২০২৪ সাল দেশের পুঁজিবাজারের জন্য ছিল একেবারেই হতাশার বছর। মন্দা বাজারে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের মতো ব্যাংকগুলোও বড় ধরনের লোকসানের মুখে পড়ে। পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করে লোকসান করেছে তালিকাভুক্ত ও তালিকাভুক্ত নয়—মোট ৩৪ ব্যাংকের মধ্যে ৩১টি। লোকসানের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৩ হাজার ৬৩০ কোটি টাকা। বিপরীতে লাভ করেছে মাত্র তিনটি ব্যাংক, যার অঙ্ক ২৩ কোটি টাকা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সব ব্যাংকের পূর্ণাঙ্গ তথ্য প্রকাশ হলে প্রকৃত লোকসানের অঙ্ক আরও বড় হতে পারে।
প্রকাশিত তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, লোকসান করা ব্যাংকগুলোর মধ্যে শীর্ষে জনতা ব্যাংক, যার লোকসান প্রায় ৪০০ কোটি টাকা। দ্বিতীয় স্থানে সোনালী ব্যাংক, লোকসান ৩৯৮ কোটি টাকা। শীর্ষ পাঁচ ব্যাংকের তালিকায় আরও রয়েছে ইস্টার্ন ব্যাংক (৩৫৩ কোটি), সাউথইস্ট ব্যাংক (৩২৬ কোটি) এবং এবি ব্যাংক (২৬১ কোটি)। এই পাঁচ ব্যাংকের লোকসানের পরিমাণই ১ হাজার ৭৩৮ কোটি টাকা।
অন্যদিকে বাকি ২৬ ব্যাংক লোকসান করেছে প্রায় ১ হাজার ৮৯১ কোটি টাকা। এর মধ্যে এক্সিম ব্যাংক ২২৮ কোটি, ন্যাশনাল ব্যাংক ২১৭ কোটি, অগ্রণী ব্যাংক ২১৬ কোটি, উত্তরা ব্যাংক ১৭২ কোটি, এনসিসি ব্যাংক ১৬৫ কোটি, রূপালী ব্যাংক ১৫৩ কোটি এবং আরও বেশ কয়েকটি ব্যাংক কয়েক কোটি থেকে শত কোটি টাকার লোকসানে পড়েছে।
লাভ করেছে কেবল তিনটি ব্যাংক—মার্কেন্টাইল ব্যাংক (১২ কোটি), ব্র্যাক ব্যাংক (৭ কোটি) এবং প্রাইম ব্যাংক (৪ কোটি টাকা)।
বাজার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অদূরদর্শী বিনিয়োগ, ফ্লোর প্রাইস নীতি, জাঙ্ক শেয়ারে বড় অঙ্কের বিনিয়োগ এবং তহবিল ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতার কারণে ব্যাংকগুলো এই ক্ষতির মুখে পড়েছে।
পুঁজিবাজার সংস্কার টাস্কফোর্সের সদস্য অধ্যাপক আল-আমিন বলেন, “বিগত বছরগুলোতে কোনো ক্ষেত্রেই সুশাসন ছিল না। অনেক ব্যাংক ও ব্রোকারেজ হাউসে অনিয়ম ছিল। আইসিবি ফরচুনের শেয়ারে বিনিয়োগ করে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ব্যাংকগুলোতেও একই ধরনের সমস্যা দেখা গেছে।”
বাংলাদেশ একাডেমি ফর সিকিউরিটিজ মার্কেটসের মহাপরিচালক তৌফিক আহমেদ চৌধুরীর প্রশ্ন, “একটি ব্যাংক কীভাবে জাঙ্ক শেয়ারে বিনিয়োগ করে? যাদের দীর্ঘমেয়াদি দায় আছে, তাদের জন্য এমন বিনিয়োগ ঝুঁকিপূর্ণ।”
এজ অ্যাসেট ম্যানেজমেন্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলী ইমাম মনে করেন, লোকসানের বড় কারণ দক্ষতার ঘাটতি। তার ভাষায়, “ব্যাংক কর্মকর্তারা ঋণ ব্যবস্থাপনায় অভিজ্ঞ হলেও শেয়ারবাজার বিনিয়োগের জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ নেই। ফলে পোর্টফোলিও ম্যানেজমেন্টে ব্যর্থ হচ্ছেন।”
ব্যাংকগুলোর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করলেও অনেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে সাউথইস্ট ব্যাংকের কোম্পানি সচিব মামুনুর রশিদ বলেন, “পুঁজিবাজার খারাপ ছিল, তাই শেয়ারের দাম কমেছে। বাজার ভালো হলে পরিস্থিতি পাল্টে যাবে।”
ইবিএলের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “ফ্লোর প্রাইসের কারণে সময়মতো শেয়ার বিক্রি করা যায়নি। এর সঙ্গে রয়েছে মার্জিন ঋণের চাপ, ব্যবস্থাপনা ব্যয় এবং বৈশ্বিক অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ।”
২০২৪ সালে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের প্রধান সূচক ডিএসইএক্স কমেছে ১ হাজার ২৬ পয়েন্ট বা প্রায় ১৬ শতাংশ। আগস্টে রাজনৈতিক পরিবর্তন এবং বেক্সিমকো গ্রুপের শেয়ারের দর অর্ধেক নেমে যাওয়া ব্যাংকগুলোর লোকসানকে আরও বাড়িয়েছে। বেক্সিমকো গ্রিন সুকুক বন্ডসহ বেশ কয়েকটি ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগ ব্যাংকগুলোকে ক্ষতির মুখে ফেলে।
২০২৪ সালের লোকসান প্রমাণ করে ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগ পদ্ধতিতে বড় ধরনের সমস্যা রয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, কেবল মন্দা বাজার নয়, দক্ষতার ঘাটতি এবং অনিয়মই ব্যাংকগুলোর বড় ক্ষতির মূল কারণ।