আন্তর্জাতিক পর্যটকদের জন্য সম্ভাবনাময় দেশ হিসেবে পরিচিত বাংলাদেশ আজ কার্যত পর্যটনশূন্য। যুক্তরাষ্ট্রসহ একাধিক পশ্চিমা দেশের জারি করা ‘ট্রাভেল অ্যাডভাইজরি’ বা ভ্রমণ সতর্কতার কারণে বিদেশি পর্যটকরা এখন বাংলাদেশের গন্তব্যগুলো এড়িয়ে যাচ্ছেন। এতে মারাত্মক বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে দেশের পর্যটন খাত।
ট্যুর অপারেটরদের তথ্যমতে, ২০২৫ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত বিদেশি বুকিং ২০২৩ সালের তুলনায় ৬০–৭০ শতাংশ কমে গেছে। বিশেষ করে কক্সবাজার, সুন্দরবন ও সিলেটের মতো জায়গায় ইউরোপ-আমেরিকার পর্যটকদের উপস্থিতি এখন প্রায় শূন্য।

বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন প্যাসিফিক এশিয়া ট্রাভেল অ্যাসোসিয়েশন (পাটা) বাংলাদেশ চ্যাপ্টারের মহাসচিব ও জার্নি প্লাসের প্রধান নির্বাহী তৌফিক রহমান। তিনি বলেন, “রাজনৈতিক সহিংসতার খবর বিশ্ববাসীর কাছে পৌঁছানোর পর ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা যেন মরার ওপর খাঁড়ার ঘা হয়ে এসেছে। ফলে ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ বিদেশি পর্যটক হারিয়েছি আমরা।”
তিনি জানান, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, ফ্রান্স, অস্ট্রিয়া, স্পেন, নেদারল্যান্ডসসহ অন্তত ২০টি দেশ বাংলাদেশকে ‘ভ্রমণ সতর্কতা তালিকায়’ রেখেছে। এতে করে বাংলাদেশ ভ্রমণে আগ্রহ হারাচ্ছেন বিদেশিরা।

তৌফিক রহমান আরো বলেন, “এই নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে এখন যৌথ উদ্যোগ নেওয়া ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড, বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং বিদেশে বাংলাদেশ হাইকমিশনগুলোকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।”
ভ্রমণ সতর্কতা কীভাবে ক্ষতি করছে?
বিশ্বজুড়ে পর্যটকরা গন্তব্য নির্ধারণের আগে নিজ নিজ দেশের দেওয়া ট্রাভেল অ্যাডভাইজরি অনুসরণ করেন। এই সতর্কতায় কোনো দেশকে ‘হালকাভাবে সতর্ক’, আবার কোনো ক্ষেত্রে ‘সম্পূর্ণ ভ্রমণ নিষিদ্ধ’ তালিকায় রাখা হয়। বাংলাদেশ বর্তমানে অনেক দেশের কাছে মাঝারি থেকে উচ্চ ঝুঁকির পর্যায়ে রয়েছে।
ফলে বহু বিদেশি পর্যটক বাংলাদেশ সফর বাতিল করছেন বা অন্য দেশে ভ্রমণ পরিকল্পনা করছেন। এতে বিমাবন্দরে আসা-যাওয়ার সংস্থা, আবাসিক হোটেল, গাইড সার্ভিস, ট্যুর অপারেটরসহ পুরো পর্যটন ব্যবসা সংকটে পড়েছে।
কূটনৈতিক সূত্র বলছে, যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো নিরাপত্তাজনিত কারণ দেখিয়ে ট্রাভেল অ্যালার্ট জারি করে থাকে, যাতে নাগরিকরা পরে কোনো ঝুঁকিতে পড়লে সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্র দায় এড়াতে পারে।

