি আরও বলেন, নির্বাচিত সরকারের সময়োপযোগী পদক্ষেপই দেশের অর্থনৈতিক গতিশীলতা বজায় রাখতে গুরুত্বপূর্ণ। বিনিয়োগ বৃদ্ধির জন্য সরকারের কার্যকর নীতি, রাজস্ব ব্যবস্থাপনা ও ব্যাংক খাতে সুদৃঢ় প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ জরুরি।
ড. জাহিদ হোসেন চট্টগ্রাম কলেজ থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক সম্পন্ন করেন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএ থেকে ব্যবসায় প্রশাসনে স্নাতকোত্তর অর্জন করেন। ১৯৮৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের বস্টন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাজনৈতিক অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর শেষে একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি গ্রহণ করেন। তিনি বাংলাদেশ, যুক্তরাষ্ট্র ও পোল্যান্ডে ১৪ বছর শিক্ষকতা করেছেন।
১৯৯৫ সালে তিনি বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ে অর্থনীতিবিদ হিসেবে যোগ দেন এবং পরে প্রধান অর্থনীতিবিদ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি বাংলাদেশের ব্যাংক খাত, উন্নয়ননীতি পর্যালোচনা এবং দেশ, দক্ষিণ এশিয়া ও বৈশ্বিক অর্থনীতির বিভিন্ন বিষয়ে কাজ করেছেন। ড. জাহিদ হোসেনের বিশ্লেষণ অনুসারে, দেশের অর্থনীতিকে দ্রুতগতিশীল করতে হলে প্রশাসনকে দক্ষ ও স্বচ্ছ করতে হবে, রাজস্ব আদায়ে মনোযোগ বাড়াতে হবে এবং বিনিয়োগ বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।
প্রশ্ন: সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়ার পরও রাজস্ব ঘাটতি দূর হচ্ছে না। রাজস্ব আদায় বাড়ানোর জন্য আপনার সুপারিশ কী?
জাহিদ হোসেন: প্রতি অর্থবছর রাজস্ব আদায়ের জন্য অবাস্তব লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়, ফলে বড় অঙ্কের ঘাটতি থেকে যায়। বেশির ভাগ করদাতা হিসাব অনুযায়ী ভ্যাট ও আয়কর দেন। কিন্তু করদাতারা যা দেন, তার সবই সরকারি কোষাগারে জমা হয় না। অনেক ব্যবসায়ী ভ্যাট আদায় করলেও পুরোটা সরকারের খাতায় জমা দেন না- নিজেদের কাছে রেখে দেন। কেউ কেউ নামমাত্র কিছু জমা দেন।
অন্যদিকে মতিউরের মতো কিছু দুর্নীতিবাজ এনবিআর সদস্য কর, ভ্যাট ও শুল্ক আদায় করে নিজেরাই তা আত্মসাৎ করেন। এতে সাধারণ করদাতা ও ব্যবসায়ীরা রাজস্ব পরিশোধ করলেও সরকার পুরোটা পাচ্ছে না। এ বিষয়ে সরকারকে নজরদারি বাড়াতে হবে। এনবিআরের রাজস্ব আদায়ে প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে হবে। দুর্নীতি বন্ধের পাশাপাশি করের আওতা বাড়াতে হবে। এক কথায়- কর ফাঁকি ও দুর্নীতি কমাতে পারলে রাজস্ব আদায় কয়েক গুণ বাড়ানো সম্ভব হবে। কর ফাঁকিবাজদের কঠোর শাস্তির আওতায় আনা হচ্ছে। রাজস্ব আদায়ের নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের দায়িত্ব আলাদা করতে হবে।
প্রশ্ন: সরকার রাজস্ব আদায়ের নীতি ও বাস্তবায়ন আলাদা করার প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করেছে।
জাহিদ হোসেন: এনবিআরকে পৃথক করা একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের ক্ষমতা একই ব্যক্তির হাতে থাকা ঠিক নয়। যে ব্যক্তি কর আদায় করছেন, তিনি যদি নীতি নির্ধারণেও যুক্ত থাকেন, তাহলে দুর্নীতির সুযোগ থাকে।
প্রশ্ন: এনবিআর পৃথক করা নিয়ে বড় ধরনের আন্দোলন হয়েছিল। এরপর থেকে কর্মকর্তাদের রদবদল চলছে। এ বিষয়ে আপনি কী মনে করেন?
