বাংলাদেশের শেয়ারবাজারে মিউচুয়াল ফান্ড খাত দীর্ঘ ও জটিল সংকটে আছে। বছরের পর বছর ইউনিট হোল্ডাররা প্রত্যাশিত রিটার্ন পাচ্ছেন না। এতে বিনিয়োগকারীদের আস্থা নষ্ট হয়েছে। পাশাপাশি খাতের মধ্যে অব্যবস্থাপনা, তহবিলের অনিয়ম ও নিয়ন্ত্রক সংস্থার দুর্বল তদারকিও প্রকাশ্যে এসেছে।
১৮৮০ সালে আইসিবি ফান্ডের মাধ্যমে দেশে মিউচুয়াল ফান্ড শিল্পের সূচনা হয়। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি আস্থা ও স্বচ্ছতার অভাবে এখন এই খাতের পুনরুদ্ধার একটি দীর্ঘ পথের অপেক্ষায় আছে। প্রতিবেশী দেশগুলোর বাজারে মিউচুয়াল ফান্ড দীর্ঘমেয়াদি সঞ্চয়কে সমর্থন করে কিন্তু বাংলাদেশের ইউনিট হোল্ডাররা ক্রমাগত লোকসান ও অনিশ্চয়তার মুখোমুখি। এ কারণে ভবিষ্যতে খাতটির পুনরুদ্ধার নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বছরের পর বছর দুর্বল রিটার্ন, নীতিগত ভুল, অনিয়ম ও জবাবদিহিতার অভাবে মিউচুয়াল ফান্ড এখনও একটি নিরাপদ বিনিয়োগের মাধ্যম হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি।
আইসিবির চেয়ারম্যান আবু আহমেদ বলেন, “বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে স্থিতিশীল ও দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের জন্য মিউচুয়াল ফান্ড কার্যকর একটি মাধ্যম। সাধারণ বিনিয়োগকারীদের জন্য এটি তুলনামূলকভাবে নিরাপদ। একক শেয়ারের ঝুঁকি এখানে কমে যায় নানা খাতে বিনিয়োগের মাধ্যমে। বর্তমান বাজার পরিস্থিতিতে যারা সরাসরি শেয়ার বাছাইয়ে অভিজ্ঞ নন, তাদের জন্য মিউচুয়াল ফান্ড একটি ভালো বিকল্প হতে পারে।”
বাংলাদেশের মিউচুয়াল ফান্ড খাত দীর্ঘমেয়াদি সংকটে রয়েছে। বছরের পর বছর ইউনিট হোল্ডাররা প্রত্যাশিত রিটার্ন পাচ্ছেন না। এতে বিনিয়োগকারীদের আস্থা কমে গেছে। পাশাপাশি খাতের মধ্যে অব্যবস্থাপনা, তহবিলের অনিয়ম এবং নিয়ন্ত্রক সংস্থার দুর্বল তদারকির প্রভাব স্পষ্ট।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মিউচুয়াল ফান্ড দীর্ঘমেয়াদে ধৈর্য ধরে বিনিয়োগ করলে ভালো রিটার্ন দিতে সক্ষম। তবে এর জন্য প্রয়োজন স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক ব্যবস্থাপনা, ফান্ড ম্যানেজারদের দক্ষতা ও পারফরম্যান্সের নিয়মিত মূল্যায়ন। এ ব্যবস্থা থাকলে খাতটি ভবিষ্যতে বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবে এবং সাধারণ বিনিয়োগকারীর আর্থিক সুরক্ষাও বাড়বে।
শেয়ারবাজার সংশ্লিষ্টরা জানান, বিনিয়োগকারীরা আর রিটার্ন আশা করছেন না। এর ফলে খাতটি বৃদ্ধি না পেয়ে ক্রমশ ডুবে যাচ্ছে। তারা অভিযোগ করেন, অ্যাসেট ম্যানেজাররা স্বার্থ রক্ষার জন্য নিয়ম লঙ্ঘন করছেন। কেউ কেউ তহবিল সরিয়ে অলাভজনক ফার্মে বিনিয়োগ করছেন। নিয়ন্ত্রক সংস্থা যথেষ্ট কঠোর না হওয়ায় এই অনিয়ম শিকড় গেঁড়েছে।
বর্তমানে মিউচুয়াল ফান্ড খাতে মোট সম্পদের পরিমাণ ১০ হাজার ১৮৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে ক্লোজড-এন্ড ফান্ডের অংশ ৪ হাজার ৮১০ কোটি টাকা এবং ওপেন-এন্ড ফান্ডের অংশ ৫ হাজার ৩৭৬ কোটি টাকা। শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত ৩৭টি ক্লোজড-এন্ড ফান্ডের মধ্যে ৩৫টি তাদের নিট সম্পদ মূল্যের (এনএভি) চেয়ে কম দামে লেনদেন হচ্ছে। ৩৩টি তাদের ফেস ভ্যালু বা অভিহিত মূল্যের চেয়ে কম দামে বিক্রি হচ্ছে। ২০২৪ থেকে ২০২৫ সালের মধ্যে প্রতিটি ক্লোজড-এন্ড ফান্ডের মূল্য ৩০ থেকে ১৫০ শতাংশ কমেছে। ১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ক্লোজড-এন্ড ফান্ডগুলোর বাজার মূলধন ২ হাজার ৩১২ কোটি টাকায় নেমে এসেছে। ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা পেশাগতভাবে পরিচালিত স্থিতিশীল রিটার্নের আশা করেছিলেন। কিন্তু তারা এখন এনএভি হ্রাস, দুর্বল ডিভিডেন্ড রেকর্ড এবং অনিয়মের মুখোমুখি। ইউনিট হোল্ডাররা লোকসান বহন করলেও অ্যাসেট ম্যানেজাররা ফি গ্রহণ চালিয়ে যাচ্ছেন।
