বাংলাদেশে প্রাথমিক পর্যায়ে মোট শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১ কোটি ৯৭ লাখের কিছু বেশি। এর মধ্যে ১ কোটি ১০ লাখ শিক্ষার্থী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে, যা মোট শিক্ষার্থীর ৫৫.৭ শতাংশ। বাকি ৪৪.৩ শতাংশ শিক্ষার্থী বিভিন্ন বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, মাদ্রাসা ও কিন্ডারগার্টেনে পড়ছে।
স্বাধীনতার পাঁচ দশকেরও বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও প্রাথমিক পর্যায়ে সর্বজনীন ও বিনামূল্যে শিক্ষার শতভাগ সুযোগ নিশ্চিত করতে না পারাকে বড় ব্যর্থতা হিসেবে দেখছেন শিক্ষাবিদরা। সংবিধানের ১৭ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, নির্ধারিত স্তর পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যে ও বাধ্যতামূলক শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। ১৯৯০ সালের প্রাথমিক শিক্ষা (বাধ্যতামূলক) আইনেও এই নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। তবে তিন দশক পেরিয়েও প্রাথমিক শিক্ষায় সমতা ও মান নিশ্চিত করা যায়নি।
প্রাথমিক শিক্ষা পরিসংখ্যান ২০২৩ অনুযায়ী, ৮৭ লাখ ২৭ হাজার শিক্ষার্থী বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে পড়ছে। এর অর্ধেকেরও বেশি, প্রায় ৪৮ লাখ ৭৩ হাজার শিক্ষার্থী, কিন্ডারগার্টেনে পড়াশোনা করে। এছাড়া বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, মাদ্রাসা, এনজিও পরিচালিত স্কুলসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থী সংখ্যা উল্লেখযোগ্য। তবে কওমি মাদ্রাসা ও ইংরেজি মাধ্যমের তথ্য এ পরিসংখ্যানে অন্তর্ভুক্ত নেই।
বেসরকারি স্কুলগুলোয় পড়াশোনার খরচ অনেক বেশি। অভিভাবকরা জানায়, কিন্ডারগার্টেনে ভর্তি ফি গড়ে ২ হাজার থেকে ২০ হাজার টাকার মধ্যে। এছাড়া মাসিক বেতন ও কোচিং খরচ যোগ করলে মাসে প্রায় ৩ হাজার টাকা ব্যয় হয়।
নারায়ণগঞ্জের কাওসার আহমেদ জানায়, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মান নিয়ে সন্তুষ্ট না হওয়ায় তিনি ছেলেকে কিন্ডারগার্টেনে ভর্তি করেছেন। তার মাসিক আয় সীমিত হলেও সন্তানের ভবিষ্যতের কথা ভেবে এই ব্যয় মেনে নিতে হচ্ছে।
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে সবচেয়ে বড় সমস্যা শিক্ষক সংকট। বর্তমানে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত অনেক কম। আদর্শ অনুপাতে পৌঁছাতে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকের সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ করা প্রয়োজন।
বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোস্তাফিজুর রহমান শাহীন জানায়, কিছু এলাকায় বিদ্যালয় পর্যাপ্ত থাকলেও ঢাকার মতো এলাকায় তা যথেষ্ট নয়। এ জন্য নতুন বিদ্যালয় নির্মাণ, শিক্ষক সংখ্যা বৃদ্ধি এবং বিদ্যমান স্কুলগুলোর পরিবেশ উন্নত করা জরুরি।
অভিভাবকদের অনেকেই ধর্মীয় শিক্ষা, কারিকুলামের বৈচিত্র্য বা নিরাপদ পরিবেশের জন্য বেসরকারি স্কুল বেছে নিচ্ছেন। ঢাকা, গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জে সরকারি স্কুলের তুলনায় বেসরকারি স্কুলের সংখ্যা অনেক বেশি।
শিক্ষাবিদ আব্দুস সালাম জানায়, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে না পারার কারণে অনেক অভিভাবক বাধ্য হয়ে বেসরকারি শিক্ষায় বিনিয়োগ করছেন। এটি সামাজিক বৈষম্য তৈরি করছে।
জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এ প্রাথমিকে একমুখী শিক্ষা ব্যবস্থার কথা বলা হলেও দেশে এখনও পাঁচ ধরনের কারিকুলাম চালু রয়েছে। শিক্ষাবিদদের মতে, শিক্ষার্থীদের জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করতে হলে একই ধরনের কারিকুলাম ও মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা জরুরি।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী জানায়, প্রাথমিক শিক্ষাকে মৌলিক অধিকার হিসেবে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন। পাশাপাশি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে সুনির্দিষ্ট নীতিমালার আওতায় আনা উচিত।
পরামর্শক কমিটির আহ্বায়ক ড. মনজুর আহমেদ জানায়, সরকারি বিদ্যালয়গুলোর মানোন্নয়ন এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম নিয়মতান্ত্রিক করতে হবে। সব শিক্ষার্থীর জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করতে শিক্ষার বাজেট বৃদ্ধি, একীভূত শিক্ষা আইন প্রণয়ন এবং দরিদ্র শিক্ষার্থীদের জন্য উপবৃত্তি বাড়ানো প্রয়োজন।
সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগের সমন্বয়ে প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়ন, বৈষম্য হ্রাস এবং মানোন্নয়ন নিশ্চিত করাই এখন বড় চ্যালেঞ্জ।