জাহিদ হোসেন: প্রায় এক যুগ ধরে এনবিআর পৃথক করার প্রক্রিয়া চলছিল। এবার সরকার এই বিষয়ে কঠোর অবস্থান নিয়েছে। এনবিআরের সংস্কার সবার কাছেই গ্রহণযোগ্য হয়েছে। তবে এই সংস্কার করতে গিয়ে যে প্রতিরোধ গড়ে তোলা হয়েছে, আন্দোলনের নামে যা করা হয়েছে, তা মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়। সব কিছুর একটা জবাবদিহি থাকতে হবে। যারা আন্দোলনের নামে অর্থবছরের শেষ সময়ে রাজস্ব সংগ্রহ ব্যাহত করেছেন, তাদের বিষয়ে সরকারকে পদক্ষেপ নিতে হবে। তা না হলে ভবিষ্যতে অন্য কোনো প্রশাসনিক সংস্কারের সময়ও একই ধরনের আচরণ দেখা যাবে। জবাবদিহির জন্য একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে। শৃঙ্খলার মধ্যে থেকে মতামত জানাতে হবে। এনবিআরের মতো একটি প্রতিষ্ঠান, বিশেষ করে মে-জুন মাসে যখন রাজস্ব সংগ্রহের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়- সেই সময়ে এনবিআরকে অচল করে দেওয়া গ্রহণযোগ্য নয়।
প্রশ্ন: ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বর্তমান সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করেছে। প্রথম থেকেই দেশের প্রতি সরকারের মনোযোগ ছিল। সরকার এক বছর পার করেছে। আপনার মতে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতি এখন কেমন চলছে?
জাহিদ হোসেন: অন্তর্বর্তী সরকার উত্তরাধিকার সূত্রে বিগত সরকারের রেখে যাওয়া ভঙ্গুর অর্থনীতি পেয়েছে। দায়িত্ব গ্রহণের পর দেখা যায়, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড প্রায় স্থবির ছিল। সামষ্টিক সূচকগুলোও ছিল ঝুঁকির মুখে। সেই অবস্থা থেকে এখন সামগ্রিক অর্থনীতি কিছুটা হলেও ভালো আছে। বিশেষ করে সামষ্টিক স্থিতিশীলতা সূচকের অনেকই এখন ইতিবাচক ধারায় যাচ্ছে। মূল্যস্ফীতি দুই অঙ্কে ছিল, যা এখন এক অঙ্কে নেমেছে। রিজার্ভ ক্রমাগত হারে কমছিল, এখন বাড়ছে।
প্রশ্ন: অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের সময়ে অর্থনীতি যেমন ছিল, তার সঙ্গে বর্তমান সময়ের তুলনা করলে কী দেখা যাবে?
জাহিদ হোসেন: অর্থনীতির সামষ্টিক সূচকের বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই স্থিতিশীলতা পুরোপুরি আসেনি। খুব বেশি পরিবর্তন হয়েছে বা বড় ধরনের অবনতি হয়েছে, এমনটাও বলা যাবে না। কর্মসংস্থান, প্রবৃদ্ধি, বিনিয়োগ- এসব ক্ষেত্রে এখনো স্থবিরতা কাটেনি। তবে যেভাবেই হিসাব করি না কেন, বর্তমানে রিজার্ভ মোটামুটি নিরাপদ জায়গায় এসেছে, এটা বর্তমান সরকারের বড়ধরনের সাফল্য। রিজার্ভ আরও বাড়াতে হবে। ব্যাংকিং খাতে যে রক্তক্ষরণ চলছিল, তা বন্ধ হয়েছে। তবে সমস্যা পুরোপুরি কেটে যায়নি। অর্থনীতির সামগ্রিক সমস্যার সমাধানে সময় লাগবে।
প্রশ্ন: মূল্যস্ফীতি দুই অঙ্ক থেকে এক অঙ্কে নেমেছে। কিন্তু বাজারে গেলে দেখা যায় জিনিসপত্রের দাম এখনো বেশি। তাহলে কি বলা যায়, কাগজে-কলমে মূল্যস্ফীতি কমলেও বাস্তবে কমেনি?
