গতকালের ভূমিকম্পের তীব্রতা অনুভব করেছি। ভূমিকম্পের তীব্রতা বিভিন্ন রকমের হয়। উৎপত্তিস্থলের কাছাকাছি এটি বেশি এবং দূরে কম অনুভূত হয়। গত ৫০-৬০ বছরের মধ্যে এটি সর্বোচ্চ তীব্রমাত্রার ভূমিকম্প।
ড. মো. জিল্লুর রহমান:, ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ ও অধ্যাপক, ডিজাস্টার সায়েন্স অ্যান্ড ক্লাইমেট রেজিলিয়েন্স বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। একই বিভাগে চেয়ারম্যান ও এ বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্সেস অনুষদের ডিন হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। এছাড়া তিনি কানাডার ইউনিভার্সিটি অব ব্রিটিশ কলাম্বিয়া থেকে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন, যেখানে তার বিশেষায়ণ ছিল জিওটেকনিক্যাল আর্থকোয়েক ইঞ্জিনিয়ারিং। তিনি নেদারল্যান্ডসের ইউনিভার্সিটি অব টোয়েন্টের আইটিসি থেকে জিওইনফরমেশন সায়েন্স অ্যান্ড আর্থ অবজারভেশনে এমএসসি সম্পন্ন করেছেন। গতকাল ঘটে যাওয়া ভূমিকম্পের নানা দিক নিয়ে কথা বলেছেন তিনি।
প্রশ্ন: গতকাল ঢাকাসহ আশপাশের জেলায় তীব্র ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। শুরুতেই আপনার প্রতিক্রিয়া জানতে চাই।
ড. মো. জিল্লুর রহমান: গতকালের ভূমিকম্পের তীব্রতা অনুভব করেছি। ভূমিকম্পের তীব্রতা বিভিন্ন রকমের হয়। উৎপত্তিস্থলের কাছাকাছি এটি বেশি এবং দূরে কম অনুভূত হয়। গত ৫০-৬০ বছরের মধ্যে এটি সর্বোচ্চ তীব্রমাত্রার ভূমিকম্প। বাংলাদেশের আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী ভূমিকম্পটির উৎপত্তিস্থল নরসিংদীর মাধবদী এবং রিখটার স্কেলে এর তীব্রতা ছিল ৫ দশমিক ৭। ভূতাত্ত্বিক হিসেবে আমরা দেখার চেষ্টা করি ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থলের আশপাশে কোনো ফল্টলাইন আছে কিনা। নরসিংদীতে শীতলক্ষ্যা নদী বয়ে গেছে। এটি একটি লিনিয়ার (ফল্টলাইনযুক্ত) নদী। গতকালের ভূমিকম্প এ নদীর ফল্টলাইন থেকে সৃষ্টি হয়েছে বলে ধারণা করা যাচ্ছে।
প্রশ্ন: মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্প এর আগেও দেশে হয়েছে। তবে মানুষের মধ্যে এবার বেশি আতঙ্ক দেখা যাওয়ার কারণ কী?
ড. মো. জিল্লুর রহমান: মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্প বাংলাদেশে প্রথমবার হচ্ছে না। এর আগেও আমরা কমবেশি ৫ দশমিক ৭ মাত্রার ভূমিকম্প দেখেছি। তবে গতকালের ভূমিকম্পটির তীব্রতা তুলনামূলক বেশি অনুভূত হয়েছে। যে কারণে মানুষের মধ্যে আতঙ্ক দেখা যাচ্ছে। তবে এক্ষেত্রে আতঙ্কিত হওয়ার তেমন কোনো কারণ নেই। বাংলাদেশ মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চল। তাই এখানে মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্প হওয়াটা অস্বাভাবিক না। এর চেয়ে বড় মাত্রার ভূমিকম্প হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম।
তবে এটিও ঠিক যে অতীতে এ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ৭-৭ দশমিক ৫ মাত্রার ভূমিকম্পের ঘটনা ঘটেছে। উদাহরণ হিসেবে ১৮৮৫ সালে মানিকগঞ্জ এবং ১৯১৮ সালে শ্রীমঙ্গলের ভূমিকম্পের কথা বলা যায়। এ থেকে অনুমান করা যায়, দেশে আগামীতেও এ মাত্রার ভূমিকম্প হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। তাছাড়া এটি একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও অনিশ্চিত বিষয়। তাই নিশ্চিতভাবে বলা মুশকিল।
প্রশ্ন: মাঝারি বা তারচেয়ে শক্তিশালী ভূমিকম্পের ঝুঁকি মোকাবেলায় করণীয় কী হতে পারে?
