এক সময় শেয়ারবাজার ছিল দ্রুত মুনাফার স্বপ্ন দেখার জায়গা। অনেকেই ভেবেছিলেন, এখানে বিনিয়োগ করেই বদলে যাবে ভাগ্য। কিন্তু বাস্তবতা আজ সম্পূর্ণ উল্টো। বছরের পর বছর ধরে শেয়ারবাজার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন বিনিয়োগকারীরা। নতুন কেউ আসছেন না বললেই চলে, আর পুরোনোদের বড় অংশ একে একে বাজার ছেড়ে দিচ্ছেন।
পরিসংখ্যান বলছে, গত দুই দশকে যাঁরা শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করতে এসে বিও অ্যাকাউন্ট খুলেছিলেন, তাঁদের বেশির ভাগই ইতিমধ্যে সেই অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দিয়েছেন। মাঝখানে ২০১৫ সাল পর্যন্ত সক্রিয় বিও অ্যাকাউন্ট কিছুটা বাড়লেও গত প্রায় এক দশক ধরে সেই সংখ্যাও ধারাবাহিকভাবে কমছে।
বিনিয়োগকারী কমছে কতটা?
দেশের শেয়ারধারণ ও বিও অ্যাকাউন্ট ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকা সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি বাংলাদেশ লিমিটেডের (সিডিবিএল) সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে সক্রিয় বিও অ্যাকাউন্টের সংখ্যা ১৬ লাখ ৩৮ হাজারের মতো। এর মধ্যে ব্যক্তি বিনিয়োগকারীর অ্যাকাউন্ট প্রায় ১৬ লাখ ২০ হাজার—যা এক বছর আগের তুলনায় প্রায় ৪৩ হাজার কম।
শুধু ব্যক্তি বিনিয়োগকারী নয়, কমছে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীর সংখ্যাও। এক বছর আগে যেখানে প্রাতিষ্ঠানিক বিও অ্যাকাউন্ট ছিল প্রায় ১৫ হাজার ৮৪০টি, এখন তা নেমে এসেছে ১৫ হাজার ৫২৬-এ।
অথচ ২০১৬ সালের জুনে শেয়ারবাজারে সক্রিয় বিও অ্যাকাউন্টের সংখ্যা একসময় ৩২ লাখ ছাড়িয়ে গিয়েছিল। সেই সময়ের পর থেকে দরপতন, আস্থাহীনতা আর ধারাবাহিক হতাশায় বিনিয়োগকারীরা ধীরে ধীরে বাজার ছাড়তে শুরু করেন। ব্রোকারেজ হাউসগুলোর কর্মকর্তাদের ভাষায়, সেই স্রোত এখনো থামেনি।
বিও অ্যাকাউন্ট মানেই কি বিনিয়োগকারী?
সংখ্যা দিয়ে বিনিয়োগকারীর প্রকৃত চিত্র বোঝা কঠিন। কারণ একজনের একাধিক বিও অ্যাকাউন্ট থাকতে পারে, আবার যৌথ নামেও অনেক অ্যাকাউন্ট খোলা হয়।
সিডিবিএলের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৩ সালে ইলেকট্রনিক বিও অ্যাকাউন্ট ব্যবস্থা চালুর পর এখন পর্যন্ত ৮০ লাখের বেশি অ্যাকাউন্ট খোলা হয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ৮০ শতাংশই বন্ধ হয়ে গেছে।
বর্তমানে যেসব বিও অ্যাকাউন্টকে ‘সক্রিয়’ বলা হচ্ছে, সেগুলোর সবকটিতে আবার শেয়ারও নেই। প্রায় সাড়ে তিন লাখ অ্যাকাউন্টে কোনো শেয়ার নেই, আর খোলার পর কখনো ব্যবহারই হয়নি—এমন অ্যাকাউন্টের সংখ্যাও কয়েক দশক হাজার।
ব্রোকারেজ হাউসগুলোর হিসাব অনুযায়ী, কাগজে-কলমে ১২–১৬ লাখ সক্রিয় বিও অ্যাকাউন্ট থাকলেও প্রকৃত অর্থে নিয়মিত বিনিয়োগকারী চার থেকে পাঁচ লাখের বেশি নন।
কারা সবচেয়ে বেশি ঝরে পড়ছেন?
