উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন নিয়ে বিদেশে যেতে চাইছেন অনেক বাংলাদেশি শিক্ষার্থী। কিন্তু তাদের যাত্রাপথ জটিল হয়ে উঠছে ভিসাজনিত নানা সমস্যায়। দেশে ভিসার তারিখ না পাওয়া থেকে শুরু করে বিদেশে গিয়ে হঠাৎ ভিসা বাতিল হওয়ার মতো ভোগান্তি এখন নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হয়েছে।
ঢাকার একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক শেষ করা রাফিয়া তাবাসসুম (ছদ্মনাম) যুক্তরাষ্ট্রে পড়াশোনার সুযোগ পান। তবে ভিসা সাক্ষাৎকারের সময় নিতে গিয়ে বড় ধরনের সমস্যায় পড়েন তিনি। শুরুতে কোনো তারিখই পাননি। পরে আবেদন করে ডিসেম্বরের একটি তারিখ পান, যা ছিল সাত মাস পর। দীর্ঘ এই অপেক্ষার কারণে ভর্তি স্থগিত হয়ে যায় এবং তাকে পরবর্তী সেমিস্টারে পড়াশোনা শুরু করতে হয়।
রাফিয়ার মতোই ভিসার তারিখ পেতে অনেক শিক্ষার্থী পড়ছেন দুর্ভোগে। কিন্তু সমস্যা এখানেই শেষ নয়। ভিসা বাতিল হয়ে জীবনই ওলটপালট হয়ে গেছে কারও কারও।
যুক্তরাষ্ট্রে মাস্টার্সের শেষ পর্যায়ে ছিলেন বাংলাদেশি শিক্ষার্থী আরাফাত হোসেন (ছদ্মনাম)। এক সকালে ই-মেইলে জানতে পারেন, তার শিক্ষার্থী ভিসা বাতিল করা হয়েছে। দ্রুত দেশ ছাড়ার নির্দেশও আসে। শেষ পরীক্ষার আগে এমন ধাক্কা তার স্বপ্ন ভেঙে দেয়। তিনি অভিযোগ করেন, ইসরায়েলি আগ্রাসন ও গাজায় গণহত্যার বিরুদ্ধে আন্দোলনে অংশ নেওয়ায় ভিসা বাতিল করা হয়েছে।
আরাফাতের ঘটনা একক নয়। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর জানিয়েছে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ৬ হাজারের বেশি শিক্ষার্থী ভিসা বাতিল করা হয়েছে। ফক্স নিউজের খবরে বলা হয়, ট্রাম্প প্রশাসনের কঠোর নীতির অংশ হিসেবেই এই পদক্ষেপ। অভিযোগগুলোর মধ্যে ছিল আইন ভঙ্গ, হামলা, মদ্যপ অবস্থায় গাড়ি চালানো, চুরি ও ‘সন্ত্রাসবাদে সমর্থন’। এতে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের মধ্যে।
তবুও বিদেশে পড়াশোনার আগ্রহ থেমে নেই। নুসরাত নাজনীন ইভা, সদ্য স্নাতক কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার, যুক্তরাষ্ট্রে পিএইচডি করতে চান। তবে তিনি বলেন, শিক্ষার্থী ভিসার নিয়ম আরও কঠোর হচ্ছে, তাই ভেতরে ভেতরে ভয় কাজ করছে।
তথ্য বলছে, বিদেশে পড়াশোনায় বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের আগ্রহ এখন রেকর্ড ছুঁয়েছে। ইউনেসকোর হিসাবে, ২০২৩ সালে ৫২ হাজার ৭৯৯ জন শিক্ষার্থী বিদেশে পড়তে গেছেন। ২০০৮ সালে এ সংখ্যা ছিল মাত্র ১৬ হাজার। শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই গত বছর পড়াশোনা করেছেন ১৭ হাজারেরও বেশি বাংলাদেশি শিক্ষার্থী, যা আগের বছরের তুলনায় ২৬ শতাংশ বেশি।
রাজনৈতিক অস্থিরতা, সীমিত শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের সুযোগ শিক্ষার্থীদের বিদেশমুখী হওয়ার অন্যতম কারণ। ইভার ভাষায়, “দেশে থাকার কোনো মানে দেখি না। প্রতিদিনই আন্দোলন, সহিংসতা বা অস্থিরতা। মানসিকভাবে ভেঙে পড়ি। তাই বিদেশে যাওয়ার সিদ্ধান্ত আরও দৃঢ় হয়।”
শিক্ষার্থী ভিসার পাশাপাশি শ্রম ও পর্যটক ভিসার কড়াকড়িও প্রভাব ফেলছে। অনেক দেশ ভিসা দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে বা কঠোর শর্ত আরোপ করেছে। বিশেষ করে উপসাগরীয় দেশ ও মালয়েশিয়ায় স্বল্পদক্ষ শ্রমিকদের জন্য ভিসা বন্ধ রয়েছে।
তবে এই সংকটের মধ্যেও অনেক শিক্ষার্থী ভাগ্যবান। যেমন আহনাফ চৌধুরী নিলয়, যিনি যুক্তরাষ্ট্রে জর্জিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটিতে ডক্টরাল ফেলো হয়েছেন। তিনি বলেন, তার ভিসা প্রক্রিয়া তুলনামূলক সহজে সম্পন্ন হয়। যদিও স্বীকার করেন, বিশ্বজুড়ে স্কলারশিপের সুযোগ কমছে, কিন্তু আবেদনকারীর সংখ্যা বাড়ছে।
শিক্ষা পরামর্শক তাহিয়া তালবিয়া মিমের মতে, ভিসা অনুমোদনের হার কমলেও আবেদনকারীর সংখ্যা বেড়েছে। অনেক দেশ মানদণ্ড উঁচু করেছে, আবার মেধাবীদের জন্য বৃত্তি ও সুযোগ প্রচার করছে। ফলে যোগ্য শিক্ষার্থীদের ভিসা পাওয়ার সম্ভাবনা এখনও ভালো।
বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা তাই নানা অনিশ্চয়তার মাঝেও বিদেশে পড়াশোনার স্বপ্ন আঁকড়ে ধরে আছেন। ভিসা জটিলতা ও রাজনৈতিক বাস্তবতা তাদের যাত্রাকে কঠিন করছে, কিন্তু থামাতে পারছে না।