জাহিদ হোসেন: মূল্যস্ফীতি এক অঙ্কে নেমে আসা মানে এই নয় যে, জিনিসপত্রের দাম কমেছে। মূল্যস্ফীতি দুই অঙ্ক থেকে এক অঙ্কে নামা মানে হলো- দাম বাড়ার হার কমেছে। উদাহরণ দিয়ে বলা যায়, ১২ শতাংশ মূল্যস্ফীতি হলে ১০০ টাকার জিনিসের দাম বাড়ে ১২ টাকা। একইভাবে ৮ শতাংশ মূল্যস্ফীতি হলে ১০০ টাকার জিনিসের দাম বাড়ে ৮ টাকা। অর্থাৎ আগে যে জিনিসের দাম ১১২ টাকা হয়েছিল, এখন সেটি ১০৮ টাকায় দাঁড়িয়েছে। মানে দাম কমেনি, কেবল দাম বাড়ার গতি কমেছে।
প্রশ্ন: ব্যাংক খাতে অস্থিরতা বেড়েছে। ব্যাংক খাতে কি সুশাসন এসেছে? সব মিলিয়ে ব্যাংক খাত এখন কেমন চলছে?
জাহিদ হোসেন: ব্যাংক খাতে যে আতঙ্ক ছিল, তা অনেকটা কমেছে। তবে এর অর্থ এই নয় যে, ব্যাংক খাতের রোগগুলো সেরে গেছে। ব্যাংক খাতকে উদ্ধার করা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। প্রকৃত তথ্য পেলে বোঝা যাবে ব্যাংক খাত আসলে কতটা খারাপ অবস্থায় আছে। ব্যাংক খাতের সমস্যা ব্যাপক ও গভীর, যা আগে কখনো হয়নি। পাঁচটি ব্যাংকের নিরীক্ষা করা হয়েছে, বিশ্বাসযোগ্যতার জন্য আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান দিয়ে এই নিরীক্ষা করানো হয়েছে। এতে তিন থেকে চার মাস সময় লেগেছে। পাঁচ ব্যাংককে একীভূত করার সিদ্ধান্ত হয়েছে এবং কাজও শুরু হয়েছে। এখনো আমরা ব্যাংক খাতের চিকিৎসার পর্যায়ে আছি- কবে নাগাদ শেষ হবে, তা এখনই বলা যাচ্ছে না।
প্রশ্ন: মূল্যস্ফীতি কমানোর জন্য কী কৌশল অবলম্বন করা উচিত বলে মনে করেন?
জাহিদ হোসেন: সিন্ডিকেট ভেঙে দিতে হবে। বাজারে কোন কোন পণ্যের চাহিদা বেশি, তার তালিকা করে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সরবরাহ বাড়াতে হবে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য চাহিদা নিয়ন্ত্রণেও উদ্যোগ নিতে হবে। মূল্যস্ফীতি কমাতে বাংলাদেশ ব্যাংক সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি গ্রহণ করেছে। আমদানি বা উৎপাদন খরচ কমাতে না পারলে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম কমবে না। শুধু মূল্যস্ফীতির হার কমালেই হবে না, মূল্যস্তরও কমাতে হবে। বাজার ব্যবস্থাপনায় নানা ধরনের সমস্যা আছে, সিন্ডিকেট, চাঁদাবাজি, করপোরেট সিন্ডিকেট- এসব নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। বাজারে প্রতিযোগিতা বাড়াতে পারলে মূল্যস্ফীতি কমার সম্ভাবনা তৈরি হবে।
প্রশ্ন: বিনিয়োগের বিষয়ে জানতে চাই।
জাহিদ হোসেন: দেশের সার্বিক অবস্থা বিশেষ করে রাজনৈতিক পরিস্থিতি যদি বিনিয়োগকারীদের আস্থা না জাগায়, তাহলে কেউ নিজের পকেট থেকে বিনিয়োগ করার সাহস পাবে না। শতভাগ নিশ্চয়তা কোথাও থাকে না, কিন্তু মৌলিক রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা না এলে বিনিয়োগ ঘুরে দাঁড়ানোর সম্ভাবনাও নেই।
প্রশ্ন: আপনি কি নির্বাচনের দিকে ইঙ্গিত করছেন? একটি নির্বাচিত সরকার কি সব সময় বিনিয়োগ পরিস্থিতি উন্নত করে?
