গত বছরের ৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের পর দেশের বিভিন্ন স্থানে থানায় হামলা, ভাঙচুর ও অস্ত্র-গুলি লুট হওয়া ঘটেছে। এ ঘটনায় ফেনী মডেল থানাও বাদ যায়নি। ওই ঘটনায় মামলা হয় এবং মো. জামাল উদ্দিন গাজীকে আসামি হিসেবে গ্রেপ্তার করা হয়। চার মাস পর তিনি জামিনে মুক্তি পান।
বর্তমানে তিনি মামলা দায়ের করেছেন, দাবি করেছেন- তিনি বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সময় আহত হয়েছেন। তবে এ মামলায় ২৬৪ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে, যার মধ্যে অজ্ঞাতনামা আসামি একশ থেকে দেড়শ জন।
ফেনী পৌরসভার ১৮ নম্বর ওয়ার্ডের বিএনপির সহসভাপতি আবদুল মতিন পারভেজ জানিয়েছেন, পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে এসে মামলার বাদী স্বীকার করেছেন যে তিনি পারভেজকে চেনেন না। এরপর কে পারভেজের নাম উল্লেখ করেছেন, সেটি এখনও রহস্য।
মামলার প্রাথমিক প্রক্রিয়া ও তদন্তের বিষয়ে জানা গেছে, প্রথমে ফেনী মডেল থানায় মামলা করার চেষ্টা করেছিলেন জামাল গাজী। ব্যর্থ হওয়ায় তিনি গত ১৭ আগস্ট সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে আবেদন করেন। আদালত মামলাটি অতিরিক্ত পুলিশ সুপারকে (সদর সার্কেল) তদন্ত করে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য নির্দেশ দেন। বর্তমানে সেই তদন্ত চলছে।
জামাল গাজী কাছে বলেন, দীর্ঘদিন চিকিৎসাধীন থাকায় মামলা করার বিষয়টি বিলম্বিত হয়েছে। তিনি দাবি করেন, ফেনী থানায় গণ-অভ্যুত্থান সংক্রান্ত মামলায় তাকে ষড়যন্ত্র করে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। তিনি ফেনী জেলা যুবদলের সাবেক সদস্য ও ছাগলনাইয়া উপজেলা যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক। পেশায় তিনি ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী।
মামলা–বাণিজ্যের সূচনা ও প্রসার-
সংবাদমাধ্যম প্রথম আলোর অনুসন্ধান অনুসারে ফেনীতে দেখা যায়, মামলা–বাণিজ্য বহু স্তরে সংগঠিত এবং চলছে। ব্যবসায়িক ও ব্যক্তিগত বিরোধের কারণে এক পক্ষ টাকা নিয়ে তার প্রতিপক্ষের নাম মামলায় অন্তর্ভুক্ত করে। কেউ কেউ টাকা দিতে অস্বীকার করলে তাদের নাম আসামি হিসেবে ফাইল করা হয়। এ ধরনের মামলার বেশিরভাগ আসামি মামলার বাদীকে চেনেন না। মামলার নিয়ন্ত্রণ সম্পূর্ণ রাজনৈতিক ও পুলিশি সূত্রের হাতে থাকে। এই প্রক্রিয়ায় ফেনীর স্থানীয় বিএনপির কিছু নেতা বিশেষভাবে যুক্ত।
ফেনীতে জামাল গাজীর এজাহারে বিএনপির নেতাদের পাশাপাশি জামায়াত, জাতীয় পার্টি, ব্যবসায়ী ও প্রবাসীদের নামও অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এটি প্রমাণ করে, মামলা–বাণিজ্য একত্রিত রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে। ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর ‘মামলা–বাণিজ্য’ শব্দবন্ধটি স্থানীয়ভাবে ব্যাপকভাবে পরিচিতি পেয়েছে।
এছাড়া, জামায়াতের ছাগলনাইয়া শাখা ১২ সেপ্টেম্বর সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছে, গণ-অভ্যুত্থানকেন্দ্রিক একটি হত্যাচেষ্টার মামলায় তাদের আটজন নেতা ও সাধারণ মানুষকে আসামি করা হয়েছে।