বিটিবির জরুরি চিঠি-
ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারে জরুরি পদক্ষেপ নিতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবকে চিঠি দিয়েছে বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড (বিটিবি)। এতে বাংলাদেশকে দক্ষিণ এশিয়ার সম্ভাবনাময় পর্যটন গন্তব্য হিসেবে তুলে ধরে ট্রাভেল অ্যাডভাইজরি প্রত্যাহারে কূটনৈতিক তৎপরতা জোরদারের আহ্বান জানানো হয়েছে।
চিঠিতে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া সহ বিভিন্ন উন্নত দেশ বাংলাদেশ ভ্রমণে লেভেল ২ থেকে লেভেল ৪ পর্যন্ত সতর্কতা জারি রেখেছে। এর ফলে বাংলাদেশে আসা অনেক বিদেশি ট্যুর বাতিল হচ্ছে।
বিটিবির প্রধান নির্বাহী আবু তাহের মুহাম্মদ জাবের বলেন, “পর্যটন উন্নয়নে শুধু পর্যটন বোর্ড বা করপোরেশন নয়, সংশ্লিষ্ট সব মন্ত্রণালয়কে এগিয়ে আসতে হবে। ভ্রমণ সতর্কতা প্রত্যাহারে সমন্বিত উদ্যোগই পারে সমস্যার সমাধান দিতে।”

বিদেশি পর্যটক কমেছে আশঙ্কাজনক হারে-
বিটিবির তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালে সর্বোচ্চ ৬ লাখ ২১ হাজার বিদেশি বাংলাদেশে এসেছিলেন। তবে করোনার পর সেই সংখ্যা দ্রুত কমেছে। ২০২২ সালে বিদেশি পর্যটক ছিলেন মাত্র দেড় লাখ, আর ২০২৩ সালের আগস্ট পর্যন্ত এসেছেন দুই লাখ ১৪ হাজার জন। তবে এদের বেশির ভাগই প্রবাসী বাঙালি, প্রকৃত পর্যটক নন।
দেশে প্রতি বছর প্রায় দেড় কোটি মানুষ পর্যটনস্পটে ভ্রমণ করলেও এর মধ্যে বিদেশিদের অংশগ্রহণ মাত্র ৩ থেকে ৫ শতাংশ। অথচ বিশ্ব পর্যটন বাজারে ইউরোপ ও আমেরিকার অংশীদারিত্ব ৫৩ শতাংশ।

প্রতিবেশী দেশগুলো এগিয়ে, আমরা পিছিয়ে-
পর্যটনে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশ- ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপ- বিশ্ব পর্যটকদের কাছে পরিচিত ও জনপ্রিয়। উন্নত সেবা, সাশ্রয়ী খরচ ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করে তারা পর্যটকদের টানতে সক্ষম হলেও বাংলাদেশ সেখানে পিছিয়ে।
বাংলাদেশে থ্রি বা ফোর স্টার হোটেলের এক রাতের ভাড়া ৮-১০ হাজার টাকা, ফাইভ স্টার হোটেলে ১০ থেকে ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত। এই খরচ ভারত, মালয়েশিয়া বা থাইল্যান্ডের তুলনায় অনেক বেশি। পর্যটকবান্ধব পরিবেশ না থাকায় বাংলাদেশ প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারছে না।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ওয়ার্ল্ড ট্যুরিজম নেটওয়ার্কের বাংলাদেশ চ্যাপ্টারের মহাসচিব সৈয়দ গোলাম কাদীর বলেন, “এখানে পর্যটনের ওপর নানা করের বোঝা চাপানো হয়েছে। ফলে আমরা প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ছি। সরকারের পক্ষ থেকেও যথাযথ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না।”

কী করা দরকার?
পর্যটন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দ্রুত ই-ভিসা চালু করা, অন অ্যারাইভাল ভিসায় সহজতা আনা, অবকাঠামো উন্নয়ন, সেবার মান বাড়ানো এবং দেশের ভাবমূর্তি আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে তুলে ধরাই এখন জরুরি।
ট্যুর অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি রাফিউজ্জামান বলেন, “ট্রাভেল অ্যাডভাইজরি প্রত্যাহারে কূটনৈতিক উদ্যোগ বাড়ানো, ই-ভিসা চালু, বিমানবন্দরে বিড়ম্বনা কমানো ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই।”
ট্রাভেল সতর্কতার কারণে বাংলাদেশের পর্যটনশিল্প এখন প্রায় নিস্তেজ। সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও অনাগ্রহ, অনিয়ম ও সমন্বয়হীনতার কারণে এই খাত রেমিট্যান্স আয় ও জাতীয় অর্থনীতিতে যথাযথ অবদান রাখতে পারছে না। জরুরি ভিত্তিতে ট্রাভেল অ্যাডভাইজরি প্রত্যাহারে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা ও কার্যকর সংস্কার ছাড়া এই খাতের পুনরুদ্ধার কঠিন হবে বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।