দেশের প্রায় অর্ধেক মানুষ নিজেকে নিরাপদ মনে করেন না। আতঙ্ক শুধু ব্যক্তিগত সুরক্ষা নিয়ে নয়— নিজের সম্পদ, ঘরবাড়ি এমনকি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান নিয়েও মানুষ দুশ্চিন্তায় আছেন। এই শঙ্কা শহরে বেশি। নারীদের মধ্যে ভয় আরও প্রকট।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সাম্প্রতিক জরিপ ‘সিটিজেন পারসেপশন সার্ভে (CPS)’-এ উঠে এসেছে নাগরিকদের এমনই ভয়াবহ অভিমত। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে জরিপটি পরিচালনা করা হয়, যার ফল ১৯ জুন প্রকাশিত হয়েছে।
● বিশাল আকারে জরিপ, উঠে এসেছে বাস্তব ভয়
জরিপে দেশের ৬৪ জেলায় ১ হাজার ৯২০টি নমুনা এলাকা (PSU) থেকে ৮ লাখ ৩১ হাজার ৮০৭ জন নাগরিকের মতামত সংগ্রহ করা হয়। এদের বয়স ১৮ বা তার বেশি। প্রশ্নপত্র ছিল জাতিসংঘ নির্ধারিত।
মূলত এসডিজি-১৬ এর অধীন ৬টি সূচকে নাগরিকদের দৃষ্টিভঙ্গি, অভিজ্ঞতা ও মূল্যায়ন জানতে চাওয়া হয়। এতে উঠে এসেছে— নিরাপত্তা ও সুশাসন নিয়ে নাগরিকদের গভীর উদ্বেগ।
● মূল্যবান সম্পদ নিয়ে ভয়, শহরে বেশি শঙ্কা
প্রতিবেদনে দেখা যায়, ৪৭ দশমিক ১৭ শতাংশ নাগরিক বলেন, তারা মূল্যবান সম্পদ হারানোর আশঙ্কায় আছেন। শহরাঞ্চলে এই হার ৫০ দশমিক ৫৫ শতাংশ, গ্রামাঞ্চলে ৪৫ দশমিক ৬১ শতাংশ।
বাড়িঘর ভাঙচুর বা ডাকাতি নিয়ে ভয়ের কথা জানান ৪১ দশমিক ৭৪ শতাংশ। শহরে এ হার ৪৪ দশমিক ৫৫ শতাংশ, গ্রামে ৪০ দশমিক ৪৩ শতাংশ।
এই তথ্যগুলো স্পষ্ট করে দেয়— শহরে অপরাধের আশঙ্কা এবং নিরাপত্তাহীনতা গ্রামের তুলনায় বেশি। উন্নত নাগরিক সেবা থাকলেও, নিরাপত্তা নিয়ে অনিশ্চয়তা বেড়েছে।
● নারীরা তুলনামূলক বেশি ভয়ভীতির মধ্যে
পরিসংখ্যান বলছে,
- ৪৯ দশমিক ৮৮ শতাংশ নারী বলেন, তারা মূল্যবান সম্পদ হারানোর আশঙ্কায় আছেন
- পুরুষদের ক্ষেত্রে এ হার ৪৪ দশমিক ০৮ শতাংশ
- বাড়িঘর ভাঙচুর নিয়ে ৪৪ দশমিক ৪৯ শতাংশ নারী চিন্তিত
- যেখানে পুরুষদের মধ্যে এ হার মাত্র ৩৮ দশমিক ৫৯ শতাংশ
এই পার্থক্য দেখায়— নারীরা নিরাপত্তা নিয়ে পুরুষের তুলনায় বেশি আতঙ্কে থাকেন। কারণ, সামাজিক ও শারীরিক ঝুঁকি তাদের জন্য বহুমাত্রিক।
● শারীরিক আঘাতের ভয়— শহরে উচ্চ, নারীরা ঝুঁকিপূর্ণ
জরিপে বলা হয়, ৩৩ দশমিক ৯১ শতাংশ নাগরিক ছিনতাই, ডাকাতি বা হামলার শিকার হওয়ার ভয় পান।
- শহরে এই ভয়ের হার ৪১ দশমিক ২৮ শতাংশ
- গ্রামে ৩০ দশমিক ৫ শতাংশ
- নারীদের মধ্যে শারীরিক হামলার ভয় ৩৬ দশমিক ৬৯ শতাংশ
- পুরুষদের মধ্যে এই হার ৩০ দশমিক ৭৩ শতাংশ
এই পরিসংখ্যান ইঙ্গিত দেয়— নারী এবং শহরবাসী নাগরিকরা নিরাপত্তাহীনতায় সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত।
● কারণ কী? বিশ্লেষকদের মত
জরিপে উঠে আসা তথ্যের প্রেক্ষিতে সমাজ বিশ্লেষক ও অপরাধবিজ্ঞানী ড. তৌহিদুল হক বলেন,
“আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ঘাটতি এতটাই প্রকট যে, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরাও হামলার শিকার হচ্ছেন। তাহলে সাধারণ মানুষ কিভাবে নিরাপদ বোধ করবে?”
তিনি আরও বলেন—
“মব ভায়োলেন্স ভয়ঙ্কর মাত্রায় পৌঁছেছে। রাজনৈতিক পরিচয় ব্যবহার করে হয়রানি, হামলা বা সম্পদ দখলের ঘটনা উদ্বেগজনক। এই পরিবেশ নাগরিকদের মধ্যে স্থায়ী ভীতি তৈরি করেছে।”
● মব ভায়োলেন্স নিয়ন্ত্রণ ছাড়া উপায় নেই
বিশ্লেষকরা বলছেন,
- আইনের শাসন নিশ্চিত না হলে এ অবস্থার উন্নয়ন হবে না
- অপরাধীর রাজনৈতিক পরিচয় নয়, অপরাধকেই বিচার্য করতে হবে
- মব ভায়োলেন্স কঠোরভাবে দমন করতে না পারলে সামাজিক নিরাপত্তা ভেঙে পড়বে
- জনআস্থা ফেরাতে নিরপেক্ষ ও জবাবদিহিমূলক পুলিশিং দরকার
একটি সুস্থ গণতন্ত্রে নাগরিককে নিরাপত্তা দিতে না পারা মানে রাষ্ট্রীয় কাঠামোর চরম ব্যর্থতা।
● সরকার ও প্রশাসনের দায়িত্ব
বিশ্লেষকরা বলছেন— শুধু আইনি কাঠামো যথেষ্ট নয়।
- মানুষের আস্থা অর্জন জরুরি
- সুরক্ষা নিশ্চিত করতে রাষ্ট্রকে দৃঢ় রাজনৈতিক সদিচ্ছা দেখাতে হবে
- সব নাগরিকের জন্য সমান নিরাপত্তার গ্যারান্টি দিতে হবে
এই জরিপ আমাদের সামনে নগ্ন বাস্তবতা তুলে ধরেছে। যে সমাজে অর্ধেক মানুষ নিজেকে অনিরাপদ মনে করে, সেখানে উন্নয়ন, সুশাসন ও মানবাধিকার কেবল পরিসংখ্যানে সীমাবদ্ধ।
মানুষকে নিরাপত্তা দিতে না পারলে, তারা মুক্তচিন্তা, কর্মজীবন বা সামাজিক উন্নয়নের পথে এগোতে পারে না। নিরাপত্তা শুধু দেয়াল বা তালায় নয়— আইনের শাসন, বিশ্বাসযোগ্য বিচারব্যবস্থা আর মানবিক রাষ্ট্রযন্ত্রে নিহিত।