ফেনী জেলা জামায়াতের কৃষি ও অর্থনীতিবিষয়ক সম্পাদক মুজিবুর রহমান বলেন, আদালতে ১৭ আগস্ট একটি মামলার আবেদন করা হয়েছে, যাতে জামায়াতের একজন রুকন ও সাতজন কর্মীকে আসামি করা হয়েছে। অনেক ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষ অভিযোগ করেছেন, তাদেরকে আসামি করা হয়েছে হয়রানির উদ্দেশ্যে।
‘বড়শি’ ফেলার পদ্ধতি-
ফেনীতে আদালতের মাধ্যমে মামলা করার প্রক্রিয়া অনেকটাই মাছ ধরার মতো। খসড়া এজাহার প্রস্তুত করে সম্ভাব্য আসামিদের হোয়াটসঅ্যাপে পাঠানো হয়। তারা যদি অর্থ দেন, নাম বাদ হয়; না দিলে আসামি করা হয়। একজন ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, তাঁকে একটি ছবির মাধ্যমে লক্ষ্য করা হয়েছিল, যেখানে তিনি স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতার সঙ্গে ছিলেন। এরপর তাঁর নাম খসড়া এজাহারে পাঠানো হয়। বন্ধু ও সহকর্মীদের সঙ্গে আলোচনা করে তিনি টাকা দিতে অস্বীকার করেন। পরে তাঁকে আসামি হিসেবে এজাহারে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
একই পদ্ধতিতে, চিকিৎসক ও ব্যবসায়ীরাও লক্ষ্যবস্তু হয়েছেন। এক চিকিৎসক জানালেন, নভেম্বরের দিকে হোয়াটসঅ্যাপে খসড়া এজাহার আসে, যেখানে তার নাম ছিল। যোগাযোগ করে ৪০ হাজার টাকা দিয়ে নাম বাদ করা হয়। তিনি সরকারি চাকরিতে থাকায় আসামি হওয়ার কোনো কারণ নেই। স্থানীয় ক্লিনিকগুলোর প্রতিযোগিতা বা দ্বন্দ্বই এর মূল কারণ।
মামলার মাধ্যমে আর্থিক লেনদেন-
ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন, জামিন নেওয়ার সময়ও টাকা দিতে হয়। কারাগার থেকে মুক্তির জন্য, পুনরায় গ্রেপ্তার এড়াতে আসামি প্রায় ৫০ হাজার থেকে ৪-৫ লাখ টাকা খরচ করেছেন। উদাহরণস্বরূপ, দাগনভূঞা পৌর আওয়ামী লীগের এক নেতা হত্যাচেষ্টা মামলায় গ্রেপ্তার হন। এক মাস কারাভোগের পর উচ্চ আদালত থেকে জামিন পান। তবে পুনরায় গ্রেপ্তার এড়াতে তাঁকে এক লাখ টাকা খরচ করতে হয়েছে।
ফেনী সদর উপজেলার লালপুর এলাকার এক আওয়ামী লীগ নেতা চার লাখ টাকা দিয়ে কারাফটকে পুনরায় গ্রেপ্তার এড়ান। সীমান্তবর্তী মহামায়া ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান শাজাহান মিনু তিন লাখ টাকার বিনিময়ে জামিনের পর পুনরায় গ্রেপ্তার এড়াতে সক্ষম হন।
পুলিশের ভূমিকা ও রাজনৈতিক প্রভাব-
কোনো আসামি জামিন পেলে কারাগারে পুনরায় গ্রেপ্তার বা নতুন মামলায় নাম অন্তর্ভুক্ত করার প্রক্রিয়ায় পুলিশের কর্মকর্তারা সক্রিয়। ফেনী সদর সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. আরিফুল ইসলাম সিদ্দিকীর নাম বিশেষভাবে আলোচিত। তাঁকেসহ দুটি থানার ওসির পাশাপাশি জেলা পুলিশের বিশেষ শাখার কর্মকর্তার বিরুদ্ধেও অভিযোগ আছে। গত ২৭ সেপ্টেম্বর মো. আরিফুল ইসলাম সিদ্দিকীকে চট্টগ্রামের সাতকানিয়া সার্কেলে বদলি করা হয়।
পুলিশ সদর দপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ফেনীতে ‘ফ্যাসিবাদের সঙ্গে জড়িত’ ৮৪৫ জন গ্রেপ্তার হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে ৬৮৭ জনের জামিন মঞ্জুর হয়েছে। কিছু মামলা জামিনপ্রাপ্তদের পুনরায় গ্রেপ্তারের জন্য দেখানো হয়।
মামলা–বাণিজ্যে রাজনীতিকদের নিয়ন্ত্রণ-