বাংলাদেশের সম্পদ-ব্যবস্থাপনা থেকে জিডিপি অনুপাত মাত্র ০.১৭ শতাংশ। এটি ভারতের ১৬.২ শতাংশ, ভিয়েতনামের ৬.৩ শতাংশ এবং পাকিস্তানের ১.৭ শতাংশের তুলনায় অনেক কম। ইনভেস্টর অনুপ্রবেশের হার মাত্র ১ শতাংশ, যেখানে মালয়েশিয়ায় ৯ শতাংশ, থাইল্যান্ডে ৮ শতাংশ, ভিয়েতনামে ৬.৬ শতাংশ এবং ভারতে ২.১ শতাংশ।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এই বিশাল ব্যবধান দেখায় দেশীয় বিনিয়োগকারীদের মিউচুয়াল ফান্ডে আস্থা কতটা কম। পাশাপাশি পারিবারিক সঞ্চয়ে খাতের অবদানও সীমিত। বাজার বিশ্লেষকরা অভিযোগ করছেন, মিউচুয়াল ফান্ড শিল্পে অনিয়মের পাহাড় জমেছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থা তা প্রতিরোধে ব্যর্থ হয়েছে। তাদের মতে, খাতটি প্রায় ২৫ বছর পিছিয়ে গেছে। অতীতের অনিয়মের সমাধান না হলে বিনিয়োগকারীরা আস্থা ফিরে পাবেন না। কিছু অপারেটরের বিরুদ্ধে কমিশন তদন্ত শুরু করেছে, তবে ফলাফল জনসমক্ষে আনা উচিত। বিশেষজ্ঞরা আরও জানাচ্ছেন, সীমিত আর্থিক সাক্ষরতা, কঠোর বিনিয়োগের নিয়ম, মানসম্পন্ন তালিকাভুক্ত কোম্পানির অভাব এবং দুর্বল প্রচারের মতো কাঠামোগত দুর্বলতা সংকটকে আরও বাড়িয়েছে।
২০১৮ সালে ক্লোজড-এন্ড ফান্ডগুলোর ১০ বছরের মেয়াদ বাড়ানোর সিদ্ধান্তও বিনিয়োগকারীদের আস্থা ক্ষুণ্ন করেছে। অব্যবস্থাপনাও একটি বড় কারণ। অনেক অ্যাসেট ম্যানেজার অতিরিক্ত দামে দুর্বল বা অতালিকাভুক্ত ফার্মে বড় অঙ্কের অর্থ বিনিয়োগ করেছে। উদাহরণস্বরূপ, আরএসই অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট (যা ক্লোজড-এন্ড ফান্ডের ৪৮.০২% সম্পদ নিয়ন্ত্রণ করে) মাল্টি সিকিউরিটিজ অ্যান্ড সার্ভিসেস, পদ্মা ব্যাংক এবং রিজেন্ট স্পিনিং মিলসের বন্ডে বিনিয়োগ করেছে।
এলআর গ্লোবাল (১৬.২১% সম্পদ নিয়ন্ত্রণ) এনার্জিপ্যাক প্রিমা, ইউনিকর্ন ইন্ডাস্ট্রিজ এবং পদ্মা প্রিন্টার্সের শেয়ারে বিনিয়োগ করেছে। এই বিনিয়োগগুলো ইউনিট হোল্ডারদের জন্য কার্যকর রিটার্ন দিতে পারেনি, কিন্তু তদারকিতে থাকা ট্রাস্টিরা হস্তক্ষেপ করেননি। অক্টোবর মাসে বিএসইসি ছয়টি এলআর গ্লোবাল-পরিচালিত ফান্ডের লেনদেন স্থগিত করেছে। কারণ একটি অকার্যকর ওটিসি কোম্পানি পদ্মা প্রিন্টার্সের মাধ্যমে প্রায় ৬৯ কোটি টাকা অপব্যবহারের ঘটনা শনাক্ত হয়।
বিএসইসি ১৩ নভেম্বর নতুন ‘মিউচুয়াল ফান্ড রেগুলেশনস, ২০২৫’ চালু করেছে। নতুন বিধিমালায়:
- নতুন ক্লোজড-এন্ড ফান্ড নিষিদ্ধ করা হয়েছে
- বিদ্যমান ফান্ডের মেয়াদ বৃদ্ধি বন্ধ করা হয়েছে
- ফান্ড যদি প্রয়োজনীয় বাজার মূল্য বজায় রাখতে ব্যর্থ হয়, তা ওপেন-এন্ড ফান্ডে রূপান্তর বা অবসায়নের মুখোমুখি হবে
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই পদক্ষেপ বিনিয়োগকারীর আস্থা ফিরাতে সহায়ক হতে পারে। তবে বাস্তবতা হলো, দীর্ঘস্থায়ী বাজার অস্থিরতা, অব্যবস্থাপনা এবং নিয়ন্ত্রক তদারকির দুর্বলতার কারণে খাতটি এখনো বড় চ্যালেঞ্জের মুখে।

