ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়ায় পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে বড় ধরনের আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। সামনে জাতীয় নির্বাচন। সাধারণত নির্বাচনের আগে ও পরে বাজারে কিছুটা চাঙ্গাভাব দেখা যায়। কিন্তু এবার পরিস্থিতি আলাদা। আর্থিক খাতে লুটপাট ও অব্যবস্থাপনার ভয়াবহ চিত্র বিনিয়োগকারীদের আরও সতর্ক করে তুলেছে। ফলে পুঁজিবাজারের সূচক ও লেনদেন টানা কমছে।
বিদায়ী সপ্তাহে বাজারে বড় ধরনের পতন দেখা গেছে। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান সূচক ডিএসইএক্স কমেছে ১৪১ দশমিক ৫৭ পয়েন্ট, যা ২ দশমিক ৮২ শতাংশ। ইসলামী শরিয়াহভিত্তিক কোম্পানি নিয়ে গঠিত ডিএসই শরিয়াহ সূচক কমেছে ৩২ দশমিক শূন্য ৬ পয়েন্ট বা ৩ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ। আর ভালো মৌলভিত্তির কোম্পানি নিয়ে গঠিত ডিএসই–৩০ কমেছে ৪২ দশমিক ৪৮ পয়েন্ট বা ২ দশমিক ২০ শতাংশ।
ডিএসইতে গত সপ্তাহে লেনদেন হওয়া ৩৮৩টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে দাম বেড়েছে মাত্র ৪৫টির। কমেছে ৩২৫টির। ১৩টির দাম অপরিবর্তিত ছিল। অর্থাৎ ৮৪ দশমিক ৮৬ শতাংশ প্রতিষ্ঠানের শেয়ারদর কমেছে।
‘দুর্নীতি ও লুটের দায়ে বাজারে আস্থাহীনতা’
পুঁজিবাজার বিশেষজ্ঞ ও ডিএসইর সাবেক সভাপতি শাকিল রিজভী বলেন, আগের সরকারের সময়ে ব্যাপক দুর্নীতি ও ব্যাংক লুটের কারণে পাঁচ ব্যাংক ও নয়টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। এর সরাসরি প্রভাব পড়েছে পুঁজিবাজারে। এতে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে বড় ধরনের প্যানিক তৈরি হয়েছে। ফলে তারা এখন অত্যন্ত সতর্ক। সামনে জাতীয় নির্বাচন থাকায় বিনিয়োগকারীরা আরও সাবধানে সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। ব্যাংকের সুদহার অপরিবর্তিত থাকা সত্ত্বেও তাই বাজারে গতিশীলতা ফিরছে না।
লোকসানি ও বন্ধ কোম্পানির শেয়ারে অস্বাভাবিক উত্থান
মজার বিষয় হলো, বাজারের এই টালমাটাল অবস্থায় উল্টো দুর্বল এবং লোকসানি কোম্পানির শেয়ারদর হুহু করে বাড়ছে।
বিদায়ী সপ্তাহে ডিএসইতে দাম বাড়ার তালিকায় শীর্ষে ছিল জিলবাংলা সুগার মিল। কোম্পানিটির শেয়ারদর বেড়েছে ৬০ দশমিক ৩২ শতাংশ। ডিএসইর অনুসন্ধান চিঠির জবাবে প্রতিষ্ঠানটি জানায়, শেয়ারদর বাড়ার পেছনে কোনো মূল্য সংবেদনশীল তথ্য নেই।
কিন্তু আর্থিক প্রতিবেদন বলছে অন্য কথা। ২০২৫–২৬ হিসাব বছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই–সেপ্টেম্বর) কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি লোকসান হয়েছে ২৭ টাকা ৯১ পয়সা। আগের বছরের একই সময়ে লোকসান ছিল ১৯ টাকা ৯৫ পয়সা। ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৫ শেষে শেয়ারপ্রতি নিট দায় দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ১৬৭ টাকা ১০ পয়সা। ২০২৪–২৫ অর্থবছরে কোম্পানিটি কোনো লভ্যাংশ দেয়নি। ওই বছর শেয়ারপ্রতি লোকসান হয়েছে ৭৮ টাকা ৮৭ পয়সা। আগের বছর ছিল ৭৪ টাকা ৩৯ পয়সা। ৩০ জুন ২০২৫ শেষে শেয়ারপ্রতি নিট দায় দাঁড়ায় ১ হাজার ১৩৯ টাকা ১৯ পয়সায়।
এমনকি বিডি থাইফুডের শেয়ারদরও অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে। অথচ কোম্পানিটি বন্ধ রয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রও বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের মালিকানাধীন এই কোম্পানি উৎপাদন বন্ধ রেখেও শেয়ারদর বাড়িয়ে চলেছে।
ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশের (আইসিবি) এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, বাজারে আস্থাহীনতা চরমে। বিনিয়োগকারীরা এখন ভয় আর অনিশ্চয়তার মধ্যে আছেন।
দর বাড়ার তালিকায় দুর্বল কোম্পানির আধিপত্য
বিদায়ী সপ্তাহে শীর্ষ দশ দাম বাড়ার তালিকার মধ্যে পাঁচটিই জেড ক্যাটাগরির বা দুর্বল মৌলভিত্তির কোম্পানি।
দ্বিতীয় স্থানে থাকা বিডি থাই ফুড অ্যান্ড বেভারেজ লিমিটেডের শেয়ারদর সপ্তাহের শুরুতে ছিল ১০ দশমিক ৬০ টাকা। সপ্তাহের শেষে তা দাঁড়ায় ১৬ দশমিক ৭০ টাকায়। অর্থাৎ দর বেড়েছে ৫৭ দশমিক ৫৫ শতাংশ। অথচ প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ রয়েছে।
তৃতীয় স্থানে আছে বিডি থাই অ্যালুমিনিয়াম লিমিটেড। এ ছাড়া স্ট্যান্ডার্ড সিরামিকস ইন্ডাস্ট্রিজ বেড়েছে ১৭ দশমিক ৬৬ শতাংশ, কেটিএল ১৭ দশমিক ৩১ শতাংশ, কেপিপিএল ১৩ দশমিক ৪১ শতাংশ, বিডি ওয়েল্ডিং ১২ দশমিক ৫০ শতাংশ, শেপার্ড ইন্ডাস্ট্রিজ ১২ দশমিক ১৭ শতাংশ, ডিবিএইচ আইএসটি মিউচুয়াল ফান্ড ১০ দশমিক ৭১ শতাংশ এবং তাল্লু স্পিনিং ৯ দশমিক ৮০ শতাংশ।
সপ্তাহে বাজারমূলধন কমেছে ৭৩৭১ কোটি টাকা
দরপতন হওয়ায় বিদায়ী সপ্তাহের শেষে ডিএসইর বাজারমূলধন দাঁড়িয়েছে ৬ লাখ ৮৪ হাজার ৭৬২ কোটি টাকা। আগের সপ্তাহে ছিল ৬ লাখ ৯২ হাজার ১৩৩ কোটি টাকা। অর্থাৎ সপ্তাহে মোট বাজারমূলধন কমেছে ৭ হাজার ৩৭১ কোটি টাকা বা ১ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ।

