বিশ্বের বৃহত্তম দুই অর্থনীতি যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে আবারও বাণিজ্যযুদ্ধের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এই উত্তেজনার প্রভাব পড়েছে এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের শেয়ারবাজারে। গতকাল সোমবার অঞ্চলটির প্রায় সব প্রধান সূচকেই দেখা গেছে পতন।
হংকংয়ের হ্যাং সেং সূচক গতকাল ২ দশমিক ২ শতাংশ কমেছে। চীনের সাংহাই কম্পোজিট ও দক্ষিণ কোরিয়ার কসপি সূচক কমেছে যথাক্রমে দশমিক ২ ও দশমিক ৭ শতাংশ। অস্ট্রেলিয়ার এসঅ্যান্ডপি/এএসএক্স ২০০ সূচক কমেছে দশমিক ৮ শতাংশ। তাইওয়ানের তাইএক্স সূচক ১ দশমিক ৪ শতাংশ এবং ভারতের সেনসেক্স সূচক দশমিক ৪ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। ছুটির কারণে টোকিও স্টক এক্সচেঞ্জ বন্ধ ছিল। এর আগে শুক্রবার মার্কিন শেয়ারবাজারে বড় ধস নামে। এসঅ্যান্ডপি ৫০০ সূচক ২ দশমিক ৭ শতাংশ কমে, যা এপ্রিলের পর একদিনে সবচেয়ে বড় পতন। ডাও জোন্স ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যাভারেজ কমেছে ১ দশমিক ৯ শতাংশ এবং নাসডাক সূচক ৩ দশমিক ৬ শতাংশ।
বিশ্লেষকদের মতে, গত শুক্রবারের এই ধস নতুন করে বাণিজ্য উত্তেজনার ইঙ্গিত দিচ্ছে। এসঅ্যান্ডপি ৫০০ সূচকের প্রতি সাতটির মধ্যে ছয়টি শেয়ার কমেছে। বড় প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান এনভিডিয়া ও অ্যাপল থেকে শুরু করে ছোট কোম্পানিগুলোকেও প্রভাবিত করেছে। সব খাতেই শুল্ক ও বাণিজ্য অনিশ্চয়তার প্রভাব পড়ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দুষ্প্রাপ্য খনিজের সরবরাহ চেইন এখন বাজারের বড় উদ্বেগের কারণ। বিশ্বে এসব খনিজের প্রধান উৎস চীন। ডোনাল্ড ট্রাম্প দেশটি থেকে পণ্যে নতুন শুল্ক আরোপের হুমকি দেওয়ার আগেই বেইজিং গুরুত্বপূর্ণ খনিজ পণ্যের রফতানিতে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছে। বিদ্যুচ্চালিত গাড়ি থেকে জেট ইঞ্জিন—প্রায় সব শিল্পেই এসব কাঁচামাল অপরিহার্য। ফলে বৈশ্বিক বাজারে অস্থিরতা বেড়েছে।
এতদিন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র ও চীন উভয় পক্ষ থেকেই আলোচনায় অগ্রগতির ইঙ্গিত মিলছিল। তবে সেপ্টেম্বরের শেষদিকে ওয়াশিংটন বেইজিংকে লক্ষ্য করে একের পর এক রফতানি নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে। চীনের নতুন খনিজ রফতানি বিধিনিষেধ পুরোপুরি কার্যকর হবে আগামী মাসে। এতে জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও তাইওয়ানের উৎপাদন খাত বড় ধাক্কা খেতে পারে।
ডোনাল্ড ট্রাম্প শুক্রবার ঘোষণা দেন, আগামী ১ নভেম্বর থেকে চীনা পণ্যের ওপর অতিরিক্ত ১০০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হবে। এতে মোট শুল্কহার দাঁড়াবে প্রায় ১৩০ শতাংশ। বিশ্লেষকদের মতে, এটি কার্যত একধরনের বাণিজ্য অবরোধ, যা স্থগিত থাকা সর্বোচ্চ ১৪৫ শতাংশ শুল্কের কাছাকাছি। রোববার চীন পাল্টা হুঁশিয়ারি দিয়ে জানায়, ট্রাম্প যদি হুমকি বাস্তবায়ন করেন তবে বেইজিংও পাল্টা ব্যবস্থা নেবে। চীনের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় জানায়, বেইজিং বাণিজ্যযুদ্ধকে ভয় পায় না, তবে এখনো আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের সুযোগ রয়েছে।
চীনা মন্ত্রণালয় আরো জানায়, দুষ্প্রাপ্য খনিজ রফতানিতে আরোপিত বিধিনিষেধ বৈধ পদক্ষেপ এবং যুক্তরাষ্ট্রই সর্বশেষ উত্তেজনার জন্য দায়ী। কারণ, মাদ্রিদে সেপ্টেম্বরের বাণিজ্য আলোচনার দুই সপ্তাহের মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্র নতুন বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। তবে যুক্তরাষ্ট্র কিছুটা নরম অবস্থানও নিয়েছে। রোববার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে ট্রাম্প লেখেন, “যুক্তরাষ্ট্র চীনকে সাহায্য করতে চায়, ক্ষতি করতে নয়। চিন্তার কিছু নেই, সব ঠিক হয়ে যাবে।” এরপর সোমবার মার্কিন ফিউচার্স বাজারে কিছুটা উত্থান দেখা যায়। এসঅ্যান্ডপি ৫০০ ফিউচার্স সূচক বেড়েছে ১ দশমিক ৪ শতাংশ এবং ডাও জোন্স ফিউচার্স বেড়েছে ১ শতাংশ।
চীনা শুল্ক দপ্তরের তথ্য বলছে, সেপ্টেম্বরে দেশটির রফতানি আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৮ দশমিক ৩ শতাংশ বেড়েছে—যা ছয় মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ প্রবৃদ্ধি। তবে যুক্তরাষ্ট্রে চীনা রফতানি কমেছে ২৭ শতাংশ। তবে বাজার বিশ্লেষকদের মতে, যুক্তরাষ্ট্রের শেয়ারবাজার আগেই অতিমূল্যায়িত হয়ে উঠেছিল। এপ্রিলের নিম্নতম স্তর থেকে এসঅ্যান্ডপি ৫০০ সূচক প্রায় ৩৫ শতাংশ বেড়ে যায়। অনেকে মনে করেন, করপোরেট মুনাফার তুলনায় শেয়ারদর অনেক দ্রুত বাড়ছে, যা ঝুঁকিপূর্ণ। বিশেষ করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা খাতের কোম্পানিগুলোর মূল্যায়ন নিয়ে ২০০০ সালের ডটকম বাবলের পুনরাবৃত্তির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
বাণিজ্য উত্তেজনার প্রভাব পড়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি বন্ড বাজারেও। ১০ বছর মেয়াদি বন্ডের ইল্ড বৃহস্পতিবারের ৪ দশমিক ১৪ শতাংশ থেকে কমে ৪ দশমিক শূন্য ৫ শতাংশে নেমে আসে। তবে ট্রাম্পের হুমকির আগেই ইল্ড কমছিল। মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সমীক্ষা অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রে ভোক্তাদের নেতিবাচক মনোভাবই এর প্রধান কারণ।