বাজারে থাকা বিনিয়োগের অঙ্ক বিশ্লেষণ করলে আরও স্পষ্ট হয় চিত্রটি। অধিকাংশ বিও অ্যাকাউন্টেই বিনিয়োগের পরিমাণ এক লাখ টাকার নিচে। ধাপে ধাপে বিনিয়োগের অঙ্ক যত বাড়ে, অ্যাকাউন্টের সংখ্যা তত কমে।
বড় অঙ্কের বিনিয়োগ মূলত উদ্যোক্তা, পরিচালক, প্রাতিষ্ঠানিক বা বিদেশি বিনিয়োগকারীদের হাতেই সীমাবদ্ধ। অর্থাৎ বাজার থেকে সবচেয়ে বেশি হারিয়ে যাচ্ছেন ক্ষুদ্র ও মাঝারি বিনিয়োগকারীরা—যাঁরা শেয়ারবাজারে এসেছিলেন দ্রুত মুনাফার আশায়, কিন্তু শেষ পর্যন্ত পুঁজি হারিয়ে ফিরেছেন।
মানুষ যাচ্ছে কোথায়?
শেয়ারবাজারে আস্থা কমার সঙ্গে সঙ্গে মানুষ ঝুঁকছে নিরাপদ বিনিয়োগের দিকে। ব্যাংকের স্থায়ী ও মেয়াদি আমানত, সরকারি সঞ্চয়পত্র আর জীবন বীমাই এখন সাধারণ মানুষের প্রথম পছন্দ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ব্যাংক খাতে আমানতের পরিমাণ এখন ২০ লাখ কোটি টাকারও বেশি। শুধু ফিক্সড ডিপোজিট ও ডিপিএসেই কোটি কোটি মানুষ টাকা রাখছেন।
জাতীয় সঞ্চয়পত্রেও বিনিয়োগকারীর সংখ্যা বিপুল। প্রায় অর্ধকোটি মানুষের সঞ্চয় সেখানে আটকে আছে। সুদের হার কমানো হলেও মানুষ এখান থেকেই মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে না।
আবার যাঁদের বড় অঙ্কের সঞ্চয় নেই, তাঁদের অনেকেই জীবন বীমাকে ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার ভরসা হিসেবে বেছে নিচ্ছেন।
শেয়ারবাজারে আগ্রহ নেই কেন?
শেয়ারবাজার সংশ্লিষ্টদের মতে, মূল সমস্যা আস্থার। বহু বিনিয়োগকারী কারসাজির শিকার হয়েছেন, কেউ কেউ আবার ব্রোকারেজ হাউসের অনিয়মে নিজের টাকা ও শেয়ার হারিয়েছেন। এসব অভিজ্ঞতা সাধারণ মানুষের মনে গভীর ভয় তৈরি করেছে।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের পরিচালক মিনহাজ মান্নান ইমনের ভাষায়, মানুষ বিনিয়োগ করে লাভের আশায়। যেখানে লাভের নিশ্চয়তা নেই, বরং পুঁজি হারানোর ভয় বেশি—সেখানে কেউ যেতে চায় না।
তিনি বলেন, শেয়ারবাজারে সংস্কারের কথা বলা হলেও সাধারণ বিনিয়োগকারীরা এখনো সেই পরিবর্তনের সুফল নিজেদের জীবনে দেখতে পাচ্ছেন না। ফলে হতাশা আরও বেড়েছে।
নিয়ন্ত্রক সংস্থা কী বলছে?
বিএসইসির কর্মকর্তারা স্বীকার করছেন—ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী কমছে। তবে তাঁদের দাবি, বাজারে সুশাসন ফেরাতে আইনি সংস্কার চলছে। এর ফল পেতে সময় লাগবে।
নতুন করে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী আনতে আইপিওতে আবার লটারি পদ্ধতি চালুর ভাবনা আছে। পাশাপাশি ব্রোকারেজ হাউসের ওপর নজরদারি বাড়ানো হয়েছে, কারসাজি ঠেকাতে নতুন ব্যবস্থাও আসছে।
নিয়ন্ত্রকদের আশা, এসব উদ্যোগ ধীরে ধীরে আস্থা ফিরিয়ে আনবে। তবে বাস্তবতা হলো—শেয়ারবাজারে ফিরে আসতে সাধারণ মানুষ এখনো প্রস্তুত নন।