জাহিদ হোসেন: আমি সহজ ক্ষমতা হস্তান্তরের কথা বলছি। কারণ, নির্বাচন হয়ে গেলেও যদি স্থিতিশীলতা না আসে- দ্বন্দ্ব, সংঘর্ষ বা সহিংসতা চলতে থাকে, তাহলে অস্থিতিশীলতা থেকেই যায়। গত এক বছরে আমরা যে ধরনের আন্দোলন দেখেছি, কিছু যৌক্তিক, কিছু অযৌক্তিক- সব মিলিয়ে পরিস্থিতি অস্থিতিশীল। সর্বমহলে গ্রহণযোগ্য একটি জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে, যেখানে যারা হেরে যায় তারাও ফলাফল মেনে নেয়। এমন একটি মডেল দেখা গেলে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীরা আশ্বস্ত হবেন।
প্রশ্ন: বিগত সরকার দেশের অর্থনীতিকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গেছে বলা হচ্ছে। সেই অবস্থা থেকে সংস্কারের মাধ্যমে কতটা স্থিতিশীলতা ফিরেছে বলে মনে করেন?
জাহিদ হোসেন: বৈদেশিক বাণিজ্যের অস্থিতিশীলতা কেটে গিয়ে বৈদেশিক মুদ্রাবাজার স্থিতিশীল হয়েছে এবং রিজার্ভ বেড়েছে। তবে অর্থনৈতিক কর্মচাঞ্চল্যের ক্ষেত্রে সরকার যেই স্থবির অবস্থা উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছিল, তাতে চোখে পড়ার মতো উন্নতি এখনো হয়নি।
প্রশ্ন: অন্তর্বর্তী সরকার এক বছরের বেশি সময় ধরে রাষ্ট্র পরিচালনা করছে। তবুও কেন পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে না?
জাহিদ হোসেন: এর প্রধান কারণ সরকারের অগ্রাধিকার। তাদের বড় অগ্রাধিকার ছিল রাজনৈতিক সংস্কার। যেমন বিচারব্যবস্থা, নির্বাচন ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ। এত অল্প সময়ে এতগুলো কাজ কোনো সরকারের পক্ষেই ম্যাজিক ছাড়া সম্ভব নয়।
প্রশ্ন: সংস্কারে এত প্রতিরোধ কেন আসে?
জাহিদ হোসেন: সংস্কারে প্রতিরোধ সব সময়ই আসে। কারণ সংস্কার ক্ষমতার কেন্দ্রকে আঘাত করে। যারা বিদ্যমান অবস্থা থেকে সুবিধা পাচ্ছে, তাদের স্বার্থে আঘাত লাগে। যদি আমার বাজারে একচ্ছত্র দখল থাকে এবং সংস্কারের ফলে প্রতিযোগিতা আসে, তাহলে আমি আগের মতো মোটা অঙ্কের লাভ করতে পারব না। তাই কায়েমী স্বার্থবাদীরা প্রতিরোধ করবেই।
প্রশ্ন: এই প্রতিরোধ ব্যবস্থাপনায় আমলাতন্ত্রের ভূমিকা কতটা?