ফেনীতে ২২টি মামলা হয়েছে, যার মধ্যে ৭টি হত্যা ও ১৫টি হত্যাচেষ্টার মামলা। ২,১৯৯ জন এজাহারভুক্ত এবং প্রায় ৪,০০০ অজ্ঞাতনামা আসামি রয়েছেন। সাতটি হত্যা মামলার মধ্যে চারটির আসামি ঠিক করেছেন বিএনপির নেতারা, বাকি তিনটি জামায়াতের। হত্যাচেষ্টার ১৫টি মামলার অধিকাংশ বাদী আসামিকে চেনেন না।
ফেনী জেলা জামায়াতের আমির আবদুল হান্নান জানিয়েছেন, তিনটি হত্যা মামলা তারা দেখভাল করেন। তবে আসামি নাম বাদী নিজে দিয়েছেন। ফেনীতে মামলা–বাণিজ্যে বিএনপির দুজন নেতা এবং তাদের অনুসারীদের নাম বেশি আলোচনায় আছে। এর মধ্যে ফেনী পৌর বিএনপির সদস্যসচিব ও আইনজীবী মেজবাহ উদ্দিন ভূঁইয়া উল্লেখযোগ্য। তিনি ছোট মেজবাহ নামেও পরিচিত।
জেলা বিএনপির আহ্বায়ক শেখ ফরিদ বাহার জানিয়েছেন, মেজবাহকে মামলার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তিনি নিজ দায়িত্ববোধ থেকেও যুক্ত হয়েছেন। জেলা যুবদলের সাবেক সভাপতি জাকির হোসেন (জসিম)ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, হত্যাচেষ্টার বেশির ভাগ মামলার বাদী জসিমের অনুসারী।
রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত স্বার্থের জটিলতা-
ফেনীতে সকল হত্যা ও হত্যাচেষ্টার মামলায় ফেনী-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য নিজাম হাজারীর নাম রয়েছে। কিছু মামলায় কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের নেতা ও মন্ত্রীর নামও আছে। ফেনী-৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য জাতীয় পার্টির নেতা মাসুদ উদ্দিন চৌধুরীর নামও বেশির ভাগ মামলায় অন্তর্ভুক্ত। ফেনী-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আলাউদ্দ্দিন চৌধুরী নাসিমের নাম শুরুতে আসেনি। পরে বিএনপির প্রতিক্রিয়ার কারণে একটি হত্যা ও একটি হত্যাচেষ্টা মামলায় তার নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
এছাড়া নিজাম হাজারীর বিরুদ্ধাচরণে ফেনীতে ঢুকতে পারেননি এমন একজন সাখাওয়াত হোসেনকেও এ মামলায় আসামি করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে পুলিশের উচ্চপর্যায় ও মামলার ‘দায়িত্বে থাকা’ রাজনীতিকদের ভূমিকা নিয়ে বিভিন্ন আলোচনা চলছে। ফেনীতে গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ের মামলা–বাণিজ্য এখন স্থানীয় রাজনীতি, ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব ও আর্থিক স্বার্থের অস্ত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। এলাকাবাসী স্বীকার করছে, রাজনীতিকরা এটি প্রকাশ্যে মানলেও ব্যবস্থা নেয়নি।
জেলা বিএনপির আহ্বায়ক শেখ ফরিদ বাহার বলেছেন, গণ-অভ্যুত্থানের সময় কারা গুলি করেছে বা কারা নির্যাতন করেছে, তা সবাই জানে। গণহারে আসামি করার কোনো প্রয়োজন নেই। তিনি আরও জানান, শিগগিরই দলের একটি বর্ধিত সভা হবে, যেখানে মামলা–বাণিজ্যে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
ফেনীতে মামলা–বাণিজ্যের কার্যক্রমকে সাধারণত তিনটি স্তরে ভাগ করা যায়। প্রথম স্তর হলো খসড়া এজাহারের মাধ্যমে সম্ভাব্য আসামিদের ‘পরীক্ষা’ করা। এই পর্যায়ে আসামিরা হোয়াটসঅ্যাপ বা অন্যান্য মাধ্যমে খসড়া এজাহার পেয়ে নাম বাদ দেওয়ার জন্য অর্থ প্রদান করতে পারে। দ্বিতীয় স্তর হলো মামলার প্রাথমিক রেকর্ডে নাম অন্তর্ভুক্ত করা এবং মামলা দায়েরের সময় আসামিদের গ্রেপ্তার করা।
