দেশের একমাত্র রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ ব্যাংক ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি) আবারও পড়েছে তারল্য সংকটে। চলমান এই আর্থিক চাপে প্রতিষ্ঠানটিকে টিকিয়ে রাখতে সরকার এখন ১ হাজার কোটি টাকার সহায়তা দেওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের সূত্র বলছে, এই বরাদ্দটি সংশোধিত জাতীয় বাজেটের মধ্যেই আসতে পারে—লক্ষ্য, শেয়ারবাজারে স্থিতিশীলতা ফেরানো এবং আইসিবির দায় পরিশোধে স্বস্তি আনা।
সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তারা বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেছেন। ওয়াশিংটন সফর শেষে অর্থ উপদেষ্টা দেশে ফিরলে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হতে পারে বলে জানা গেছে।
আইসিবি মূলত স্থায়ী আমানত রসিদ (এফডিআর) ও বন্ড ইস্যুর মাধ্যমে তহবিল সংগ্রহ করে থাকে। সেই অর্থ দিয়েই তারা বাজারে বিনিয়োগ করে। ২০১০ সাল থেকে প্রতিষ্ঠানটি এই পথে প্রায় ১৩ হাজার কোটি টাকা তুলেছে। কিন্তু সময়মতো ঋণ পরিশোধে না পারায় এবং সুদের বোঝা বেড়ে যাওয়ায় এখন চরম তারল্য সংকটে পড়েছে তারা।
সেপ্টেম্বর নাগাদ ৬ হাজার কোটি টাকার (মূলধন ও সুদসহ) পরিশোধের সময়সীমা পেরিয়ে গেছে। প্রতি মাসে প্রায় ৯০ কোটি টাকা সুদ দিতে হচ্ছে প্রতিষ্ঠানটিকে—যা বর্তমান আয়ে মেটানো সম্ভব হচ্ছে না।
এমন অবস্থায়ও সরকার সম্প্রতি আইসিবিকে নির্দেশ দেয় ৮০ কোটি টাকায় ন্যাশনাল টি কোম্পানির ৬৬ লাখ শেয়ার কিনতে, যা প্রতিষ্ঠানটির আর্থিক চাপ আরও বাড়িয়ে দেয়।
আইসিবিকে সহায়তার বিষয়ে প্রস্তাব পেলে বাংলাদেশ ব্যাংক তা প্রত্যাখ্যান করে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মতে, এভাবে অর্থ দিলে দেশে মূল্যস্ফীতি আরও বাড়তে পারে। ব্যাংকটি এক চিঠিতে জানায়—এই ধরনের দীর্ঘমেয়াদি ঋণ “বাংলাদেশ ব্যাংক আদেশ–১৯৭২”–এর পরিপন্থী এবং বর্তমান সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
তবে বাংলাদেশ ব্যাংক বিকল্প পরামর্শ দিয়েছে—এই অর্থ সরাসরি সরকার বাজেটের মাধ্যমে বরাদ্দ দিতে পারে। এতে মুদ্রাস্ফীতির চাপ তুলনামূলকভাবে কম থাকবে।
ফাইন্যান্সিয়াল ইনস্টিটিউশন ডিভিশন (এফআইডি) ইতিমধ্যেই অর্থ মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছে, আইসিবিকে স্বল্পসুদে ১০ বছরের জন্য অন্তত ১৩ হাজার কোটি টাকার তহবিল দেওয়া দরকার। এর মধ্যে প্রথম দুই বছর থাকবে গ্রেস পিরিয়ড। তাদের মতে, আইসিবি পুঁজিবাজারে স্থিতিশীলতা আনার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে—তাই প্রতিষ্ঠানটিকে টিকিয়ে রাখা এখন জরুরি।
আইসিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবু আহমেদও এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “প্রতিষ্ঠানটির বিশাল দায়ের পরিপ্রেক্ষিতে কমপক্ষে ৫ হাজার কোটি টাকার সহায়তা দরকার। তাঁরা জানিয়েছেন, জানুয়ারির মধ্যে কিছু অর্থ ছাড় হতে পারে, তবে আমরা চাই যত দ্রুত সম্ভব এই সহায়তা পাওয়া যাক।”
তার যুক্তি, বাজার এখন নিম্নমুখী, তাই এই মুহূর্তে বিনিয়োগ করলে দ্রুত মূলধনী লাভের সুযোগ তৈরি হবে—যা দিয়ে পুরনো দেনা পরিশোধও করা সম্ভব।
গত এক মাসে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ৫১২ পয়েন্ট কমে প্রায় ১০ শতাংশ নিচে নেমে গেছে। বাজারের এই নিম্নগতি সামাল দিতে আইসিবির মতো প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ, কারণ তারা বড় পরিমাণে শেয়ার ক্রয়-বিক্রয়ের মাধ্যমে বাজারে আস্থা ফেরাতে পারে।
এর আগে ২০২৪ সালে সরকার সার্বভৌম গ্যারান্টির মাধ্যমে আইসিবিকে ৩ হাজার কোটি টাকার সহায়তা দেয়। এর মধ্যে ২ হাজার কোটি টাকা ঋণ পরিশোধে ব্যবহৃত হয়, আর বাকি অর্থ শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করা হয়। আইসিবি চেয়ারম্যানের দাবি, সেই বিনিয়োগে ইতোমধ্যে প্রায় ২০ শতাংশ মূলধনী লাভ এসেছে।
তবু সংকটের চাপ এতটাই গভীর যে নতুন সহায়তা ছাড়া প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম সচল রাখা কঠিন হয়ে পড়ছে।
বাংলাদেশের শেয়ারবাজারে দীর্ঘদিন ধরেই তারল্য ঘাটতি ও বিনিয়োগ স্থবিরতার অভিযোগ আছে। আইসিবি সেই স্থবিরতা কাটাতে একসময় ‘মার্কেট মেকার’ হিসেবে কাজ করত। এখন সেই আইসিবিই টিকে থাকার লড়াইয়ে। সরকার যদি এবারও সহায়তায় এগিয়ে আসে, তবে তা শুধু একটি প্রতিষ্ঠানের বাঁচার প্রশ্ন নয়—বরং পুরো পুঁজিবাজারের আস্থার সঙ্গেই জড়িত।