চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের গতি কমেছে। তার প্রভাব পড়েছে করপোরেট খাতের মুনাফায়। জুলাই-সেপ্টেম্বর মেয়াদে সোমবার পর্যন্ত পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ১১০টি কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদ তাদের ব্যবসায় আয়-ব্যয়ের হিসাব প্রকাশ করেছে। এর মধ্যে ৫৪টি কোম্পানির শেয়ারপ্রতি মুনাফা বা ইপিএস কমেছে। এটি প্রমাণ করে, বাজারে চাহিদা কমেছে, ব্যয় বেড়েছে এবং মুনাফার জায়গা সংকুচিত হয়েছে।
অন্যদিকে, ৫১টি কোম্পানি বা ৪৬.৩৬ শতাংশের ইপিএস বেড়েছে। পাঁচটি কোম্পানির আয়-ব্যয় অপরিবর্তিত রয়েছে। কিন্তু সবচেয়ে চিন্তার বিষয়, ৩১টি কোম্পানি বা ২৮.১৮ শতাংশ এখনও লোকসানে আছে। অর্থাৎ ব্যবসার খরচ বেড়েছে, বিক্রি চাপে পড়েছে এবং মুনাফায় ফেরার পথ এখনো কঠিন। প্রান্তিকের এই হিসাব দেখাচ্ছে, করপোরেট খাত চাপে এবং সেই চাপ সরাসরি পুঁজিবাজারে ধাক্কা দিচ্ছে। বিশ্লেষকদের মতে, ব্যবসায় প্রবৃদ্ধির ধীরগতি, পরিচালন ব্যয় বৃদ্ধি এবং ঋণ ও করের চাপই অধিকাংশ কোম্পানির মুনাফা কমার প্রধান কারণ।
পুঁজিবাজার সংস্কার টাস্কফোর্সের সদস্য ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাববিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আল-আমিন বলেন, “বেশির ভাগ কোম্পানির ব্যবসায় প্রবৃদ্ধি ভালো নয়। পরিচালন খরচ বেড়ে গেছে। কর এবং আর্থিক ব্যয়ের চাপ বেড়েছে। ফলে নিট মুনাফার মার্জিন সংকুচিত হয়েছে।” তিনি আরও বলেন, “সার্বিকভাবে ব্যবসার খরচ বেড়েছে। কাঁচামাল আমদানি, ভাড়া ও ডলারের দামের কারণে ব্যয় বেড়েছে। প্রযুক্তি খাতে সেবা মূল্যও বৃদ্ধি পেয়েছে। ব্যাংকের সুদের হার বেশি হওয়ায় ঋণনির্ভর কোম্পানির ব্যয় আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে। পণ্যের দাম বাড়াতে না পারায় লাভ কমেছে।” জেএমআই হসপিটালের কর্তৃপক্ষও জানিয়েছে, সেবা ও পণ্য বিক্রি কমেছে। কিন্তু পরিচালন ব্যয় সেই অনুযায়ী কমেনি।
লোকসান আরও বেড়েছে যেসব কোম্পানির:
মোট ১৩টি লোকসানি কোম্পানির লোকসান আরও বেড়েছে। কিছু কোম্পানির আর্থিক অবস্থা সরাসরি ঝুঁকিপূর্ণ স্তরে পৌঁছেছে, যা তাদের ইপিএস থেকে বোঝা যাচ্ছে। সবচেয়ে বড় ধাক্কা লেগেছে এসকোয়ার নিটে। আগের ইপিএস ছিল ঋণাত্মক ৭ পয়সা, এখন বেড়ে হয়েছে ঋণাত্মক ১ টাকা ১০ পয়সা। লোকসান এক লাফে বেড়েছে ১,৪৭১ শতাংশ, যা কোম্পানির জন্য খুবই কঠিন পরিস্থিতি।