জাহিদ হোসেন: আমলাতন্ত্রের ভূমিকা বিশাল। বিভিন্ন গোষ্ঠী যে অযাচিত সুবিধা নেয়, সেটা প্রশাসনের সহযোগিতা ছাড়া সম্ভব নয়। আইন ভেঙে কাজ করা বা অন্যায়ভাবে আইন বদলানো- দুই ক্ষেত্রেই প্রশাসনের ভূমিকা লাগে। সংস্কারের সিদ্ধান্ত ক্যাবিনেট থেকে এলেও, বাস্তবায়ন হবে কি হবে না, তা নির্ভর করে প্রশাসনের ওপর। প্রশাসন সবসময় থাকে। বড় বড় দুর্নীতি বা মেগা করাপশন সাধারণত টিমওয়ার্কের ফল, যার কেন্দ্রে থাকে প্রশাসনই।
প্রশ্ন: আর্থিক খাতে একাধিক টাস্কফোর্স করা হয়েছিল, আপনিও সদস্য ছিলেন। এদের কাজের অগ্রগতি কেমন?
জাহিদ হোসেন: টাস্কফোর্সের অগ্রগতি ফলাফলের ভিত্তিতে মূল্যায়ন করতে হবে। আমি যে ব্যাংক পুনর্গঠন টাস্কফোর্সে ছিলাম, সেটি এখন নিষ্ক্রিয়। তবে বর্তমানে পাঁচটি ব্যাংকের একীভূতকরণ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে, যদি এটি সফলভাবে সম্পন্ন হয়, তাহলে বলা যাবে টাস্কফোর্স কার্যকর হয়েছে।
ব্যাংক রেজল্যুশন অর্ডিন্যান্স ও ডিপোজিট প্রোটেকশন আইন হয়েছে- এগুলোও গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি। তবে সম্পদ পুনরুদ্ধারের ক্ষেত্রে এখনো দেখতে হবে অর্থ পাচার বন্ধ হচ্ছে কি না, পাচারকারীদের জবাবদিহির আওতায় আনা যাচ্ছে কি না এবং পাচার হওয়া সম্পদ পুনরুদ্ধার কতটা সম্ভব হচ্ছে। অ্যাসেট রিকভারি টাস্কফোর্সটি খুব জটিল। কারণ এখানে প্রায় ১১টি সংস্থার সমন্বয় করতে হয়।
প্রশ্ন: আইএমএফ বলেছে, নির্বাচিত সরকার না আসা পর্যন্ত পরবর্তী কিস্তি ছাড় হবে না- এই বিষয়ে আপনার মন্তব্য কী?
জাহিদ হোসেন: গত জুন মাসে আইএমএফ যখন রিভিউ করতে এসেছিল, তখন তারা জানত যে ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হবে। তা সত্ত্বেও তারা ১৩০ কোটি ডলার ঋণ ছাড় দিয়েছে, প্রোগ্রামের আকার বাড়িয়েছে এবং মেয়াদও এক বছর বাড়িয়েছে। এখন হঠাৎ করে সুর পাল্টানোর কারণ নেই। যদি প্রোগ্রাম সঠিক পথে থাকে, তবে নির্বাচিত সরকারের জন্য অপেক্ষা করার কোনো যৌক্তিকতা দেখি না। বাংলাদেশ ব্যাংক, যা লিড এজেন্সি, তো কোথাও যাচ্ছে না। আমার মনে হয়, এখানে কোনো একটা তথ্যগত ফাঁক আছে, যা আমরা স্পষ্টভাবে জানতে পারছি না।
প্রশ্ন: এই সরকারের সময় দুর্নীতি পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন হয়েছে বলে মনে করেন?
জাহিদ হোসেন: খুব একটা পরিবর্তন হয়েছে বলে মনে হয় না। একই কর্মকর্তা, একই মানুষজন এখনো জড়িত আছেন। সিস্টেমটা হয়তো কিছুটা উন্নয়নের চেষ্টা চলছে, কিন্তু মৌলিক পরিবর্তন হয়নি।
প্রশ্ন: আমাদের পুঁজিবাজার দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগে আস্থার জায়গা তৈরি করতে পারেনি, কেন?