ড. মো. জিল্লুর রহমান: বড় মাত্রার ভূমিকম্পের কথা মাথায় রেখেই ভূমিকম্প সহনশীল বিল্ডিং কোড করা হয়েছিল। কারণ বিল্ডিং কোড মানা হলে বড় ধরনের ভূমিকম্পে ক্ষয়ক্ষতির সম্ভাবনা কমে আসবে। কিন্তু সমস্যা হলো মানুষ ভূমিকম্প হলে যতটা আতঙ্কিত বোধ করে, বিল্ডিং বানানোর সময় সেই আতঙ্ক তাদের মধ্যে থাকে না। যে কারণে ৫ দশমিক ৭ মাত্রার ভূমিকম্পেই ভবনে ফাটল দেখা দিয়েছে। এছাড়া সচেতনতার অভাবে হতাহতের ঘটনাও ঘটেছে। মানুষকে সচেতন ও সতর্ক করা না গেলে ভবিষ্যতে এমন মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্পে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ও হতাহতের সংখ্যা আরো বাড়বে।
আর বড় ধরনের ভূমিকম্পে আমাদের ক্ষয়ক্ষতি যাতে তুলনামূলক কম হয়, সেজন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে। পাশাপাশি সতর্ক ও সচেতন হতে হবে। মানুষ যদি সতর্ক ও সচেতন না হয় তাহলে অনেকেই আতঙ্কিত হয়ে আহত হবে, যা আমরা এরই মধ্যে দেখেছি।
অনেকেই আতঙ্কিত হয়ে ঘর থেকে বের হয়ে রাস্তায় নেমে এসেছে। কিন্তু রাজধানীতে উঁচু অট্টালিকা রয়েছে। এসব উঁচু ভবন রাস্তায় পড়লেও মানুষের হতাহতের সংখ্যা বেড়ে যেতে পারে। বরং এক্ষেত্রে ঘরে থাকাই শ্রেয়। যথাযথ নিয়ম মেনে ভবন নির্মাণ না করার কারণেই আমাদের আতঙ্কিত হতে হচ্ছে। জাপান ও যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ায় ৫ দশমিক ৫ মাত্রার ভূমিকম্প প্রায় হয়ে থাকে। তারা আতঙ্কিত হয় না। কারণ তারা আইন-কানুন ও বিল্ডিং কোড মেনে ভবন নির্মাণ করেছে। কিন্তু এ দেশে ৬ মাত্রা বা এর কাছাকাছি ভূমিকম্প হলে, বিশেষত ঢাকা শহরের অনেক ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
সর্বোপরি ভবন নির্মাণের সময় মানুষকে ভূমিকম্পের মতো দুর্ঘটনার কথা মনে রাখতে হবে। ভূমিকম্প সহনশীল ভবন নির্মাণ করতে হবে। বিল্ডিং কোডে সাইসমিক ডিজাইন (ভূমিকম্পের কম্পন সহনশীল নকশা) এরই মধ্যে হালনাগাদ করা হয়েছে। সেই নকশার পরিপূর্ণ বাস্তবায়নে প্রকৌশলী ও সরকারের ভূমিকা রাখা প্রয়োজন। প্রকৌশলীরা মানুষকে ভূমিকম্প সহনশীল ভবন বানানোর ক্ষেত্রে পরামর্শ দিতে পারে। অন্যদিকে মানুষ বিল্ডিং কোড মেনে ভবন নির্মাণ করবে, সেটি সরকারকে বাস্তবায়ন করতে হবে।
প্রশ্ন: এরই মধ্যে ঢাকা শহরের বহু ভবন বিল্ডিং কোড না মেনেই গড়ে তোলা হয়েছে, যার নজির গতকালের ভূমিকম্পেও দেখা গেছে। এ বাস্তবতায় কী করণীয়?
