যুক্তরাষ্ট্র আবারও চাঁদে মহাকাশচারী পাঠানোর স্বপ্ন দেখছে। এই উদ্যোগ নিয়ে রাজনৈতিক নেতা থেকে বিজ্ঞানী সবাই উৎসাহিত। তবে এই স্বপ্নের পেছনে এমন এক জটিলতা লুকিয়ে আছে, যা নাসার জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
মহাকাশযান স্টারশিপ—নাসার সবচেয়ে বড় বাজি
চাঁদে ফেরার এই যাত্রার মূল ভরসা হলো স্টারশিপ—মানব ইতিহাসের সবচেয়ে বড় রকেট। তবে প্রশ্ন হচ্ছে, এটি কি সত্যিই কাজ করবে? এখন পর্যন্ত দশটি পরীক্ষামূলক উড়ানের মধ্যে ছয়টি ব্যর্থ হয়েছে, এবং সর্বশেষ একটি মহাকাশযান মাটিতে বিস্ফোরিত হয়েছে।
স্টারশিপের পরবর্তী পরীক্ষা চলতি সপ্তাহেই টেক্সাসে হওয়ার কথা। তবুও, মহাকাশযানটি এখনো অনেক গুরুত্বপূর্ণ ধাপ অতিক্রম করতে পারেনি, বিশেষ করে মহাকাশে জ্বালানি পুনঃভরার প্রযুক্তি, যা আগে কখনও কোনো মহাকাশযানে প্রয়োগ করা হয়নি।
এই জ্বালানি পুনঃভরার প্রক্রিয়ায় সবচেয়ে বড় অস্পষ্টতা রয়েছে। নাসা এবং স্পেসযান প্রকৌশলীরা জ্বালানি সরবরাহের সংখ্যা নিয়ে একমত নন। কিছু অনুমান আছে, একটি চাঁদ অভিযানের জন্য ১০ থেকে ৪০টির বেশি জ্বালানি পরিবহনকারী মহাকাশযান লাগতে পারে। এই অনিশ্চয়তা বিজ্ঞানীদের মধ্যে উদ্বেগ বাড়াচ্ছে।
স্পেসএক্সের স্টারশিপ মহাকাশযানকে ১১ অক্টোবর লঞ্চ টাওয়ারে উত্তোলন করা হচ্ছে, যাতে এটি সুপার হেভি বুস্টারের উপর স্থাপন করা যায়। এটি টেক্সাসের স্টারবেসে কোম্পানির কমপ্লেক্স থেকে ১১তম পরীক্ষামূলক উড্ডয়নের প্রস্তুতির অংশ
“এই পরিকল্পনা অস্বাভাবিকভাবে জটিল”—সাবেক প্রশাসকের সতর্কবার্তা
নাসার সাবেক প্রশাসক জিম ব্রাইডেনস্টাইন বলেছেন,
“এমন পরিকল্পনা কোনো নাসা প্রশাসক বেছে নিতেন না যদি বিকল্প থাকত।”
অন্যদিকে বর্তমান দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রশাসক শন ডাফি বলেছেন,
“আমরা হার মানব না। চীনের আগে আমরা চাঁদে পৌঁছাব।”
কেন নাসা আগের অ্যাপোলো মিশনের পথ পুনরাবৃত্তি করছে না
অনেকে প্রশ্ন করছেন—অ্যাপোলো যুগের মতো সহজ পথে না গিয়ে নাসা এত জটিল পথ নিচ্ছে কেন?
