আজ ১৬ ডিসেম্বর—মহান বিজয় দিবস। ৫৫তম এই বিজয় দিবসে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছে জাতি ১৯৭১ সালের সেই ঐতিহাসিক দিনটিকে, যেদিন নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের পর বাঙালি জাতি অর্জন করেছিল স্বাধীনতার চূড়ান্ত বিজয়। দখলদার পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে জন্ম নেয় সার্বভৌম বাংলাদেশ এবং উড়ে লাল-সবুজের পতাকা।
এবারের বিজয় দিবস এসেছে এক ভিন্ন রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় বাস্তবতায়। গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দায়িত্ব নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। এই সরকারের আমলেই আগামী বছরের ১২ ফেব্রুয়ারি ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং জুলাই সনদ বাস্তবায়নে গণভোট আয়োজনের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। জাতির প্রত্যাশা—এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্র সংস্কার ও গণতান্ত্রিক ধারায় বাংলাদেশ নতুন করে এগিয়ে যাবে। সেই প্রেক্ষাপটে এবারের বিজয় দিবস গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার ও বৈষম্যহীন নতুন বাংলাদেশের প্রত্যাশা নিয়ে উদযাপিত হচ্ছে।
মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মোঃ সাহাবুদ্দিন ও প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস পৃথক বাণীতে দেশবাসীকে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানিয়েছেন। তারা গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেছেন মহান মুক্তিযুদ্ধে আত্মত্যাগকারী অগণিত শহীদ ও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের, যাদের সর্বোচ্চ ত্যাগের বিনিময়ে এই বিজয় সম্ভব হয়েছে। দিবসটি যথাযোগ্য মর্যাদায় উদযাপনে জাতীয় পর্যায়ে ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে।
আজ সরকারি ছুটি। প্রত্যুষে ঢাকায় ৩১ বার তোপধ্বনির মাধ্যমে দিবসটির সূচনা হবে। দেশের সব সরকারি, আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও বেসরকারি ভবনসহ বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাস ও মিশনগুলোতে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হবে। সন্ধ্যায় গুরুত্বপূর্ণ ভবন ও স্থাপনাগুলো আলোকসজ্জায় সজ্জিত করা হবে। ঢাকা ও দেশের বিভিন্ন শহরের প্রধান সড়ক ও সড়কদ্বীপগুলো ব্যানার-ফেস্টুন ও রঙিন নিশানে সজ্জিত থাকবে।
সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে সকাল ৬টা ৩৪ মিনিটে রাষ্ট্রপতি ও প্রধান উপদেষ্টা সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন। এরপর মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফারুক-ই আজমের নেতৃত্বে বীরশ্রেষ্ঠ পরিবার, যুদ্ধাহত ও বীর মুক্তিযোদ্ধারা শ্রদ্ধা নিবেদন করবেন। পরে কূটনৈতিক মিশন, রাজনৈতিক দল, সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন ও সর্বস্তরের মানুষ শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাবেন।
বেলা ১১টা থেকে ঢাকার তেজগাঁওয়ে পুরাতন বিমানবন্দরে সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীর ফ্লাই-পাস্ট মহড়া অনুষ্ঠিত হবে। একই সঙ্গে পরিবেশিত হবে বিশেষ ব্যান্ডশো। স্বাধীনতার ৫৪ বছর পূর্তি উপলক্ষে ৫৪ জন প্যারাট্রুপার পতাকা হাতে প্যারাস্যুটিং করবেন, যা বিশ্বে সর্বাধিক পতাকা হাতে প্যারাস্যুটিং হিসেবে গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডে স্থান পাওয়ার আশা করা হচ্ছে। সারাদেশে সশস্ত্র বাহিনীর পাশাপাশি পুলিশ, বিজিবি, আনসার ও বিএনসিসির বাদক দল পরিবেশনা করবে।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে দেশের সব জেলা ও উপজেলায় তিন দিনব্যাপী বিজয়মেলা অনুষ্ঠিত হবে। সকাল ৯টায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে জাতীয় পতাকা উত্তোলন, জাতীয় সংগীত পরিবেশন, কুচকাওয়াজ ও ডিসপ্লে প্রদর্শন করা হবে।
সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের আয়োজনে বিকেল ৩টায় ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিজয় দিবসের বিশেষ সংগীতানুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হবে। একই সঙ্গে দেশের ৬৪ জেলায় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের গান পরিবেশন করবেন নতুন প্রজন্মের শিল্পীরা। এর আগে গতকাল সেখানে অ্যাক্রোবেটিক শো ও যাত্রাপালা ‘জেনারেল ওসমানী’ মঞ্চস্থ হয়েছে।
এছাড়া শিল্পকলা একাডেমি, বাংলা একাডেমি, জাতীয় জাদুঘর, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর ও শিশু একাডেমিসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক আলোচনা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, চিত্রাঙ্কন, রচনা ও ক্রীড়া প্রতিযোগিতার আয়োজন করবে। বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসগুলোতেও অনুরূপ কর্মসূচি পালন করা হবে।
বিকেলে বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি বীরশ্রেষ্ঠ পরিবারের সদস্যদের সংবর্ধনা দেবেন। মহানগর, জেলা ও উপজেলায় বীর মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ পরিবারের সদস্যদের সম্মাননা দেওয়া হবে। বাংলাদেশ ডাক বিভাগ স্মারক ডাকটিকিট প্রকাশ করবে। সারাদেশে হাসপাতাল, কারাগার, এতিমখানা, বৃদ্ধাশ্রমসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে প্রীতিভোজের আয়োজন করা হবে। দেশের শান্তি ও সমৃদ্ধি কামনায় সব ধর্মীয় উপাসনালয়ে বিশেষ প্রার্থনা অনুষ্ঠিত হবে।
বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বেতারসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক বিশেষ অনুষ্ঠান প্রচার করা হবে। সংবাদপত্রগুলো প্রকাশ করবে বিশেষ ক্রোড়পত্র। শিশুপার্ক ও জাদুঘরগুলো থাকবে বিনা টিকিটে উন্মুক্ত। সিনেমা হলে শিক্ষার্থীদের জন্য বিনামূল্যে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র প্রদর্শন করা হবে।
এছাড়া বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও পেশাজীবী সংগঠন নিজ নিজ কর্মসূচির মাধ্যমে দিবসটি পালন করবেন।