ড. মো. জিল্লুর রহমান: ঢাকা শহরে কোনো ফাঁকা জায়গা নেই। আতঙ্কিত হয়ে মানুষ রাস্তায় নেমে আসে। কিন্তু ভূমিকম্পে যদি ভবন পড়ে যায় তাহলে তা রাস্তায় মানুষের ওপরই পড়তে পারে। এজন্য আমাদের আতঙ্কিত না হয়ে ঘরের ভেতরই শান্ত অবস্থায় একটা নিরাপদ আশ্রয় নিতে হবে। ভবনের ভিম ও কলামের নিচে আশ্রয় নেয়া যেতে পারে।
আর যেসব ভবন ঝুঁকিপূর্ণ ও দুর্বল, ফাটল সৃষ্টি হয়েছে, কার্নিশ ভেঙে গেছে, সেগুলো এরই মধ্যে শনাক্ত করা হয়েছে। এগুলো ধীরে ধীরে ভেঙে ফেলতে হবে। একসঙ্গে ভাঙা সম্ভব নয়। বর্তমানে ঢাকার বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনার (ড্যাপ) আওতায় প্রায় ২ লাখ ৫০ হাজার ভবন নির্মাণাধীন রয়েছে। এছাড়া অনেক পুরনো ভবন ভেঙে নতুন ভবন তৈরি করা হচ্ছে। এসব ভবন যদি ভূমিকম্প সহনশীল করে নির্মাণ করা যায় তাহলে আগামী ৩০ বছরের মধ্যে ভূমিকম্প সহনশীল অনেক ভবন গড়ে উঠবে। এটি সরকার ও জনগণকে বাস্তবায়ন করতে হবে।
প্রশ্ন: ভূমিকম্পের ঘটনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভবনের ঝুঁকিও আলোচনায় এসেছে।
ড. মো. জিল্লুর রহমান: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি হল থেকে কয়েকজন শিক্ষার্থী লাফ দিয়ে আহত হয়েছেন। এতে তাদের মারা যাওয়ার ঝুঁকি বেশি ছিল। যেহেতু ভবনটি পড়ে যায়নি, তাই তাদের লাফ দেয়া উচিত হয়নি। অর্থাৎ শিক্ষার্থীদের মধ্যেও ভূমিকম্পের সময় করণীয় সম্পর্কে সচেতনতার ঘাটটি রয়েছে।
তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকম্পে ধসে পড়তে পারে এমন একাধিক ঝুঁকিপূর্ণ ভবন রয়েছে। শিক্ষকরা কয়েকটি পরিত্যক্ত ভবনে থাকেন। তাদের নিরাপদ আবাসনের ব্যবস্থা করা যাচ্ছে না। হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলসহ বেশ কয়েকটি হলে ঝুঁকিপূর্ণ ভবন রয়েছে। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছু ভবন রয়েছে যেগুলো স্বাভাবিক অবস্থায়ও ভেঙে পড়ে যেতে পারে। অথচ সেখানে ছাত্র-শিক্ষকরা থাকছেন। ভূমিকম্প হলে আরো বেশি ঝুঁকি তৈরি হয়। যত দ্রুত সম্ভব বিশ্ববিদ্যালয়ের ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলো থেকে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সরিয়ে অন্যত্র নিয়ে যেতে হবে।
প্রশ্ন: আপামর জনসাধারণের মধ্যে ভূমিকম্প বিষয়ে সচেতনতা তৈরিতে কি উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে?
ড. মো. জিল্লুর রহমান: দেশে বড় ভূমিকম্প না হওয়ার ফলে আমাদের মধ্যে শিথিলতা কাজ করে এবং সচেতনতাও তৈরি হয়নি। জনগণ, বিশেষজ্ঞ ও সরকারি পর্যায়ে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ ও সচেতনতার অভাব রয়েছে। গতকাল যেহেতু একটি ভূমিকম্প হয়েছে তাই কিছুটা নড়েচড়ে বসেছে, খোঁজখবর নিচ্ছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো ভূমিকম্প যেকোনো সময় সংঘটিত হতে পারে। তাই আমাদের প্রস্তুতি সারা বছরই থাকতে হবে। সচেতনতা বৃদ্ধিতে কাজ করতে হবে। এক্ষেত্রে গণমাধ্যম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। মানুষকে ভূমিকম্পের করণীয় সম্পর্কে অবগত করতে হবে।
ঢাকা শহরে তেমন কোনো উন্মুক্ত জায়গা নেই। উঁচু অট্টালিকা রয়েছে। মানুষ বাইরে বের হলেও তাদের ওপরই ভবন ধসে পড়তে পারে। যেকোনো উঁচু ভবনের সবচেয়ে দুর্বল জায়গা হচ্ছে সিঁড়ি ও লিফট। ভূমিকম্পের ঝাঁকুনিতে ভবন না ভেঙে যেকোনো সময় সিঁড়ি ভেঙে পড়তে পারে। এতে হতাহতের সংখ্যা বেড়ে যাবে। তাই ঘরই নিরাপদ। এ ধরনের সচেতনতা বাড়াতে হবে। আর যেটা আগেও বলেছি, যেসব ভবন দুর্বল রয়েছে সেগুলো দ্রুত খালি করতে ও ভেঙে ফেলতে হবে। নতুন ভবন তৈরির ক্ষেত্রে বিল্ডিং কোড যথাযথভাবে অনুসরণ করতে হবে। তাহলেই ছোট বা মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা কমে আসবে।
বণিক বার্তার সাক্ষাৎকার

