বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে নেমেছে নজিরবিহীন অস্থিরতা। শুধু সূচক পতন বা লেনদেন কমে যাওয়াই নয়—বিনিয়োগকারীদের আস্থা ভেঙে পড়েছে চূড়ান্তভাবে। বাজারে এখন কাজ করছে অদৃশ্য এক আতঙ্ক। প্রতিদিনই যেন নতুন অন্ধকার নেমে আসছে। ২০১০ সালের ধসের ভয়াবহ স্মৃতি আবারও তাড়া করছে বিনিয়োগকারীদের।
সাধারণ বিনিয়োগকারীরা অসহায়ভাবে দেখছেন—তাদের কষ্টার্জিত পুঁজি দিনের পর দিন গলে যাচ্ছে। একসময় আশার প্রতীক ছিল যে বাজার, তা এখন ধ্বংসস্তূপের ওপর দাঁড়িয়ে হাহাকার করছে।
ফ্লোর প্রাইস প্রত্যাহারের পর শেয়ার বিক্রির হিড়িক শুরু হয়েছে। একে বলা হয় প্যানিক সেল—যেখানে লোকসান মেনেও শেয়ার বিক্রি করছেন বিনিয়োগকারীরা। মাত্র কয়েক সপ্তাহে প্রধান সূচক ডিএসইএক্স (DSEX) ৫৭৪ থেকে ৬৮৫ পয়েন্ট পর্যন্ত নেমে গেছে।
শুধু তাই নয়, মাত্র তিন কার্যদিবসে ৮০৬টি বিও (Beneficiary Owner) অ্যাকাউন্ট একেবারে খালি হয়ে গেছে। বিনিয়োগকারীরা কেবল লোকসানই মেনে নেননি, বরং বাজার ছেড়েই দিয়েছেন। এটি প্রমাণ করে—পুঁজিবাজার এখন আর বিনিয়োগকারীদের কাছে নিরাপদ নয়।
বাজার যখন ভয় ও অনিশ্চয়তায় ডুবে, তখন নিয়ন্ত্রক সংস্থার দায়িত্ব ছিল স্থিতি ফিরিয়ে আনা। কিন্তু বাস্তবে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারেনি।
বিনিয়োগকারীদের অভিযোগ, বাজার হয় কারসাজিকারীদের নিয়ন্ত্রণে, নয়তো নিয়ন্ত্রকই অসহায়। আস্থাহীনতার মূল শিকড় এখানে। যদি শক্তিশালী নিয়ন্ত্রণ থাকত, বিনিয়োগকারীরা লোকসান সত্ত্বেও শেয়ার ধরে রাখতেন। কিন্তু নিষ্ক্রিয়তার কারণে তারা বিশ্বাস হারিয়েছেন।
পুঁজিবাজারের দুরবস্থা কেবল নিয়ন্ত্রকের ব্যর্থতায় সীমাবদ্ধ নয়। দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির টালমাটাল অবস্থাও এতে বড় ভূমিকা রাখছে।
সুদের হার বৃদ্ধি: কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কঠোর মুদ্রানীতির ফলে সুদের হার বেড়ে গেছে। ব্যাংকের ডিপোজিট ও বন্ড এখন তুলনামূলক বেশি লাভজনক। এতে ইকুইটি মার্কেটে তারল্য কমে গেছে।
আন্তঃব্যাংক কলমানি মার্কেটে সুদের হার ৭.৫০ শতাংশ থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯.২৪ শতাংশে। ৯০ দিনের কলমানি মার্কেটে হার পৌঁছেছে ১২ শতাংশে। সরকারের অতিরিক্ত ঋণ গ্রহণ, বেসরকারি খাতের চাহিদা ও ডলার সংকটের প্রভাবে টাকার জোগান ভয়াবহভাবে কমে গেছে।
সুশাসনের অভাব: বিশ্বের অন্যান্য বাজারও চাপের মুখে থাকে। তবে বাংলাদেশে পতন হচ্ছে অস্বাভাবিক দ্রুত। কারণ, এখানে বাজার টেকসই অর্থায়নের ক্ষেত্র নয়, বরং ফাটকাবাজির ওপর নির্ভরশীল। ২০১০ সালের ধসের পরও শিক্ষা না নেওয়ায় আবারও একই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।
