কৃষ্ণগহ্বর—এই রহস্যময় মহাজাগতিক দানবগুলো আমাদের কল্পনারও বাইরে শক্তিশালী। এরা এতটাই ভয়ঙ্কর যে, আলো পর্যন্ত এদের গ্রাস থেকে পালাতে পারে না। তবে এবার বিজ্ঞানীরা যা আবিষ্কার করেছেন, তা পূর্বের সব ধারণাকেও ছাড়িয়ে গেছে।
২০২৩ সালের নভেম্বরে রেকর্ডকৃত কৃষ্ণগহ্বরের সংঘর্ষকে বিজ্ঞানীরা ইতিহাসের সবচেয়ে বড়ো ব্ল্যাক হোল মার্জার হিসেবে ঘোষণা করেছেন। এ তথ্য সম্প্রতি যুক্তরাজ্যের গ্লাসগো শহরে অনুষ্ঠিতআন্তর্জাতিক সাধারণ আপেক্ষিকতা ও মহাকর্ষ সম্মেলনে প্রকাশ করা হয়।
কৃষ্ণগহ্বর আসলে কী?
সহজভাবে বললে, কৃষ্ণগহ্বর হচ্ছে মহাকাশের এমন অঞ্চল যেখানে বিপুল ভর ঠাসা অবস্থায় গাদাগাদি করে থাকে। এই ভরের টানে এমন এক মহাকর্ষ তৈরি হয়, যেখান থেকে আলোও বের হতে পারে না। তাই এদের দেখা যায় না—শুধুই টের পাওয়া যায় এদের প্রভাব থেকে।
সাধারণত বিশাল কোনো নক্ষত্র জীবন শেষ করে ভেঙে পড়লে (স্টার কলাপ্স হলে) কৃষ্ণগহ্বর জন্ম নেয়। কিন্তু সব ব্ল্যাক হোলের জন্মকথা এতটা সহজ নয়—এবারের আবিষ্কার সেটাই প্রমাণ করছে।

কখন ও কীভাবে ধরা পড়ে এই মহাজাগতিক সংঘর্ষ?
২০২৩ সালের ২৩ নভেম্বর দুপুর ১টার কিছু আগে, আমেরিকার ওয়াশিংটন ও লুইজিয়ানায় অবস্থিত দুটি ডিটেক্টর একসাথে হঠাৎ মহাকাশে সৃষ্ট ক্ষণিকের এক তরঙ্গ ধরে ফেলে।
এই তরঙ্গ আসলে ছিল গ্র্যাভিটেশনাল ওয়েভ—মহাকাশ-সময়ের এক অদ্ভুত ঢেউ, যা তৈরি হয়েছিল দুই কৃষ্ণগহ্বরের প্রচণ্ড সংঘর্ষ থেকে। এর নাম দেওয়া হয় GW231123।
এটি ধরা পড়ে লিগো (LIGO) নামের পর্যবেক্ষণাগারের সাহায্যে, যা আমেরিকার ন্যাশনাল সায়েন্স ফাউন্ডেশনের অর্থায়নে ক্যালটেক ও এমআইটি’র বিজ্ঞানীরা নির্মাণ করেছিলেন। লিগো আসলে বিশাল লেজার ইন্টারফেরোমিটার, যা মহাকর্ষীয় তরঙ্গের মতো সূক্ষ্ম কাঁপন শনাক্ত করতে পারে। একই ধরনের যন্ত্র ইউরোপের ভিরগো ও জাপানের কাগ্রা থেকেও পরিচালিত হয়।
কী ঘটেছিল সেই সংঘর্ষে?
দুটি কৃষ্ণগহ্বরের ভর ছিল যথাক্রমে সূর্যের চেয়ে প্রায় ১০০ ও ১৪০ গুণ বেশি। সংঘর্ষের পর তারা মিলে তৈরি করে নতুন এক দৈত্যাকার কৃষ্ণগহ্বর—যার ভর সূর্যের ২৬৫ গুণেরও বেশি!
এর আগে ২০১৯ সালে ধরা পড়া GW190521 ছিল সবচেয়ে বড়ো সংঘর্ষ, যেখানে নতুন কৃষ্ণগহ্বরের ভর দাঁড়িয়েছিল প্রায় ১৪০ সূর্যমাস। তুলনায় এবারেরটি প্রায় দ্বিগুণ।
বিজ্ঞানীরা কী শিখলেন এই ঘটনা থেকে?
কার্ডিফ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং লিগো বৈজ্ঞানিক দলের সদস্য মার্ক হ্যানাম বলেন—
“এটি আমাদের আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে দিয়েছে যে, কৃষ্ণগহ্বর বারবার সংঘর্ষ ও একীভূত হয়ে ধাপে ধাপে অনেক বড় আকার ধারণ করতে পারে।”
তার মতে, এত বিশাল কৃষ্ণগহ্বর সরাসরি কোনো নক্ষত্র ভেঙে তৈরি হওয়া সম্ভব নয়। বরং একের পর এক মার্জারের মাধ্যমেই এরা জন্ম নেয় বলে এখন মনে করা হচ্ছে।
পৃথিবীর ওপর কোনো প্রভাব পড়বে?
না। এই সংঘর্ষ আমাদের গ্যালাক্সি নয়, অনেক দূরে ঘটেছিল। অনুমান করা হচ্ছে ঘটনাটি ঘটেছে কয়েক মিলিয়ন থেকে ১০ বিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরে। অর্থাৎ, যে তরঙ্গ আমরা আজ শনাক্ত করছি, সেটি আসলে কয়েক মিলিয়ন বছর আগে সংঘটিত ঘটনার প্রতিধ্বনি।
এক আলোকবর্ষ মানে হলো আলো এক বছরে যতটা পথ অতিক্রম করে, আর সেই গতিতেই চলে গ্র্যাভিটেশনাল ওয়েভ। ফলে দূরত্ব বোঝাতে বিজ্ঞানীরা বলেন—এটি প্রায় ৩ গিগাপারসেক দূরে। (এক পারসেক প্রায় ৩১ ট্রিলিয়ন কিলোমিটার!)
এই আবিষ্কার মহাবিশ্বের রহস্য উন্মোচনে নতুন জানালা খুলে দিল। কৃষ্ণগহ্বরের জন্ম, বৃদ্ধি ও বিবর্তন নিয়ে বিজ্ঞানীদের ধারণা এখন আরও জটিল কিন্তু রোমাঞ্চকর হয়ে উঠছে।