এই পর্যায়ে রাজনৈতিক প্রভাবশালী ব্যক্তি এবং পুলিশের কর্মকর্তারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। তৃতীয় স্তর হলো জামিনপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে পুনরায় গ্রেপ্তারের ঝুঁকি থেকে রক্ষা করা। এ ক্ষেত্রে আবারও বড় অঙ্কের অর্থ দেওয়া হয়, যাতে নতুন মামলা বা পুনরায় গ্রেপ্তারের ঘটনা এড়ানো যায়।
জেলা পুলিশের হিসাব অনুযায়ী, গত বছর ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ‘ফ্যাসিবাদের সঙ্গে জড়িত’ অভিযোগে ৮৪৫ জন গ্রেপ্তার হয়েছেন। এর মধ্যে ৬৮৭ জনের জামিন মঞ্জুর হয়েছে। তবে স্থানীয় সূত্র বলছে, জামিনপ্রাপ্তদের মধ্য থেকে অনেককে পরে অন্য মামলায় পুনরায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। ফলে অনেককে কারাগার থেকে মুক্তির জন্য ৫০ হাজার থেকে ৪-৫ লাখ টাকা পর্যন্ত খরচ করতে হয়েছে।
ফেনীর দাগনভূঞা পৌর আওয়ামী লীগের একটি ওয়ার্ডের নেতা হত্যাচেষ্টার মামলায় গ্রেপ্তার হন। এক মাস কারাভোগের পর উচ্চ আদালত থেকে জামিন পান। তবে পুনরায় গ্রেপ্তার হতে পারে, এমন আশঙ্কায় পরিবারকে এক লাখ টাকা দিতে হয়। ফেনী সদর উপজেলার লালপুর এলাকার আরেক আওয়ামী লীগ নেতা চার লাখ টাকা খরচ করে পুনরায় গ্রেপ্তার এড়াতে সক্ষম হন। সীমান্তবর্তী মহামায়া ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান শাজাহান মিনু তিন লাখ টাকার বিনিময়ে জেলগেট থেকে পুনরায় গ্রেপ্তারের ঝুঁকি এড়াতে সক্ষম হন।
মামলার নিয়ন্ত্রণ রাজনীতিকদের হাতে। ফেনীতে ২২টি মামলা হয়েছে, যার মধ্যে ৭টি হত্যা ও ১৫টি হত্যাচেষ্টার অভিযোগে। এসব মামলায় ২,১৯৯ জন এজাহারভুক্ত এবং প্রায় ৪,০০০ অজ্ঞাতনামা আসামি রয়েছেন। সাতটি হত্যা মামলার মধ্যে চারটির আসামি ঠিক করেছেন বিএনপির নেতারা, বাকি তিনটির আসামি ঠিক করেছেন জামায়াত নেতারা। হত্যাচেষ্টার ১৫টি মামলার অধিকাংশ আসামি বাদীকে চেনেন না। মূলত রাজনৈতিক ব্যক্তিরা পেছন থেকে এসব মামলা করেছেন।
ফেনী জেলা বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির আইনজীবী মেজবাহ উদ্দিন ভূঁইয়া মামলার দেখভালের দায়িত্বে রয়েছেন। তিনি স্থানীয় বিএনপির ছোট মেজবাহ নামেও পরিচিত। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের ঘটনায় করা মামলা তিনি দেখভাল করেন। অভিযোগ রয়েছে, মামলায় কার জামিন হবে, কারা আসামি হবেন, এসব বিষয়ে তাঁর মুখ্য ভূমিকা রয়েছে। জেলা বিএনপির আহ্বায়ক শেখ ফরিদ বাহারও অনুসন্ধানকারী সংবাদমাধ্যমটির কাছে স্বীকার করেছেন, মেজবাহকে মামলা দেখভাল করার দায়িত্ব স্থানীয় বিএনপি থেকে দেওয়া হয়েছে।
গণ-অভ্যুত্থানের মামলায় প্রভাবশালী আরেকজন ব্যক্তি হচ্ছেন জেলা যুবদলের সাবেক সভাপতি জাকির হোসেন (জসিম)। হত্যাচেষ্টার অধিকাংশ মামলার বাদী জসিমের অনুসারী বলে স্থানীয় সূত্র জানাচ্ছে। জাকির হোসেন দাবি করেছেন, একটি মামলা হলে জেলা বিএনপির নেতারা নিজেদের মতো করে আসামি দেন। তিনি বলেন, এখানে কোনো বাণিজ্য নেই; ভুল হলে পুলিশ তদন্ত করে নাম বাদ দিয়ে দেবে।
