ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে শুরু হয় এক ভিন্নধর্মী সাংস্কৃতিক পরিবেশনা। দুই ঘণ্টার এই আয়োজন ছিল দেশজুড়ে চলমান সংকট ও সংগ্রামের এক প্রতীকী প্রতিফলন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন স্থাপনা ও রাস্তা-টিএসসির রাজু ভাস্কর্য থেকে শুরু করে শাহবাগ, চারুকলা অনুষদ এবং জাতীয় জাদুঘর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল পরিবেশনার ক্ষেত্র।
‘লাল মজলুম’ নামের এই উন্মুক্ত গণপরিবেশনায় গানের সুর, নাটকের দৃশ্য, ভাস্কর্য ও চিত্রকলার মাধ্যমে উঠে আসে মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রাম, অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ এবং স্বাধীনতার চেতনা। শুরুতে সাদাপোশাকে গান গাইতে থাকা শিল্পীদের ওপর প্রতীকী “হেলমেট বাহিনী” হামলা চালায়। এরপর মিছিলের মধ্য দিয়ে ধাপে ধাপে নানা প্রতিবন্ধকতা, প্রতিরোধ ও পুনর্জাগরণের দৃশ্য ফুটে ওঠে।
এই পরিবেশনার উদ্দেশ্য ছিল দেশের মানুষের দীর্ঘদিনের সংগ্রামের স্মৃতি জাগ্রত করা এবং সম্প্রতি ঘটে যাওয়া ছাত্র-জনতার আন্দোলনের বার্তা আরও গভীরভাবে পৌঁছে দেওয়া। নাটকের নির্দেশক ড. শাহমান মৈশান বলেন,
“এটি সাধারণ মানুষের আকাঙ্ক্ষা ও প্রতিবাদের সাংস্কৃতিক রূপ। গণপরিসরে এই ধরনের পরিবেশনা মুক্তির বার্তা ছড়িয়ে দেওয়ার প্রয়াস।”
‘লাল মজলুম’ পরিবেশনায় বিভিন্ন শিল্পমাধ্যমের সম্মিলিত ব্যবহার দেখা যায়। নাট্যশিল্পীরা রাজপথে অভিনয়ের পাশাপাশি গান, স্লোগান, ভাস্কর্য ও প্রতীকী কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে তুলে ধরেন ইংরেজ শাসনের সময়কার বিদ্রোহ থেকে মুক্তিযুদ্ধ এবং সাম্প্রতিক আন্দোলনের ধারাবাহিকতা। “বল বীর, বল উন্নত মম শির” ধ্বনি আর “চল চল চল/ লাল মজলুম চল” স্লোগান রাজপথে গর্জে ওঠে।
মিছিলের একপর্যায়ে তৈরি করা ‘রাষ্ট্রীয় আয়নাঘর’ চুরমার করে শিল্পীরা করোটির স্তূপ আবিষ্কার করেন। এ সময় আশুরার মাতমের আদলে স্বজন হারানোর শোক প্রকাশ করা হয়। এরপর ‘লাল মজলুম গণ সংসদ’ -এর সামনে এসে শেষ হয় এই সাংস্কৃতিক যাত্রা। সেখানে মিছিলকারীরা জানান, তাঁরা কোনো ‘রিফর্মিং’ নয় বরং নিজেদের অধিকার নিজেরাই প্রতিষ্ঠা করতে চান।
পরিবেশনায় অংশ নেন কুর্নিকোভা চাকমা, তাহসান বিন রফিক, শাফিন শেখসহ ২০ জনের বেশি নাট্যশিল্পী। বাদ্যযন্ত্রের দলে ছিলেন বাদল হোসেন, মীর সাখাওয়াত, মেহেদী হাসান প্রমুখ। উপস্থিত দর্শকদের মধ্যে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ যোগ দেন, যাঁরা নিজেরাই অভিনয়ের এক পর্যায়ে বক্তব্য দেন।
‘লাল মজলুম’ পরিবেশনা শুধু একটি নাটক ছিল না। এটি ছিল জাগরণ, অনুপ্রেরণা এবং ঐক্যের প্রতীক। পথের পাশে দাঁড়িয়ে শত শত মানুষ এটি উপভোগ করেন। শিল্পীদের অভিনয় যেন তাঁদের বাস্তব জীবনের কষ্ট ও সংগ্রামের প্রতিধ্বনি। “যা ঘটেছে, তা আর যেন না ঘটে” এই বোধে দর্শকরা অনুপ্রাণিত হয়ে যান।
‘লাল মজলুম’ পরিবেশনা মনে করিয়ে দেয় যে শিল্প শুধু বিনোদন নয়, এটি প্রতিবাদের ভাষা। রাজপথের এই অভিনয় দেশের সংগ্রামী চেতনাকে আরও উজ্জীবিত করেছে।