দেশের পুঁজিবাজার কয়েক মাস ধরে মন্দার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। বিনিয়োগকারীরা বড় ধরনের লোকসান ভোগ করছেন। বছরের অধিকাংশ সময় পুঁজিবাজারে মন্দা থাকায় অনেক প্রতিষ্ঠানের শেয়ার মূল্যও অবমূল্যায়িত অবস্থায় রয়েছে। এমন অবস্থার মধ্যে ঝুঁকিতে পড়েছে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের কিছু কোম্পানি। বিশেষত খুলনা পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড, জিবিবি পাওয়ার লিমিটেড এবং বারাকা পাওয়ার লিমিটেড।
নিরীক্ষকরা এই তিনটি কোম্পানির ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি (পিপিএ) মেয়াদ শেষ হওয়া, কেন্দ্র বন্ধ থাকা, আয় না থাকা এবং আর্থিক অনিশ্চয়তার কারণে কোম্পানিগুলো টিকে থাকার সক্ষমতা প্রশ্নের মুখে পড়েছে।
খুলনা পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড:
পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত খুলনা পাওয়ারের দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের সঙ্গে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) পিপিএ ২০২৪ সালের মার্চে শেষ হয়েছে। এরপর সরকার চুক্তি নবায়ন করেনি। এসএফ আহমেদ অ্যান্ড কোং চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস কোম্পানিটির ২০২৪-২৫ অর্থবছরের আর্থিক প্রতিবেদনের নিরীক্ষায় এই অবস্থাকে কোম্পানির ভবিষ্যতের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে উল্লেখ করেছে। নিরীক্ষকের মতে, ইউনিট-২ ও ইউনিট-৩-এর পিপিএ ২০২৪ সালের ২৩ মার্চ শেষ হয়। পরে ২৯ এপ্রিল ‘নো ইলেকট্রিসিটি নো পেমেন্ট’ ভিত্তিতে দুই বছরের জন্য একটি চুক্তি হলেও দেড় বছরের বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও সরকার কোম্পানি থেকে বিদ্যুৎ কিনছে না। ফলে ভবিষ্যতে সরকার কোম্পানি থেকে বিদ্যুৎ কিনবে কি না, তা অনিশ্চিত।
জিবিবি পাওয়ার লিমিটেড:
জিবিবি পাওয়ার লিমিটেডের বিদ্যুৎকেন্দ্র দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার কারণে কোম্পানির টিকে থাকা নিয়েও শঙ্কা আছে। ২০২৩ সালের জুনে কোম্পানির বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি শেষ হয়েছে এবং পুনর্নবায়ন করা হয়নি। গত দুই অর্থবছর ধরে কোম্পানির মূল ব্যবসা থেকে কোনো আয় হয়নি। সমাপ্ত ২০২৪-২৫ অর্থবছরে কোম্পানি কোনো লভ্যাংশ ঘোষণা করেনি। শেয়ারপ্রতি মুনাফা (ইপিএস) ১১ পয়সা হয়েছে, যেখানে আগের বছরে শেয়ারপ্রতি ৩৫ পয়সা লোকসান হয়েছিল। ৩০ জুন শেষে শেয়ারপ্রতি নিট সম্পদমূল্য (এনএভিপিএস) ২০ টাকা ৩১ পয়সা। ডিএসইতে সর্বশেষ লেনদেন হয়েছে ৬ টাকা ৪০ পয়সায়।
বারাকা পাওয়ার লিমিটেড:
বারাকা পাওয়ার লিমিটেডও ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের নিরীক্ষায় দেখা যায়, কোম্পানি সহযোগী প্রতিষ্ঠানে জামানত ছাড়াই ১৫৫ কোটি ৩২ লাখ ৮ হাজার ৯৯৭ টাকা ঋণ দিয়েছে। নথিপত্র দুর্বল হওয়ায় ঋণ ফেরতের অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে, যা নতুন বিনিয়োগকে সীমিত করছে।
সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জে ৫১ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রটি ২০২৪ সালের ২৩ অক্টোবর থেকে বন্ধ। আরও পাঁচ বছরের জন্য পিপিএ নবায়নের আবেদন করা হয়েছে, তবে অনুমোদন এখনও মেলেনি। তাই কেন্দ্র থেকে কোনো নিজস্ব আয় নেই। সহযোগী প্রতিষ্ঠান বারাকা ফ্যাশন লিমিটেডও লোকসানে রয়েছে, ৩০ জুন ২০২৫ পর্যন্ত পুঞ্জীভূত লোকসান ৬৮ কোটি ৯১ লাখ টাকায় দাঁড়িয়েছে। সমাপ্ত ২০২৪-২৫ অর্থবছরে কোম্পানি কোনো লভ্যাংশ ঘোষণা করেনি। শেয়ারপ্রতি আয় ৩৬ পয়সা, আগের বছর ছিল ১ টাকা ১২ পয়সা। ২০২৫-২৬ হিসাব বছরের প্রথম প্রান্তিকে শেয়ারপ্রতি আয় বেড়ে ১৮ পয়সা হয়েছে।
কোম্পানি সচিব মো. সাইফুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধের সাময়িক প্রভাব মোকাবিলায় কোম্পানি আগে থেকেই কৌশলগত প্রস্তুতি নিয়েছে। ব্যবসা সম্প্রসারণ ও আয় বহুমুখীকরণের জন্য নতুন প্রকল্প অনুসন্ধান, বিদ্যমান সম্পদের দক্ষ ব্যবহার ও বিকল্প বিনিয়োগের দিকে জোর দেওয়া হচ্ছে। ব্যবস্থাপনা পর্ষদ কোম্পানির দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতা এবং শেয়ারহোল্ডারদের স্বার্থ রক্ষায় পদক্ষেপ নিচ্ছে।
নিরীক্ষকের পর্যবেক্ষণ:
বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি নবায়নের অনিশ্চয়তা, কেন্দ্র বন্ধ থাকা ও আয় সংকটের কারণে এই তিনটি জ্বালানি খাতের কোম্পানির ভবিষ্যৎ ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। পুঁজিবাজারে দীর্ঘদিন ধরে পুঁজির সংকট এবং বিনিয়োগকারীদের আস্থার ঘাটতি দেখা দিয়েছে। অনেক পুরোনো তালিকাভুক্ত কোম্পানির প্রতি বিনিয়োগকারীরা আগ্রহ হারিয়েছেন। নভেম্বর মাসে ১৮টি কোম্পানি প্রথম প্রান্তিকের (জুলাই-সেপ্টেম্বর’২৫) অনিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এর মধ্যে ৫টি কোম্পানি আলোচ্য সময়ে আয় বাড়াতে ব্যর্থ হয়েছে, বাকি ১৩টি আয় বাড়াতে সক্ষম হয়েছে।
আয় বাড়াতে ব্যর্থ হওয়া কোম্পানিগুলো হলো- এনার্জিপ্যাক পাওয়ার জেনারেশন, জিবিবি পাওয়ার, এমজেএল বিডি, পাওয়ার গ্রিড, তিতাস গ্যাস ও ইউনাইটেড পাওয়ার জেনারেশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন। জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পর্যাপ্ত জ্বালানির মজুদ না থাকলে দেশ বড় ঝুঁকিতে পড়বে। এতে অর্থনীতিতে বড় ধরনের ছন্দপতনের আশঙ্কা রয়েছে।