মেঘনা সিমেন্টের অবস্থাও ভয়াবহ। লোকসান বেড়ে ৫৪৪ শতাংশ, ইপিএস নেমে ঋণাত্মক ২১ টাকা ১৯ পয়সায়। টাকার পরিমাণে এটি পুরো তালিকার মধ্যে সবচেয়ে বড় লোকসান। বিবিএস কেব্লস ও বসুন্ধরা পেপার মিলের পরিস্থিতিও খারাপ। বিবিএস কেব্লসের লোকসান বেড়েছে ৩৩০ শতাংশ, বসুন্ধরা পেপারের ২৬৬ শতাংশ। রাষ্ট্রায়ত্ত বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান আইসিবিওর ক্ষতিও প্রায় ১০৩ শতাংশ বেড়েছে।
লোকসান কিছুটা কমেছে: ৭টি লোকসানি কোম্পানির ক্ষতি কিছুটা কমেছে। সাফকো স্পিনিং, জিকিউ বলপেন, অলিম্পিক অ্যাকসেসরিজ, বাংলাদেশ বিল্ডিং সিস্টেমস, সি পার্ল, ডেলটা স্পিনার্স ও পেনিনসুলা চিটাগংয়ের লোকসান কমলেও তারা এখনো নিট মুনাফায় ফেরেনি।
যাদের মুনাফা বেড়েছে: ৫১টি কোম্পানি গত বছরের তুলনায় বেশি মুনাফা করেছে। সবচেয়ে বড় লাফ দেখিয়েছে এভিন্স টেক্সটাইল, ইপিএস বেড়ে ১ পয়সা থেকে ১১ পয়সা, প্রবৃদ্ধি ১,০০০ শতাংশ। বারাকা পতেঙ্গা পাওয়ার লোকসান কাটিয়ে ৬৬ পয়সা মুনাফায় ফিরেছে, ৬০৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি। খুলনা পাওয়ারের ইপিএস বেড়েছে ৫২৫ শতাংশ, লিগ্যাসি ফুটওয়্যার ৫০০ শতাংশ, রহিম টেক্সটাইল ৪৮২ শতাংশ—সবাই আগের বছরের তুলনায় শক্ত উন্নতি দেখিয়েছে।
যাদের মুনাফা কমেছে: ৫৪টি কোম্পানির মুনাফা কমেছে। সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় আছে বিডি থাই ফুড। আগের বছর ৩ পয়সা লাভ করলেও এবার ৪৯ পয়সা লোকসান দেখিয়েছে; লোকসান বেড়েছে ১,৭৩৩ শতাংশ। ন্যাশনাল টিউবসের লোকসান বেড়েছে ৭৪১ শতাংশ। মেঘনা সিমেন্ট শতকরা হিসেবে তৃতীয় হলেও টাকার হিসেবে আঘাত সবচেয়ে বেশি। তাদের ইপিএস কমেছে ২৪ টাকা ৪৮ পয়সা। শেফার্ড ইন্ডাস্ট্রিজের মুনাফা কমেছে ৪৩৫ শতাংশ, ফারইস্ট নিটিং অ্যান্ড ডাইংয়ের ৩৩৯ শতাংশ। সব মিলিয়ে এসব কোম্পানির আয় গত বছরের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে নেমে গেছে।
আস্থা ফেরাতে যা জরুরি:
বাজার সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, বিনিয়োগকারীদের আস্থা পুনরুদ্ধারে কোম্পানিগুলোর আর্থিক স্বচ্ছতা বাড়ানো জরুরি। ট্রেজার সিকিউরিটিজের শীর্ষ কর্মকর্তা মোস্তফা মাহবুব উল্লাহ বলেন, খরচ নিয়ন্ত্রণে কাঠামোগত পরিবর্তন দরকার। মুদ্রার স্থিতিশীলতা ও সুদের হার কিছুটা কমালে ব্যবসার পরিবেশ ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে আসতে পারে।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভের গবেষণা ফেলো ও অর্থনীতিবিদ এম হেলাল আহমেদ জনি বলেন, “বর্তমান বাস্তবতায় ব্যবসা টিকিয়ে রাখাই বড় চ্যালেঞ্জ। উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি ও সুদের চাপ অব্যাহত থাকলে আগামী প্রান্তিকেও একই চিত্র দেখা দিতে পারে।”

