বেসরকারি খাতের সাবমেরিন কেবল প্রকল্প ‘বাংলাদেশ প্রাইভেট কেবল সিস্টেম’ ঘিরে উদ্বেগ ও বিতর্ক তীব্র হয়েছে। সরকারি সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও ২০২২ সালে তিনটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান আলাদা আলাদা লাইসেন্স পায়। পরে তারা কনসোর্টিয়াম গঠন করে কাজ শুরু করে। তদন্তে উঠে এসেছে—কনসোর্টিয়াম গঠন লাইসেন্সের শর্তভঙ্গের প্রশ্ন তুলছে।
যুক্তরাষ্ট্র হুয়াওয়ে-সংশ্লিষ্ট চীনা নির্মাতাকে ‘আনট্রাস্টেড’ হিসেবে দেখিয়ে এই কেবলের বিরুদ্ধে অনানুষ্ঠানিকভাবে আপত্তি জানিয়েছে। ফলে প্রযুক্তি খাতে বিধিনিষেধ বা নিষেধাজ্ঞার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ সরকারও উদ্বিগ্ন।
২০২২ সালে তৎকালীন সরকার সামিট কমিউনিকেশন, মেটাকোর ও সিডিনেটকে আলাদা সাবমেরিন কেবল লাইসেন্স দেয়। পরে এই তিন প্রতিষ্ঠান যৌথভাবে ‘বাংলাদেশ প্রাইভেট কেবল সিস্টেম’ নামে একটি কনসোর্টিয়াম গঠন করে।
কনসোর্টিয়াম সিঙ্গাপুর-মিয়ানমার রুটের মূল কেবল সিগমার-এর সঙ্গে শাখা কেবল যুক্ত করতে চায়। শাখা কেবলের নাম পরিচিতি হচ্ছে ইউএমওও। শাখার দৈর্ঘ্য প্রায় ১ হাজার ৩০০ কিলোমিটার। মূল সিগমার কেবলটি প্রায় ১ হাজার ৯০০ কিলোমিটার দীর্ঘ। এর ল্যান্ডিং পয়েন্ট সিঙ্গাপুরের টুয়াস এবং মিয়ানমারের থানলিন। এই কেবলের মালিক সিঙ্গাপুরভিত্তিক ক্যাম্পানা গ্রুপ।
কনসোর্টিয়াম মূল কেবল নির্মাণের জন্য চীনভিত্তিক হুয়াওয়ে মেরিন নেটওয়ার্ক (এইচএমএন)-কে নিয়োগ করেছে। চুক্তির ধারা অনুযায়ী (৩.২(খ)) হুয়াওয়ে মেরিন শাখা কেবলের নকশা, উন্নয়ন, প্রকৌশল, উৎপাদন, সরবরাহ, স্থাপন, পরীক্ষা ও কমিশনিং সব প্রযুক্তিগত কাজে এককভাবে দায়িত্ব পালন করবে। অর্থাৎ প্রযুক্তিগত নিয়ন্ত্রণ হুয়াওয়ের হাতে থাকবে। এটিই যুক্তরাষ্ট্রের মূল আপত্তি।
যুক্তরাষ্ট্র ২০২০ সালে চালু করে ক্লিন নেটওয়ার্ক প্রোগ্রাম। এর একটি অংশ ক্লিন কেবল ইনিশিয়েটিভ। এতে চীনভিত্তিক বিশেষ করে হুয়াওয়ের প্রযুক্তিকে কোর নেটওয়ার্কে প্রবেশ করতে নিষেধ করে যুক্তরাষ্ট্র। এই নীতিতে ৫৫টি দেশ অংশ নেয় বলে তথ্য পাওয়া গেছে।
যুক্তরাষ্ট্র মনে করে এই কেবলে গুপ্তচরবৃত্তি, ডেটা চুরি ও রাজনৈতিক প্রভাবের ঝুঁকি থাকতে পারে। সম্প্রতি এফসিসি-রও চীনা প্রযুক্তি নিষিদ্ধ করার প্রস্তুতি সম্পর্কিত খবর এসেছে। (প্রসঙ্গগত তথ্য প্রতিবেদন সূত্রের)।
কনসোর্টিয়ামের পক্ষ থেকে ২০২৩ সালের আগস্টে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো এক চিঠিতে বলা হয়, শাখা কেবল স্থাপনের জন্য মিয়ানমারের এক্সক্লুসিভ ইকোনমিক জোনে থাকা ব্রাঞ্চিং ইউনিট থেকে সিঙ্গাপুরের ল্যান্ডিং স্টেশন পর্যন্ত ‘ডার্ক ফাইবার’ লিজের চুক্তি করা হয়েছে। ফলে ব্রাঞ্চের অধিকাংশ অংশ মিয়ানমারের ইইজেডে পড়ে। সূত্র বলছে, মোট শাখার প্রায় ৯০ শতাংশ অংশ মিয়ানমারের ভেতরে অবস্থিত। এর অর্থ, রক্ষণাবেক্ষণ বা জরুরি পরিস্থিতিতে বাংলাদেশকে মিয়ানমারের অনুমতির ওপর নির্ভর করতে হতে পারে।