বিএসইসি এখন নিজেই অরাজকতায় ভুগছে। কর্মকর্তারা প্রকাশ্যে চেয়েছেন চেয়ারম্যান ও কমিশনারদের পদত্যাগ। অফিসে তালা ঝোলানো, সিসি ক্যামেরা কেটে অস্থিরতা সৃষ্টি—এসব ঘটনার মধ্য দিয়ে স্পষ্ট হয়েছে, নিয়ন্ত্রক সংস্থা নিজেই নিয়ন্ত্রণহীন।
সাবেক চেয়ারম্যান শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলামের বিরুদ্ধে প্রায় এক হাজার কোটি টাকার দুর্নীতির তদন্ত চলছে। বর্তমান চেয়ারম্যান খন্দকার রাশেদ মাকসুদ অনিয়ম উন্মোচনের চেষ্টা শুরু করতেই ভেতরে বিদ্রোহ দেখা দিয়েছে।
যখন নিয়ন্ত্রক সংস্থা দুর্নীতি, দ্বন্দ্ব ও অযোগ্যতায় ভুগে, তখন বাজারে স্থিতি ফিরবে কীভাবে? বরং এতে কারসাজিকারীরা আরও শক্তিশালী হচ্ছে।
বিনিয়োগকারীরা প্রকাশ্যে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ ও বিএসইসি চেয়ারম্যান খন্দকার রাশেদ মাকসুদের অপসারণ দাবি করেছেন।
অভিযোগ রয়েছে, চেয়ারম্যানের নিয়োগ হয়েছে স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে। মেধা নয়, রাজনৈতিক সম্পর্কই ছিল প্রধান ভিত্তি। ফলে সামান্য যে আস্থা ছিল, সেটিও ভেঙে গেছে।
অন্যদিকে, বাজেট নিয়ে অর্থ উপদেষ্টার মন্তব্য—“জনগণ কর দেয় কিন্তু সেবা পায় না”—বিনিয়োগকারীদের ক্ষোভ আরও বাড়িয়েছে। তাদের বিশ্বাস, নীতি নির্ধারকেরা বাজারের প্রকৃত সংকট উপলব্ধি করছেন না।
প্রশ্ন জাগছে—এই সংকট থেকে মুক্তির উপায় কী?
নেতৃত্ব পরিবর্তন: যোগ্য, অভিজ্ঞ ও নৈতিক নেতৃত্ব ছাড়া আস্থা ফিরবে না। রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত নিয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।
আইন প্রয়োগ: কারসাজি, ইনসাইডার ট্রেডিংসহ সব অপরাধে শূন্য সহনশীলতা নীতি নিতে হবে। অতীত ও বর্তমানের সব দুর্নীতি দ্রুত তদন্ত করে দোষীদের শাস্তি দিতে হবে।
বিনিয়োগবান্ধব করনীতি: তালিকাভুক্ত কোম্পানির কর ছাড়, উৎসে কর কমানো এবং ছোট বিনিয়োগকারীদের জন্য কর সুবিধা ফিরিয়ে আনতে হবে। এতে বাজারে নতুন প্রাণ ফিরবে।
আজকের পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারীদের কাছে আশার প্রতীক নয়, বরং লুটের ময়দান। যেখানে সৎ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, আর অসাধুরা পুরস্কৃত হয়।
যখন নিয়ন্ত্রক সংস্থার কর্মীরাই বিদ্রোহ করে, তখন স্পষ্ট হয়—ভেতরের পচন কতটা গভীর। তাই এখনই প্রয়োজন নেতৃত্ব পরিবর্তন, দুর্নীতিবাজদের শাস্তি ও স্বজনপ্রীতির অবসান। নৈতিক শুদ্ধি অভিযান ছাড়া এ বাজারে আস্থা ফিরবে না।