দেশের পুঁজিবাজারকে কার্যকরভাবে পরিচালনা এবং বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষার উদ্দেশ্যে ২০১১ সালে একটি উপদেষ্টা কমিটি গঠন করেছিল বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। তবে দীর্ঘদিন ধরে কার্যক্রমে নিষ্ক্রিয় থাকার কারণে সম্প্রতি এই ১৭ সদস্যের উপদেষ্টা কমিটি বাতিল করেছে নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি।
পুঁজিবাজারে ২০১০ সালের ভয়াবহ ধসের প্রেক্ষাপটে ২০১১ সালের ২৮ মার্চ ‘সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ অধ্যাদেশ ১৯৬৯’ অনুসারে বিএসইসি এই উপদেষ্টা কমিটি গঠন করে। তৎকালীন সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (এসইসি) চেয়ারম্যান, কমিশনের সব সদস্য (বর্তমানে কমিশনার), অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের প্রতিনিধি, বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন ডেপুটি গভর্নর, এফবিসিসিআই, আইসিএবি, আইসিএমএবি, বিএপিএলসি, ডিএসই, সিএসই, সিডিবিএল, সিপিডি, ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ, বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকস, বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশন, পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট এবং ফাইন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেসের সম্পাদকের প্রতিনিধিত্বে এই কমিটি গঠিত হয়।
কমিটির প্রধান দায়িত্ব ছিল পুঁজিবাজারের নীতিনির্ধারণে পরামর্শ প্রদান এবং বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ সংরক্ষণে উপযুক্ত কর্মপরিকল্পনা প্রস্তাব করা। কোনো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে এ কমিটির সঙ্গে পরামর্শ করে বাজার উন্নয়নের উদ্যোগ নেওয়ার কথা থাকলেও বাস্তবে তা হয়নি। বরং দায়িত্বপ্রাপ্তদের গাফিলতি ও অনীহার কারণে দীর্ঘ পাঁচ বছর ধরে কমিটি কার্যত অকার্যকর অবস্থায় ছিল।
বিশেষ করে বিএসইসির তৎকালীন চেয়ারম্যান শিবলী রুবাইয়াত-উল ইসলামের সময়ে পদাধিকার বলে কমিটির আহ্বায়ক হওয়া সত্ত্বেও তিনি উপদেষ্টা কমিটিকে কার্যত পাশ কাটিয়ে গেছেন। তার নেতৃত্বে উপদেষ্টা কমিটির কোনো বৈঠক বা দৃশ্যমান কার্যক্রম অনুষ্ঠিত হয়নি। ফলে এই কমিটি বাজারে কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে ব্যর্থ হয়।
বিএসইসি সূত্রে জানা গেছে, এই উপদেষ্টা কমিটি গঠনের পেছনে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিতের প্রত্যক্ষ ভূমিকা ছিল। তিনি চেয়েছিলেন পুঁজিবাজারে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে নিয়মিত পরামর্শ গ্রহণ করা হোক। এ লক্ষ্যে তৎকালীন এসইসি চেয়ারম্যান ড. খায়রুল হোসেনকে আহ্বায়ক করে কমিটি গঠন করা হয়। খায়রুল হোসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাইন্যান্স বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন এবং তিনি টানা ৯ বছর বিএসইসির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তার মেয়াদ শেষ হয় ২০২০ সালের ১৪ মে।
এরপর শিবলী রুবাইয়াত-উল ইসলাম বিএসইসির নতুন চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব নেন। রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ পাওয়া এই চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে নিয়ন্ত্রক সংস্থার কাজকর্ম নিয়ে নানা বিতর্ক সৃষ্টি হয়। তার আমলে শেয়ার কারসাজি ও অনৈতিক সুবিধা প্রদান, বিতর্কিত কোম্পানির তালিকাভুক্তিসহ বিভিন্ন অভিযোগ ওঠে। বর্তমানে দুর্নীতির অভিযোগে তিনি কারাগারে রয়েছেন। তার সময়েই উপদেষ্টা কমিটির কার্যক্রম পুরোপুরি অচল হয়ে পড়ে, যার কোনো লিখিত রেকর্ডও খুঁজে পাওয়া যায়নি। এ পরিস্থিতিতে ২০২৪ সালে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর খন্দকার রাশেদ মাকসুদের নেতৃত্বাধীন নতুন বিএসইসি কমিটি উপদেষ্টা কমিটিকে আনুষ্ঠানিকভাবে বিলুপ্ত করে এবং কমিশনের ওয়েবসাইট থেকে এর তথ্য সরিয়ে ফেলে।
বিএসইসির পরিচালক ও মুখপাত্র মো. আবুল কালাম জানান, আগের উপদেষ্টা কমিটি বাতিল করা হয়েছে এবং প্রয়োজনে ভবিষ্যতে নতুন কমিটি গঠন করা হবে।
এরই মধ্যে চলতি বছরের ১৭ মার্চ অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ থেকে বিএসইসিকে আরও কার্যকর ও শক্তিশালী করতে এবং বাজারে নজরদারি বাড়াতে একটি নতুন চার সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে। এই কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী আনিসুজ্জামান চৌধুরী। বিএসইসির কমিশনার অধ্যাপক ফারজানা লালারুখ এই কমিটির সদস্য সচিব। অন্য সদস্যরা হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাইন্যান্স বিভাগের অধ্যাপক ড. সাদেকুল ইসলাম এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের ইনস্যুরেন্স ও ক্যাপিটাল মার্কেট শাখার একজন অতিরিক্ত সচিব।
নতুন এই কমিটি বিএসইসিকে আরো কার্যকর করে তুলতে পুঁজিবাজারে তারল্য বৃদ্ধি, করপোরেট সুশাসন জোরদার, নতুন কোম্পানি তালিকাভুক্তির পরিবেশ তৈরি, বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করা এবং বাজারে স্থিতিশীলতা আনার বিষয়ে সুপারিশ করবে।
পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, পূর্বের উপদেষ্টা কমিটির ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নিয়ে নতুন এই কমিটিকে কার্যকর ও উদ্দেশ্যভিত্তিক করে গড়ে তোলার মাধ্যমে দেশের পুঁজিবাজারে কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন আনা সম্ভব হবে।