আদিতে সরকারি সাবমেরিন কেবল প্রকল্প সিমিউই-৬-এ চীনা প্রতিষ্ঠানের আগ্রহ থাকলেও পরে যুক্তরাষ্ট্রের আপত্তিতে তারা তা থেকে সরে আসে। নিরাপত্তার কারণে শেষ পর্যন্ত চীনভিত্তিক প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব দেওয়া হয়নি। এমন অভিজ্ঞতা থাকা সত্ত্বেও বেসরকারি প্রকল্পে হুয়াওয়ের প্রযুক্তিনির্ভরতা প্রকাশ্যে আসায় যুক্তরাষ্ট্র তীব্র আপত্তি জানিয়েছে। এ কারণেই ভবিষ্যতে সেবা প্রদানে বাধা বা নিষেধাজ্ঞার ঝুঁকি নিয়ে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
কয়েকটি ক্ষেত্রে চুক্তির ধারা সংক্রান্ত উদ্বেগও আছে। ক্যাম্পানার সঙ্গে চুক্তির ধারা ১১.২ অনুযায়ী, কোনো সরকারি কর্তৃপক্ষ লিখিত নির্দেশ দিলে ক্যাম্পানা নির্দিষ্ট ট্রান্সমিশন পথ বা ডার্ক ফাইবার সাময়িকভাবে বন্ধ করতে পারবে। তবে শাখা কেবল মিয়ানমারের ইইজেডে থাকায় এই ধারা বাস্তবে কীভাবে প্রয়োগ হবে তা নিয়ে সন্দেহও রয়েছে।
এক তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালে সিগমারে যোগদানের প্রস্তাব বাংলাদেশ সরকারের সাবমেরিন কেবল প্রতিষ্ঠান বিএসসিসিএলকেও দেওয়া হয়েছিল। তখন নিরাপত্তার ঝুঁকি বিবেচনায় বিএসসিসিএল সাড়া দেয়নি। পরে সেই প্রতিষ্ঠানের তখনকার ব্যবস্থাপনা পরিচালক মশিউর রহমান সিডিনেটে যোগ দিয়ে প্রকল্প বাস্তবায়নে নেতৃত্ব দেন।
প্রতিক্রিয়া ও প্রেক্ষাপট-
কনসোর্টিয়ামের লিড মেম্বার সামিট কমিউনিকেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আরিফ আল ইসলাম বলেন, জরিপ শেষ হয়েছে। এখন কয়েকটি মন্ত্রণালয়ের অনুমতির অপেক্ষায় আছি। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের কোনো আনুষ্ঠানিক আপত্তি সম্পর্কে জানেন না। তার বক্তব্য, হুয়াওয়ে কেবল স্থাপনের কাজ করবে। ইক্যুইপমেন্ট ইউরোপীয় কোম্পানি ব্যবহার হবে। তাই আপত্তির কারণ দেখছেন না।
প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান ফাইবার অ্যাট হোমের প্রধান প্রযুক্তি কর্মকর্তা সুমন আহমেদ সাব্বির বলেন, “যুক্তরাষ্ট্রের আপত্তি থাকলে বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে দেখা দরকার। অসতর্ক হলে নিষেধাজ্ঞার সম্ভাবনা অস্বীকার করা যাবে না। মিয়ানমারের মতো অস্থিতিশীল দেশে স্টেশন নির্মাণও ঝুঁকিপূর্ণ।”
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ডাক ও টেলিযোগাযোগ ও আইটি সহকারী ফয়েজ আহমেদ তৈয়্যব বলেন, “যুক্তরাষ্ট্র অনানুষ্ঠানিকভাবে আপত্তি জানিয়েছে। আমরা বিব্রত। আমরা এমন কোনো সিদ্ধান্ত নেব না যা ভূরাজনৈতিক টেনশন তৈরি করে। আমরা কনসোর্টিয়ামকে অনুরোধ করব, বিতর্কিত কেবলে না গিয়ে ট্রাস্টেড কেবলে অংশগ্রহণ করুক।”
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোর নেটওয়ার্কে প্রযুক্তিগত নিয়ন্ত্রণ চীনা প্রতিষ্ঠানের হাতে গেলে আন্তর্জাতিক ডেটা প্রবাহ ঝুঁকির মধ্যে পড়তে পারে। এর প্রভাব পড়তে পারে বাংলাদেশের ডিজিটাল অর্থনীতিতে। ব্যাংকিং, ই-কমার্স ও সফটওয়্যার এক্সপোর্টের ওপর নেতিবাচক প্রভাবের আশঙ্কাও করা হচ্ছে। একই সঙ্গে মিয়ানমারের ইইজেডে ভর করে নির্মিত কেবল হলে নিয়ন্ত্রণ ও নিরাপত্তা নিয়ে কূটনৈতিক জটিলতা বাড়তে পারে।
শুধু নিরাপত্তা না। বিদেশি বিনিয়োগ ও আন্তর্জাতিক অংশীদারিত্বেও প্রভাব পড়তে পারে। ফলে প্রকল্প বাস্তবায়নের আগে নীতিগত ও নিরাপত্তা ভিত্তিক পূর্ণাঙ্গ পুনঃপর্যালোচনা জরুরি বলে বিশেষজ্ঞদের আক্ষেপ।