উচ্চ মূল্যস্ফীতি, ব্যাংকঋণের উচ্চ সুদহার এবং সামগ্রিক অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা ক্রমেই শেয়ারবাজার থেকে সরে যাচ্ছেন। এ পরিস্থিতিতে পুঁজিবাজারে নতুন গতি আনতে ৫০টি বড় প্রতিষ্ঠানকে তালিকাভুক্ত করতে আহ্বান জানিয়েছে সরকার।
সরকার জানিয়েছে, তালিকাভুক্ত হলে এসব প্রতিষ্ঠান বিশেষ সুবিধা পাবে। কিন্তু বাজারে না এলে নতুন কোনো সুবিধা দেওয়া হবে না। বরং করছাড়সহ বিদ্যমান বিভিন্ন সরকারি সহায়তা কমানো হবে। এই নির্দেশ কার্যকর করতে সরকারি ও বেসরকারি খাতের প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি উচ্চপর্যায়ের টাস্কফোর্স গঠন করার পরিকল্পনাও নেওয়া হয়েছে।
প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় ও অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, সরকার পুঁজিবাজারকে দেশের অর্থসংগ্রহের প্রধান উৎস হিসেবে শক্ত অবস্থানে নিতে চায়।
বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) মুখপাত্র ও পরিচালক মো. আবুল কালাম বলেন, “পুঁজিবাজারে গতি আনতে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের ওপর নির্ভরতা কমাতে হবে। এজন্য বড় কোম্পানিগুলোকে বাজারে আনতে সরকারের পক্ষ থেকে আবারও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তালিকাভুক্ত হলে তারা বিভিন্ন সরকারি সুবিধা পাবে। তবে বাজারে না এলে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশের (আইসিবি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, “বড় কোম্পানিগুলো পুঁজিবাজারে এলে বাজারে স্বস্তি ফিরবে। আমরা ইতোমধ্যে কিছু কোম্পানির তালিকা প্রস্তুত করছি। ভারত ও পাকিস্তানের মতো দেশে এসব কোম্পানি শেয়ারবাজারে রয়েছে। আমাদের দেশেও তাদের আনা জরুরি। না এলে করছাড়সহ বিভিন্ন সুবিধা কমিয়ে দেওয়া হবে। এবার আমরা সফল হবো বলে আশা করছি।”
প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, “অন্তর্বর্তী সরকার পুঁজিবাজারে গতি আনতে কঠোর অবস্থান নিয়েছে। বর্তমান মেয়াদে বড় কোম্পানিগুলোকে তালিকাভুক্ত করার চূড়ান্ত পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। বহুজাতিক কোম্পানিগুলোকেও এতে যুক্ত করা জরুরি।”
প্রতিবেদনটিতে আরও বলা হয়, “বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন, শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হলে তারা অতিরিক্ত কোনো সুবিধা পান না। করহার বেশি এবং প্রক্রিয়াও জটিল। ফলে তারা বিকল্প উৎস থেকে অর্থায়ন করতে বেশি আগ্রহী।”
সরকারি প্রতিবেদনে স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়, বিগত সরকারের সময়ে উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে সাধারণ মানুষ দিশেহারা ছিল। অনেকেই আয় বাড়ানোর আশায় সঞ্চয়ের টাকা পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করেছিলেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত নিঃস্ব হয়েছেন। গত ১৫–১৬ বছরে প্রায় ১৪ লাখ বিনিয়োগকারী বাজার ছাড়েন।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বিগত সরকারের প্রভাবশালী কিছু অসৎ বিনিয়োগকারী বাজার থেকে বিপুল অর্থ আত্মসাৎ করে বিদেশে পাচার করেছেন। এসব কারণে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা এখন ঝুঁকি এড়িয়ে সঞ্চয়পত্র বা ব্যাংকের ফিক্সড ডিপোজিটের মতো নিরাপদ খাতে অর্থ রাখছেন।
অর্থ আত্মসাৎকারীদের বিচার না হওয়াকেও বাজার থেকে সরে যাওয়ার বড় কারণ হিসেবে দেখা হচ্ছে। সরকার জানিয়েছে, দুর্নীতিবাজদের চিহ্নিত করে শাস্তি কার্যকর করা হবে। এতে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরবে বলে আশা করা হচ্ছে।
সরকারি প্রতিবেদনে উল্লেখ আছে, বহুদিন ধরে বড় মাপের সরকারি, বেসরকারি ও বহুজাতিক কোম্পানিকে শেয়ারবাজারে আনার চেষ্টা চলছে, কিন্তু তেমন অগ্রগতি হয়নি।
বাজারে আনার লক্ষ্যে চিহ্নিত ১০টি বহুজাতিক কোম্পানি হলো— ইউনিলিভার বাংলাদেশ লিমিটেড, কর্ণফুলী ফার্টিলাইজার কোম্পানি (কাফকো), সাইনোভিয়া বাংলাদেশ, নোভার্টিস বাংলাদেশ, সিনজেন্টা বাংলাদেশ, পশ্চিমাঞ্চল গ্যাস কোম্পানি, সিলেট গ্যাসফিল্ডস, কর্ণফুলী গ্যাস কোম্পানি, নর্থ-ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি ও নেসলে বাংলাদেশ পিএলসি।
সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, বহুজাতিক কোম্পানির ক্ষেত্রে সরকারি মালিকানার ৫ শতাংশ এবং বিদেশি কোম্পানির ৫ শতাংশ—মোট ১০ শতাংশ শেয়ার বাজারে ছাড়ার পরিকল্পনা রয়েছে।
এছাড়া সরকারি মালিকানাধীন যেসব প্রতিষ্ঠানকে বাজারে আনার বিষয়ে আলোচনা চলছে, তার মধ্যে রয়েছে— নর্থওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি, বাখরাবাদ গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি, গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানি, জালালাবাদ গ্যাস সিস্টেম, বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন কোম্পানি (বিটিসিএল), সোনারগাঁও হোটেল, ছাতক সিমেন্ট ফ্যাক্টরি, লিকুফায়েড পেট্রোলিয়াম গ্যাস, সিলেট গ্যাসফিল্ড, রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস কোম্পানি, প্রগতি ইন্ডাস্ট্রিজ, চিটাগাং ডকইয়ার্ড, কর্ণফুলী পেপার মিলস, বাংলাদেশ ইনস্যুলেটর অ্যান্ড স্যানিটারিওয়্যার ফ্যাক্টরি, আশুগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন, ইলেকট্রিসিটি জেনারেশন কোম্পানি অব বাংলাদেশ, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস, টেলিটক ও টেলিফোন শিল্প সংস্থা।
সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি বাংলাদেশ লিমিটেডের (সিডিবিএল) সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বর শেষে দেশের মোট বিও (বেনিফিশিয়ারি ওনার্স) হিসাব দাঁড়িয়েছে ১৬ লাখ ৩২ হাজার ২২৭টি। গত বছরের ডিসেম্বর শেষে সংখ্যা ছিল ১৬ লাখ ৮২ হাজার ৪৫২টি। নয় মাসে কমেছে ৩০ হাজার ২২৫টি হিসাব।
একই সময়ে শেয়ারবিহীন বিও হিসাব বেড়েছে ৩১ হাজার ৮৮৫টি। সব মিলিয়ে ৬২ হাজার ১১০ বিনিয়োগকারী কার্যত বাজারবিমুখ হয়েছেন। বর্তমানে শেয়ারবিহীন বিও হিসাবের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৭৫ হাজার ৮৫৯টি, যা গত বছরের ডিসেম্বর ছিল ৩ লাখ ৪৩ হাজার ৯৭৪টি।