ফেনী-২ (সদর) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য নিজাম হাজারীর নাম সব হত্যাচেষ্টা ও হত্যার মামলায় রয়েছে। কিছু মামলায় কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের নেতা ও মন্ত্রীদের নামও অন্তর্ভুক্ত। ফেনী-৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য জাতীয় পার্টির নেতা মাসুদ উদ্দিন চৌধুরীর নামও বেশির ভাগ মামলায় আছে। শুরুর দিকে ফেনী-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আলাউদ্দিন চৌধুরী নাসিমের নাম ছিল না। বিএনপির প্রতিক্রিয়ার কারণে পরে একটি হত্যা ও একটি হত্যাচেষ্টা মামলায় তার নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
ফেনীতে মামলা–বাণিজ্যের ক্ষেত্রে স্থানীয় রাজনীতি, ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব এবং আর্থিক স্বার্থের সমন্বয় একটি জটিল চিত্র তৈরি করেছে। রাজনৈতিক ও পুলিশি সূত্রের মধ্যে সমন্বয় নিশ্চিত করে যে, মামলার কার্যক্রম প্রায়শই নির্দিষ্ট ব্যক্তির ওপর চাপ প্রয়োগ বা আর্থিক সুবিধা অর্জনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার হয়।
স্থানীয় ভুক্তভোগী ও ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, ফেনীতে মামলা–বাণিজ্য প্রক্রিয়ায় বিএনপি, জামায়াত নেতাদের সঙ্গে পুলিশের কিছু কর্মকর্তার যোগসাজশ রয়েছে। যারা মামলার এজাহার তৈরি এবং ব্যক্তির নাম অন্তর্ভুক্ত ও বাদ দেওয়ার কাজে লিপ্ত, তারা সাধারণত রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। এই প্রক্রিয়ায় শুধু স্থানীয় নেতাদের নয়, ঢাকা-চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী ও প্রবাসীও প্রভাবিত হচ্ছেন।
চট্টগ্রামে বিদেশি জাহাজে তেল সরবরাহের ব্যবসায়ী আহমেদ মাহি বলেন, তাঁকে ফেনীর একটি হত্যাচেষ্টা মামলায় আসামি করা হয়েছে। প্রথমে তিনি বুঝতে পারেননি কেন তাঁর নাম এসেছে। পরে জানতে পারেন, ব্যবসায়িক বিরোধের কারণে প্রতিপক্ষ টাকা দিয়ে তার নাম অন্তর্ভুক্ত করেছে। ঢাকায় প্রতিরক্ষা ক্রয় মহাপরিদপ্তরে সরবরাহের ব্যবসায়ী একজনকেও একইভাবে দুটি মামলায় আসামি করা হয়েছে।
স্থানীয় বিএনপির নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এমনও ঘটনা হয়েছে যে মামলার উদ্যোক্তা দুই দিক থেকে টাকা গ্রহণ করেছেন। ব্যবসায়িক বা ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বের কারণে কেউ কাউকে আসামি করার জন্য এক পক্ষ টাকা দিয়েছে, আবার অন্য পক্ষের কাছ থেকে নেওয়া হয়েছে নাম বাদ দেওয়ার জন্য। এই বাণিজ্য গত এক বছর ধরে চলছে।
ফেনী জেলা বিএনপির আহ্বায়ক শেখ ফরিদ বাহার অনুসন্ধানকারী সংবাদমাধ্যমটির কাছে স্বীকার করেছেন, ঢাকায় ও চট্টগ্রামে ব্যবসায়ী ও প্রবাসীদের অনাহূত মামলায় জড়ানো হয়েছে। তিনি বলেন, দলীয়ভাবে তিনি এবং জামায়াতের আমির থানাপুলিশকে বলেছেন এ ধরনের মামলা বন্ধ করতে। এখন থানায় মামলা নেওয়া হচ্ছে না, আদালতের মাধ্যমে মামলা করার চেষ্টা হচ্ছে।