জাহিদ হোসেন: অর্থনীতি যদি চাঙা না থাকে, তাহলে পুঁজিবাজারও চাঙা হওয়ার সুযোগ নেই। তবে অর্থনীতি চাঙা থাকলেও পুঁজিবাজার সঠিকভাবে কাজ করবে-এমন নিশ্চয়তা নেই। আর সেখানে সুশাসন না থাকলে জালিয়াতি, কৃত্রিমভাবে দাম বাড়ানো বা পতন ঘটানো হতে পারে। এক পক্ষ দাম বাড়ানো বা ভালো করার চেষ্টা করলে অন্য পক্ষ কমানোর চেষ্টা করে। মূল সমস্যা হলো সুশাসনের সংকট থেকে সৃষ্ট আস্থার অভাব। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ ও সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনে সুশাসন না এলে এই অবস্থা বদলাবে না।
প্রশ্ন: বাংলাদেশ আগামী বছরের নভেম্বরে এলডিসি (স্বল্পোন্নত দেশ) থেকে উত্তরণ করবে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, প্রস্তুতি নেই। উত্তরণ পিছিয়ে দেওয়ার দাবি কতটা যৌক্তিক?
জাহিদ হোসেন: উত্তরণ সরকারের হাতে নয়। উত্তরণের মানদণ্ডগুলো ইতোমধ্যেই পূরণ হয়েছে। পিছিয়ে দিতে হলে আবেদন করতে হবে এবং তথ্য-উপাত্তসহ প্রমাণ দিতে হবে যে, ২০২১ সালের সিদ্ধান্তের পর অর্থনীতিতে এমন কী পরিবর্তন এসেছে, যা উত্তরণ বিলম্বিত করার যৌক্তিকতা দেয়। কিন্তু ডেটা সেই যুক্তিকে সমর্থন করে না।
প্রস্তুতির কাজগুলো দ্রুত এগিয়ে নেওয়া উচিত। আমরা জানি, ২০২৯ সাল পর্যন্ত ইউরোপ, কানাডা ও জাপানের মতো বড় বাজারে সুবিধাগুলো থাকবে। এখন পিছিয়ে দিলে কয়েক বছর পর একই সমস্যা আবার দেখা দেবে। তবে প্রস্তুতির ঘাটতি আছে, যেমন ট্যারিফ নীতির সংস্কার এখনো হয়নি।
প্রশ্ন: সম্প্রতি খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিলের সার্কুলার দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক, যেখানে আগের সরকারের ধারাবাহিকতাই দেখা গেছে। অর্থাৎ ব্যবসায়ীদের ঢালাওভাবে ছাড় দেওয়া হয়েছে। আপনার মতামত কী?
জাহিদ হোসেন: ঋণ পুনঃতফসিলের সার্কুলারটি ছিল বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি ভুল সিদ্ধান্ত। এটি প্রভাবশালী ঋণগ্রহীতাদের কাছে নতিস্বীকার হিসেবে দেখা হচ্ছে। ব্যবসায়ীদের বিজনেস মডেলই এখন ঋণ নিয়ে ফেরত না দেওয়া। তারা সব সময় অসন্তুষ্ট থাকবে। এই সার্কুলার ছিল খুবই নেতিবাচক পদক্ষেপ।
প্রশ্ন: সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য বেতন বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত ও পরে তা থেকে সরে আসার বিষয়ে আপনার মতামত কী?
জাহিদ হোসেন: বেতন বৃদ্ধির তাড়াহুড়াটা প্রশ্নবিদ্ধ। এটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলেই মনে হয়। এই বেতন বৃদ্ধির ফলে প্রায় ৭০ হাজার কোটি টাকার অতিরিক্ত বরাদ্দ প্রয়োজন হতো। যৌক্তিকতা হিসেবে বলা হয়েছিল-বেতন মূল্যস্ফীতির সঙ্গে তাল মেলাতে পারেনি বা বেসরকারি খাতের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়েছে। কিন্তু এ বিষয়ে কোনো গবেষণা হয়নি। উৎপাদনশীলতা বা সেবার মান বাড়ানোর জন্য প্রশাসনিক সংস্কারের সঙ্গে বেতন বৃদ্ধির সংযোগ দরকার যা অনুপস্থিত। ২০১৬ সালে বেতন দ্বিগুণেরও বেশি বাড়লেও দুর্নীতি কমেনি। তবে সরকার এখন এই সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছে, যা ইতিবাচক পদক্ষেপ। সূত্র: খবরের কাগজ

