মাওয়া-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ের দুর্ঘটনার চিত্র এখন আতঙ্কের প্রতীক। ঈদের আগে দ্রুতগতির একটি বাসের ছাদ উড়ে যাওয়া আলোচনায় আসে সড়কের বেপরোয়া গতির বিপজ্জনক বাস্তবতা। এর কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই একের পর এক দুর্ঘটনায় ঝরেছে প্রাণ। সর্বশেষ শনিবার এক বাস ট্রাকের পেছনে ধাক্কা দিলে মারা যান তিন যাত্রী ও ট্রাকচালকের সহকারী। এর আগে এপ্রিলের শেষদিকে একই পথে মোটরসাইকেলের এক আরোহী নিহত হন ট্রাকের ধাক্কায়। ৮ মে অ্যাম্বুলেন্স ও বাসের সংঘর্ষে নিহত হন পাঁচজন।
তবে শুধু এই মহাসড়কেই নয়, দেশের অন্যান্য জাতীয় মহাসড়কেও ঘটছে একই ধরনের প্রাণঘাতী দুর্ঘটনা।
চার মাসে দুর্ঘটনা বেড়েছে ৪১ শতাংশ
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্য বলছে, ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় মহাসড়কে ২০৯টি দুর্ঘটনা ঘটলেও জুনে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৯৬টিতে। চার মাসে বৃদ্ধি ৪১.৬৩ শতাংশ। জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ছয় মাসে দুর্ঘটনার সংখ্যা ১৩৯৭টি। এর মধ্যে মার্চে সবচেয়ে বেশি ২২৮টি এবং ফেব্রুয়ারিতে সবচেয়ে কম ২০৯টি।
বিশেষজ্ঞদের মতে, সড়কের মান যতই উন্নত হোক, গণপরিবহনের মান না বাড়লে দুর্ঘটনা কমবে না। অনেক যানবাহনের ফিটনেস নেই, চালকদের নেই পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ। ফলে অতিরিক্ত গতির লাগাম টেনে ধরা যাচ্ছে না।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক শামছুল হক বলেন, ‘দুর্ঘটনার মূল কারণ বিশৃঙ্খলা। বিশেষ করে তিন চাকার যানবাহন মহাসড়কে দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়িয়ে তুলছে।’
তিন চাকার যানেই বেশি দুর্ঘটনা
সেভ দ্য রোড-এর হিসাবে, গত ছয় মাসে দেশে মোট ১৭ হাজার ৯৫৭টি সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে ২৭৭৮ জনের। আহত ১৭ হাজার ৮২৬ জন। এর মধ্যে ব্যাটারিচালিত রিকশা, ইজিবাইক ও অটোরিকশা–এমন তিন চাকার যানে দুর্ঘটনা ঘটেছে ৮৮১২টি। প্রাণ গেছে ৭৯৫ জনের, আহত হয়েছেন ৮৮১৫ জন।
একই সময়ে বাস দুর্ঘটনা হয়েছে ৩৪০৪টি। নিহত ৮২৫ জন, আহত ৩৩১৮ জন। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা হয়েছে ৩৭১৪টি। প্রাণ গেছে ৬৭৩ জনের, আহত হয়েছেন ৩৬২৩ জন।
বিআরটিএ পরিচালক শীতাংশু শেখর বিশ্বাস বলেন, ‘জাতীয় মহাসড়কে শৃঙ্খলা রক্ষায় স্থানীয় পর্যায়ের সহযোগিতা দরকার। কেন্দ্রীয়ভাবে নিয়ন্ত্রণ কঠিন। স্থানীয়ভাবে মনিটরিং ও সচেতনতা বাড়াতে হবে।’
আঞ্চলিক সড়কেও দুর্ঘটনার ঝুঁকি
ছয় মাসে আঞ্চলিক সড়কে মোট ১৪৮৫টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। ফেব্রুয়ারিতে সর্বোচ্চ ২৬৮টি, মে মাসে সর্বনিম্ন ২১৯টি। যদিও সংখ্যা বিচারে জাতীয় মহাসড়কের তুলনায় এখানেই দুর্ঘটনা বেশি।
আনফিট গাড়ি, ছোট যানবাহনের আধিক্য, অবৈধ তিন চাকার গাড়ি, শৃঙ্খলার অভাব, পুলিশের নজরদারিতে ঘাটতি এবং রাস্তার পাশে বাজার বসার প্রবণতা—এসব মিলেই বাড়ছে দুর্ঘটনার ঝুঁকি।
যাত্রী কল্যাণ সমিতির তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে তিন চাকা ও ছোট যানবাহনের কারণে দুর্ঘটনা বেড়েছে ১১.২২ শতাংশ। মোট দুর্ঘটনার ৩৪.৮৬ শতাংশ ঘটেছে জাতীয় মহাসড়কে এবং ২৮.৪১ শতাংশ আঞ্চলিক সড়কে।
মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, ‘আঞ্চলিক সড়ক জাতীয় সড়কের সেতুবন্ধ। নজরদারির বাইরে থাকলে দুর্ঘটনা রোধ সম্ভব নয়। তিন চাকার যান ও মোটরসাইকেল আজ আতঙ্কে পরিণত হয়েছে।’
মোটরসাইকেলে মৃত্যুর হারের ভয়ংকর বৃদ্ধি
পাঁচ বছরে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মৃত্যুর হার বেড়েছে প্রায় ৮০ শতাংশ। ২০২০ সালে মৃত্যু হয় ১৪৬৩ জনের, ২০২৪ সালে তা দাঁড়ায় ২৬০৯ জনে। একই সময় মোটরসাইকেল বেড়েছে ৬৩ শতাংশ—১৭ লাখ ৬৬ হাজারের বেশি। বিআরটিএর হিসাব অনুযায়ী, ২০২০ সালে নিবন্ধিত মোটরসাইকেলের সংখ্যা ছিল ২৮ লাখ ১৪ হাজার, ২০২৪ সালে তা হয়েছে ৪৫ লাখ ৮১ হাজার।
জাতীয় ও আঞ্চলিক সড়কে নির্ধারিত গতি মানা হচ্ছে না। অতিরিক্ত গতিই প্রাণহানির বড় কারণ হয়ে উঠেছে।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান বলেন, ‘জাতীয় সড়কে এখন গতির প্রতিযোগিতা চলছে। সেটা নিয়ন্ত্রণের মতো প্রযুক্তি বা লোকবল আমাদের নেই। তিন হাজার কিলোমিটার সড়ক হাইওয়ে পুলিশ দেখছে, বাকি ছয় হাজার কিলোমিটার পুরো ফাঁকা পড়ে আছে। আঞ্চলিক সড়কে তো তদারকিই নেই।’