ফেনীতে মামলা–বাণিজ্য প্রসঙ্গে বলা যায়, একটি হত্যাচেষ্টা মামলায় কীভাবে আসামি হবেন, কার জামিন হবে বা হবে না, এই সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক প্রভাবশালী ব্যক্তি ও তাদের অনুসারীদের হাতেই থাকে। এই প্রক্রিয়ায় মামলা–বাণিজ্য স্থানীয় রাজনীতির একটি অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে।
জানা গেছে, মামলা–বাণিজ্য এখন ফেনীর রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। সাধারণ মানুষ, ব্যবসায়ী, প্রবাসী ও রাজনৈতিক নেতারা সবাই এই জটিল প্রক্রিয়ার স্বীকার। এতে পুলিশের কিছু কর্মকর্তাও জড়িত। স্থানীয় সূত্র বলছে, মামলার পেছনে থাকা রাজনৈতিক নেতারা প্রায়শই আসামি নির্ধারণ, জামিন অনুমোদন এবং পুনরায় গ্রেপ্তারের বিষয়ে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ রাখেন।
ফেনীর স্থানীয় রাজনীতিতে মামলা–বাণিজ্যের কারণে জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে। সাধারণ মানুষ, ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক নেতারা এই প্রক্রিয়ায় অর্থিক ও সামাজিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। মামলার মাধ্যমে আর্থিক লেনদেন এবং রাজনৈতিক প্রভাব প্রদর্শনের ফলে বিচার প্রক্রিয়া একটি ব্যবসায়িক ও রাজনৈতিক কৌশলে পরিণত হয়েছে।
ফেনীতে গণ-অভ্যুত্থানের পর মামলার বহুতল বাণিজ্য দেখায়, রাজনীতি ও পুলিশের মধ্যে কিভাবে সমন্বয় ঘটছে এবং কিভাবে সাধারণ মানুষ, ব্যবসায়ী ও প্রবাসী এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে প্রভাবিত হচ্ছে। আদালত, পুলিশ ও রাজনৈতিক নেতারা মিলে এমন একটি জটিল ব্যবস্থা তৈরি করেছেন, যা স্থানীয় জনগণের জন্য নিরাপত্তাহীনতা এবং আর্থিক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এ প্রসঙ্গে ফেনী জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. আরিফুল ইসলাম সিদ্দিকীকে গত ২৭ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামের সাতকানিয়া সার্কেলে বদলি করা হয়েছে। স্থানীয় সূত্র জানায়, মামলা–বাণিজ্যের কারণে এই বদলির সঙ্গে তার সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। তবে ফেনী জেলার পুলিশ সুপার মো. হাবিবুর রহমান বলেন, এটি তাঁর জানা নেই; এটি স্বাভাবিক বদলি হতে পারে।
ফেনীতে মামলা–বাণিজ্য প্রসঙ্গে অনুসন্ধান, স্থানীয় রাজনৈতিক ও পুলিশ সূত্র, ভুক্তভোগী ও ব্যবসায়ীদের সাক্ষাৎকার এবং মামলা–নথি বিশ্লেষণের মাধ্যমে দেখা গেছে, ফেনীর রাজনৈতিক ও বিচারিক ব্যবস্থায় মামলার এই বহুতল বাণিজ্য একটি ব্যাপক এবং প্রভাবশালী ফেনোমেনন হিসেবে কাজ করছে। এটি শুধু স্থানীয় রাজনীতিকদের নয়, সাধারণ মানুষ, ব্যবসায়ী ও প্রবাসীদের জন্যও একটি গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক এবং অর্থনৈতিক সমস্যায় পরিণত হয়েছে।
ফেনীতে গণ-অভ্যুত্থানকেন্দ্রিক মামলাগুলো স্থানীয় রাজনীতি, ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব এবং আর্থিক লেনদেনের সমন্বয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। মামলার মাধ্যমে রাজনৈতিক প্রভাব প্রদর্শন, ব্যক্তিগত প্রতিশোধ ও আর্থিক সুবিধা অর্জনের প্রক্রিয়ার কারণে স্থানীয় জনগণ আজও মামলার ভয়, আর্থিক চাপ এবং সামাজিক প্রতিকূলতার মধ্যে রয়েছে।
প্রথম আলোর অনুসন্ধান