উত্তর হলো—সময় পরিবর্তিত হয়েছে। আগের যুগের সরবরাহ চেইন, নির্মাণ প্রযুক্তি আর যন্ত্রপাতি এখন আর নেই।
তাছাড়া, এবার শুধু পতাকা পুঁতে ফেরা নয়, চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে স্থায়ী মানব ঘাঁটি গড়ে তোলা লক্ষ্য। সেখানে বরফে মিশে থাকা পানি ও অন্যান্য সম্পদ ব্যবহার করে দীর্ঘমেয়াদী গবেষণা করা হবে। নাসার প্রাক্তন প্রশাসক বিল নেলসন বলেন,
“দক্ষিণ মেরুতে নামতে বড় আকারের ল্যান্ডার দরকার। অ্যাপোলো যুগের ছোট যান দিয়ে তা সম্ভব নয়।”
অ্যাপোলো ১১-এর স্যাটার্ন V রকেটটি ১৬ জুলাই ১৯৬৯ সালে ফ্লোরিডার নাসার কেনেডি স্পেস সেন্টার থেকে নভোচারী নীল আর্মস্ট্রং, মাইকেল কলিন্স এবং বাজ আলড্রিনকে নিয়ে উড্ডয়ন করে।— নাসা
আর্টেমিস–III: এক জটিল চাঁদ অভিযানের ধাপ
নাসার আর্টেমিস–III মিশন হবে চাঁদে ফেরার সেই ঐতিহাসিক পদক্ষেপ। তবে এর ধাপগুলো খুবই জটিল।
প্রথমে একটি ফাঁকা মহাকাশযান পাঠানো হবে, যা হবে “জ্বালানি ডিপো”।
পরবর্তীতে অনেকগুলো মহাকাশযান শুধু জ্বালানি বহন করে সেই ডিপোতে ভরবে।
ডিপো পূর্ণ হলে, মহাকাশচারীদের বহনকারী মহাকাশযান পাঠানো হবে।
অন্যদিকে নাসার নিজস্ব রকেট Orion ক্যাপসুল বহন করবে, যেখানে থাকবেন মহাকাশচারীরা
চাঁদের কক্ষপথে গিয়ে Orion মহাকাশযান, ল্যান্ডারের সঙ্গে যুক্ত হবে, এবং দুই মহাকাশচারী নামবেন চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে।
এক সপ্তাহ পর তারা আবার ল্যান্ডারে উঠবে, Orion-এ যোগ দেবে এবং পৃথিবীতে ফিরে আসবে।
সব ঠিকঠাক চললে ২০২৭ সালের মাঝামাঝি এই মিশন সম্পন্ন হবে, চীনের নির্ধারিত ২০৩০ সালের আগে।
স্পেসএক্সের স্টারশিপ প্রোটোটাইপটি ৬ জুন, ২০২৪ সালে টেক্সাসের স্টারবেস থেকে রকেট সিস্টেমের চতুর্থ সমন্বিত পরীক্ষামূলক উড্ডয়নের জন্য বোকার চিকা বিচ থেকে উৎক্ষেপণ করা হচ্ছে।
স্টারশিপ কি ভুল সিদ্ধান্ত ছিল?
অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করছেন, নাসা হয়তো স্টারশিপ বেছে নিয়ে ভুল করেছে। কারণ এই যানটি এখনও পরীক্ষামূলক পর্যায়ে এবং নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে সফল হওয়া সম্ভব নয়।
স্টারশিপকে বেছে নেওয়ার পেছনে বড় কারণ হলো এর ভবিষ্যতের সম্ভাবনা। কিন্তু বাস্তব সময়সীমার মধ্যে চাঁদে পৌঁছানোর জন্য এটি কতটা কার্যকর হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।
প্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিষ্ঠান ব্লু অরিজিন আদালতে অভিযোগ করেছিল যে নাসা পক্ষপাত দেখিয়েছে। তবে আদালত নাসার পক্ষে রায় দিয়েছে।
ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ
নাসার উপদেষ্টা কমিটি জানিয়েছে—স্টারশিপ প্রকল্প সময়ের পেছনে, এবং ২০২৭ সালের ডেডলাইনে পৌঁছানো “অত্যন্ত কঠিন”।
তবুও আশার আলো আছে। কারণ স্পেসযান বারবার এমন কাজ করেছে যা প্রথমে অসম্ভব মনে হয়েছিল। কমিটির একজন সদস্য বলেছেন,
“তাদের কাজের পদ্ধতি অনন্য। অন্য কোনো সরকার বা প্রতিষ্ঠান এই ক্ষমতা রাখে না।”
নাসা এখন এক দ্বিধার মোড়ে দাঁড়িয়ে। একদিকে সময়ের চাপ—চীনের আগে চাঁদে পৌঁছাতে হবে। অন্যদিকে প্রযুক্তিগত অনিশ্চয়তা—স্টারশিপের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা বিপদ ডেকে আনতে পারে।
যেভাবে এক বিশেষজ্ঞ বলেছিলেন,
“আমরা এখনো প্রথম ধাপে আছি—যেখানে বুঝতে শুরু করেছি সামনে বড় সমস্যা অপেক্ষা করছে।”
তবুও মানবসভ্যতার ইতিহাসে একটাই সত্য—অসম্ভবের সীমা ঠেলে দেওয়া মানুষ থেমে থাকে না। হয়তো এই সাহসই একদিন আমেরিকাকে আবার চাঁদে পাঠাবে।